অপেক্ষা

ডাহুকের একটানা গলাচেরা ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায় রাহেলার। সাথে সাথেই মনে পড়ে যায় কথাটা। যে কথাটা সে মনে করতে চায় না, যে কথাটা মনে পড়লে দম বন্ধ হয়ে আসে তার। পাশে শুয়ে থাকা স্বামীর গায়ে হাত রাখে সে। গভীর ঘুমে অচেতন সাহেব আলী। গত পাঁচ বছর ধরে চেনে সে মানুষটাকে। জ্যৈষ্ঠ মাসের ঝাঁ-ঝাঁ এক দুপুরে বিয়ের পর তাকে যেমন অচেনা মনে হয়েছিল, আজও ঠিক একই রকম অচেনা মনে হয় তার। বড় সহজ-সরল মানুষটা। কোনো অভাব নেই, অভিযোগ নেই; নেই কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলানো। মানুষের হাজারটা কথায়ও রা করে না সে, বসে থাকে মাথা নিচু করে। চুপচাপ। সারাদিন মাঠে কামলা খেটে এসে স্থির হয়ে বসবে দাওয়ার এক মাথায়। রাহেলা ব্যাপারটা খেয়াল করে হয়তো বলবে, ‘ভাত খাইবেন?’ ‘দ্যাও।’ এমনভাবে উত্তর দেবে সাহেব আলী যেন রাহেলা যদি ভাত না দেয় তাহলে সে এভাবেই উপোস বসে থেকেই কাটিয়ে দেবে দিনটা।
বাঁ হাতের কনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসে রাহেলা। আর উঠে বসতেই অনুভব করে তলপেটের চাপটা। বিছানা থেকে পা নামাতে গিয়েও থেমে যায় সে। শাশুড়ির কড়া নিষেধ— কিছুতেই একা একা বাহির বাড়িতে যাওয়া যাবে না। তার নিজেরও গা-টা ছমছম করে ইদানীং। সাহেব আলী যখন তেলের কুপি হাতে ধরে তার পেছন পেছন যায়, মুখে হুসহুস শব্দ করে অদৃশ্য সাপ কিংবা অশরীরী আত্মা তাড়ায়, তখন অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে যায় মনটা। এমন নয় যে রাহেলার জন্য এই অনুভূতিটা নতুন, তার পরও কেন যেন নিজেকে এবার বড় বেশি ভাগ্যবান মনে হয় তার। গতবার এমন ছিল না সবকিছু। প্রথম দিকে খেতে গিয়ে এক হাতে গাল আর এক হাতে পেট চেপে ধরে উঠে যেতে হতো তাকে, তারপর দাওয়ার এক মাথায় গিয়ে বমি করত উঠোন ভাসিয়ে দিয়ে। ফিরেও তাকাত না সাহেব আলী। নিজের মতো করে খেয়ে নিয়ে আবার কাজে চলে যেত, না হয় চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ত তেল চিটচিটে বিছানায়।

পরপর তিন দিন একই রকম ঘটলে শাশুড়ি ছেলের হাতে একটা দু টাকার ময়লা নোট গুঁজে দিয়ে বলেছিল, ‘বাজান, কামে যাওনের সময় কালা শার মাজারে মোমবাতি জ্বালাইয়া দিয়া যাইস। আষাঢ় মাসের আগে খবর হইলে মাজারে মোমবাতি দিমু মানত আছিল।’ বিয়ের দু বছর পরও কোনো সুখবর দিতে পারছিল না রাহেলা। তার কাছাকাছি সময়ে বিয়ে হওয়া বউ-ঝিরা যখন সন্তানের দাঁত ওঠা উপলক্ষে পিঠা-পায়েস খাওয়ার আয়োজন করছে, সে তখন অলস দুপুরগুলো ব্যয় করছে পুরনো কাঁথার ছিঁড়ে যাওয়া অংশগুলো জোড়া-তালি দিতে। প্রথমে আড়ালে-আবডালে বলাবলি করলেও ধীরে ধীরে বউ-ঝিদের আড্ডার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় তার অনুর্বর গর্ভ, তার শূন্য কোল। শাশুড়ি একরকম ঘোষণা দিয়েই ফেলেন— আষাঢ় মাস পর্যন্ত দেখবেন। না হলে ছেলেকে বিয়ে করাবেন আবার।
বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করত রাহেলার। যদি আষাঢ় মাসের আগে কোনো খবর দিতে না পারে সে! যদি কাপড়ের পুঁটলিটা বুকে চেপে ধরে আবার নদী পার হতে হয়, আবার দাঁড়াতে হয় মামা-মামির সংসারে! অভাবের সংসারে এ সময়টাতে স্বামী কিংবা শাশুড়ির কাছ থেকে কোনো ধরনের আলাদা যত্ন-আত্তি পাবে সেই আশা সে কোনো দিন করেনি। কেবল মাঝে মাঝে মনে হতো, ইস, মা যদি বেঁচে থাকত! যদি মাথার তালুতে চাপড়ে চাপড়ে তেল দিয়ে দিত, তাহলে বেশ আরাম লাগত তার। প্রথম দিকে তেমন কিছু খেতে না পারলেও, পাঁচ মাসের সময় থেকে যেন রাক্ষস ভর করেছিল তার মধ্যে। পোড়া শুকনো মরিচ ডলা হোক কিংবা বাসি শুঁটকির সালুন, উঁচু উঁচু দু থালা ভাত সে সাবাড় করে দিতে পারত নিমেষেই। তার পরও পেটের মধ্যে যেন এক হাঁ করা কুমির— কিছুতেই যেন ক্ষিধা মিটত না তার। ক্ষিধাটা যদি একটু বেশিই লেগে যেত, শুরু হতো ভেতরের প্রাণটার অবিরাম পা ছোড়াছুড়ি।

শাশুড়ি মাঝে মাঝে সতর্ক করতেন, ‘এত গিলিস না মাঝির বেটি, খাওনের তলেই তো চাইপ্যা মরব তোর ছাওয়াল।’ ভয় লাগত রাহেলার। কিন্তু পরক্ষণেই ভেতরের সন্তানের অবিরাম আবদারের কাছে হার মানতে হতো তাকে। এক রাতে ঘুমাতে গিয়ে আবিষ্কার করে— সাহেব আলী তখনও জেগে বসে আছে, হাতে জ্বালানো বিড়িতে টান দিচ্ছে একটু পরপর। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে রাহেলা সেদিন বলেই ফেলেছিল, ‘মনে লয়, আপনের পোলায় আইবো।’ বিড়িতে টান দিতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল সাহেব আলী, ‘কী দেইখা তোর এমুন মনে লয়?’
পা দুটো টান টান করে বিছানার ওপর মেলে দিয়ে রহস্যের হাসি হেসেছিল রাহেলা, ‘যেমুন আছাড়ি-বিছাড়ি করে, পোলা না হইয়া যায় না।’ বলতে বলতে পেটের ওপর নিজের একটা হাত রেখেছিল যত্ন করে, যেন দুষ্টু সন্তানের মাথায় মায়ের প্রশ্রয়ের আদর, ‘বেবাকতে কয়, পেট এমুন ডাঙ্গর হইলে নাকি পোলায় হয়।’ চোখের কোণ দিয়ে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর স্ফীত পেটটাকে পরখ করে নিয়েছিল সাহেব আলী। পাঁচ মাসের তুলনায় পেটটা আসলেই একটু বেশি বড় কিনা এটা সে বুঝে উঠতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু এটুকু বুঝেছে যে, বউটার শরীরে আলাদা একটা লাবণ্য এসেছে, গালটা ফোলা ফোলা হয়েছে বেশ, হাত-পায়ের গোঁছাগুলোও হয়েছে চোখে পড়ার মতো। কিছুটা হেঁয়ালির সুরেই বলেছিল সে, ‘পোলা হইলে তো ভালাই।’
ছেলের মা হতে পারলে সংসারে তার একটা আলাদা মর্যাদা হবে এটা সে জানত। কিন্তু তবু তার কেন যেন মেয়েসন্তানের শখ ছিল ভীষণ। চৈত্র মাসের মেলায় বেদেনীরা বিশাল বিশাল চুড়ির ঝাঁকা মাথায় নিয়ে মেলায় আসে। বটতলায় চট বিছিয়ে মেলে দেয় হাজার রঙের চুড়ি। নিজের জন্য চুড়ি কিনতে গিয়ে রাহেলা হাতে নিয়ে দেখেছে ছোট্ট ছোট্ট চুড়িগুলো। কেবলই মনে হয়েছে—ইস, যদি একটা মেয়ে থাকত তার! হাত ভরে চুড়ি পরাত তাকে। সাত মাসের ভ্রূণ গর্ভে নিয়ে সব বউরা বাবার বাড়ি যায়— এটাই নিয়ম। রাহেলার সৌভাগ্য হয়নি সে নিয়ম পালন করার। এতটা সে আশাও করেনি কখনো। কিন্তু একদিন ভর দুপুরে তালি দেওয়া, রঙচটা ছাতাটা মাথায় দিয়ে তার মামা যখন হাজির হয়েছিল, পা ছুঁয়ে সালাম করতেই যখন বগলে ধরা কাগজ পেঁচানো মোটা সুতায় বোনা শাড়িটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল, চোখে পানি এসে গিয়েছিল তার। বারবার মনে হয়েছিল— এত সুখও লেখা আছে তার কপালে!

টিনের গ্লাসে লেবুপাতা কচলে দেওয়া চিনির পানিটা মামার সামনে রাখতে রাখতে বলেই ফেলেছিল শাশুড়ি, ‘এইখান আনোনের কী দরকার আছিল। না খাওয়াইয়া, না পিন্দাইয়া তো রাখি নাই আফনের বইন ঝি রে।’ নিচু করে রাখা মাথাটা সামান্য তুলে আবার নামিয়ে নিয়েছিল তার মামা, ‘মোর তো হাউস আছিল, নাইওর লইয়া যাই রাহেলারে, তয়…।’ মামার সংসারের জোড়া-তালি দেওয়া অবস্থাটা জানে রাহেলা, জানে বলেই দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল শূন্য দৃষ্টিতে, চোখের কোণে জমা বিন্দু বিন্দু জলটুকু সবার অজান্তে মুছে নিয়েছিল শাড়ির আঁচলে। কালা শার কল্যাণে ছেলের বউ পোয়াতি হয়েছে। মাজারের প্রতি শাশুড়ির আস্থা বেড়ে তত দিনে হাজার গুণ। সাত মাস পেরোলে মাজারে গিয়ে তাই আবার মানত করে এসেছিল শাশুড়ি। এবার আর শুধু মোমবাতি নয়, ঘর আলো করে নাতি আসলে শিরনি দেবে মাজারে, সাথে দশটা টাকাও।
রাহেলা জানত না শাশুড়ির এই উদার দানের উত্স কী হবে, তবে এটুকু জানত, পোষা মুরগির দু-চারটা ডিম বিক্রি করা টাকার একটা গোপন সঞ্চয় আছে শাশুড়ির। বুকের ভেতর ক্রমাগত উথাল-পাথাল করতে থাকা আশঙ্কার ঢেউটা আছড়ে পড়লে একদিন শাশুড়িকে প্রশ্নটা করেই ফেলেছিল রাহেলা, ‘যদি পোলা না হইয়া মাইয়া হয়, তয়?’ রাহেলার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে বিষাদময় মুখটা ফিরিয়ে নিয়েছিল শাশুড়ি, ‘তয় আর কী, তোর কপালে ঝাঁটা, ঝাঁটা তোর বেটির কপালেও।’ তারপর থেকে চৈত্রের মেলায় দেখা স্বপ্নটাকে মাটিচাপা দিয়ে একমনে সৃষ্টিকর্তাকে ডেকেছে রাহেলা, ‘আমার দিকে মুখ তুইল্যা চাইও খোদা।’
সবার কাছে শুনে শুনে একরকম মুখস্থই হয়ে গিয়েছিল রাহেলার। তবুুও ভোররাতে যখন কোমরের কাছের চিনচিনে ব্যথাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ধরেছিল তার। ঘরের ভেতর জমাট বাঁধা অন্ধকারটা যেন চেপে বসেছিল শরীরের ওপর। পাশে শুয়ে থাকা সাহেব আলীকে ডাকার প্রাণপণ চেষ্টা করেও শব্দ বের করতে পারছিল না গলা থেকে। হাত দিয়ে বেশ কয়েকবার জোরে ধাক্কা দিতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেছিল সাহেব আলী। উঠে গিয়ে ঘরের কোণায় রাখা হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে ধরেছিল রাহেলার মুখের কাছে। রাহেলার চেহারার কাতরতা, কপালে জমে ওঠা বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঠোঁট চেপে প্রাণপণ চিত্কার চাপার আকুল চেষ্টা— সবকিছু দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল সে। তারপরের দুঃসহ দুদিনের কথা মনে পড়লে এক সমুদ্র নোনা জল উঠে আসে রাহেলার বুক থেকে, তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ওলট-পালট করে দিয়ে যায় ধুলো মাটিতে লুটোপুটি খাওয়া একমুঠো অস্তিত্ব।

সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মাঝখানের দিনগুলো এখানে বড় বেশি সাদামাটা, একেকটা দিন যেন পুকুরের শান্ত জল— বিচিত্র ঘটনার উথাল-পাথাল ঢেউ নেই, নেই হাসি আনন্দের রঙিন বুদবুদ। অস্তিত্বের টানাপড়েনে ম্যাড়ম্যাড়ে জীবন নিয়ে সবাই কেমন যেন বিহ্বল, হতাশ। এইসব সাদামাটা দিনগুলোতে যেন বৈচিত্র্যের আঁচড় কেটে দিয়েছিল রাহেলার চিত্কার, ওর গোঙানি যেন সকলের অলস দিনগুলোতে এনে দিয়েছিল চাঞ্চল্যের ছোঁয়া। আশেপাশের সব বাড়ির বউ ঝিরা ভেঙ্গে পড়েছিল সাহেব আলীর একচিলতে উঠানে। ‘রাহেলার নাকি বেদনা উঠছে?’ পানের রসটা গিলে নিয়ে জানতে চায় উত্তর বাড়ির জয়নব বিবি। পাশে রাখা কাঠের পিঁড়িটা এগিয়ে দেয় রাহেলার শাশুড়ি, ‘বেদনা তো উঠছে মোল্লার আজানের আগে আগে, তয়…।’

‘কালার মারে খবর দিছো?’ মাথাটা ঝুঁকিয়ে ঘনিষ্ঠ হয় জয়নব বিবি। ‘হ।’ ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে যাঁতির নিচে সুপারি কুচিকুচি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাহেলার শাশুড়ি। বছরের পর বছর ধরে প্রসূতি মায়ের ভার এই কালার মায়ের হাতে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয় এই গ্রামের মানুষগুলো। একা হাতেই সব করে সে। বাঁশের বাকল তুলে ব্লেড বানানো থেকে শুরু করে পুরনো লুঙ্গি ছিঁড়ে ন্যাকড়া বানানো, প্রসূতির পেটে গরম তেল মালিশ করা থেকে শুরু করে ভূমিষ্ঠ সন্তানের নাড়ি কাটা— কোনো কাজেই জুড়ি নেই কালার মায়ের। রাহেলার চিত্কার আর ছটফটানি দেখে সাহেব আলী একবার বুকের সবটুকু সাহস সঞ্চয় করে দাঁড়িয়েছিল মায়ের সামনে, ‘আম্মা, ভ্যান লইয়া রাহেলারে গঞ্জের হাসপাতালে লইয়া যাই?’
চোখ কটমট করে তাকিয়েছিল রাহেলার শাশুড়ি, ‘অত দরদের দরকার নাই। সন্তান হওনের সময় এমুন কষ্টই হয়।’ শেষ আরেকবার চেষ্টা করেছিল সাহেব আলী, ‘দুই দিন হইয়া গেল।’ ‘কালার মা আছে না? এত পেরেশানি কিয়ের?’ রীতিমতো মুখ ঝামটে উঠেছিল রাহেলার শাশুড়ি। সেই কালার মা’কেও হারিয়ে দিয়েছিল রাহেলার সন্তান। দুদিন একটানা উথাল-পাথাল করেছে গর্ভে, ব্যথায় পাগল রাহেলা চিত্কার করেছে লজ্জা-শরম ভুলে। দুদিন পর ক্লান্ত শ্রান্ত রাহেলার শরীরে যখন আর এক ফোঁটাও শক্তি অবশিষ্ট নেই তখন পৃথিবী দেখেছে রাহেলার সন্তানকে। তবে তার সন্তানের সৌভাগ্য হয়নি এই পৃথিবীটাকে দেখার— এইটুকুন ছোট্ট মানুষটার আরও ছোট্ট ধুকপুকে হূিপণ্ডটা যে স্থির হয়ে গেছে ততক্ষণে।
ফুটফুটে ছেলেটাকে কেবল একবারের জন্য ছুঁয়ে দেখতে পেরেছিল রাহেলা, খুব ইচ্ছে করছিল একবার বুকে জড়িয়ে ধরে ছেলেকে, একবার গালটা ছোঁয়ায় ছেলের নরম গালে। এর পরের একটা বছর কিভাবে কেটেছে রাহেলা মনে করতে পারে না কিছুই। শুধু মনে হয়েছে একটা দুঃস্বপ্নের ঘোরে আটকে পড়ে কেবলই হাঁসফাঁস করছে সে। বছর ঘুরে আবার রাহেলার গর্ভে স্থান করে নিয়েছে ছোট্ট একটা ভ্রূণ। ততদিনে পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মীরও পা পড়েছে সাহেব আলীর উঠোনে। এবার আর ভুল করেনি রাহেলার শাশুড়ি। মাঠকর্মীর কথা শুনে রাহেলাকে নিয়ে নিজেই গেছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ডাক্তার আপা যখন তার পেটে আলতো হাতে চাপ দিয়ে দেখছিল তখন মনে হয়েছিল—ইস, ব্যথা পাবে না তো তার বাছাটা! কিন্তু পরক্ষণেই আপার ভরা গলা আশ্বাস দিয়েছিল তাকে, ‘সব ঠিক আছে রাহেলা, তোমার বাচ্চাও ভালো আছে।’

আর ঠিক সেই মুহূর্তে আপার মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে দেখে আশায় বুক বেঁধে নিয়েছিল রাহেলা। নিয়ম মেনে সবই করেছে রাহেলা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে সময়মতো টিকা দেওয়া, ডাক্তারের চেকআপ। খুব কষ্ট হয়েছে খেতে, তবু ডাক্তার আপার দেওয়া আয়রন ক্যাপসুলগুলোও খেয়েছে সে। রাহেলার শাশুড়িরও এ ব্যাপারে আজকাল খুবই আগ্রহ। সরকারি হাসপাতাল থেকে কার্ড করে দিয়েছে রাহেলাকে। ডাক্তার দেখানোর কোনো খরচ নেই, নেই ওষুধপথ্য কিংবা টিকা দেওয়ার খরচ। শুধু তাই না, বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর রাহেলা পাবে নগদ আড়াই হাজার টাকা, শাড়ি; বাচ্চার জন্য দু সেট কাপড়, একটা তোয়ালে, এক বয়াম হরলিক্স। তবে শর্ত একটাই— বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হতে হবে হাসপাতালে।
রাহেলার শাশুড়িরও আপত্তি নেই এ ব্যাপারে। কালার মায়ের এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে, চোখেও আজকাল ঠিকমতো দেখতে পায় না মহিলা। তার ওপর তো চোখ বুজে ভরসা করে থাকা যায় না। দুপুরের ভাতঘুম বাদ দিয়ে রাহেলার শাশুড়ি আজকাল দাওয়ায় পিঁড়ি পেতে বসে। আশেপাশের দু-চারজনের সাথে বেশ গল্পে মেতে ওঠে। এ কথা সে কথার পর অবশ্যম্ভাবীভাবে উঠে আসে হাসপাতালের কথা। খুব নিশ্চিন্ত মনে পানের খিলিটা মুখে চালান করে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘ডাক্তার আফা কইছে, বাচ্চা লইয়া বাড়িত আওনের সময়ই হাতে হাতে বুঝাইয়া দিব সব।’ রাহেলাদের ভবিষ্যতের সুখচ্ছবি কল্পনায় কারও কারও দৃষ্টিতে ঈর্ষার ছায়া পড়ে। কেউ কেউ আবার যেচে উপদেশ দেয়, ‘একখান ভ্যান ঠিক কইরা রাইখেন।’ দু-একটা কথা কানে যায় রাহেলার। দুঃসহ পুরনো স্মৃতিতে পরশ বুলিয়ে রাহেলা চোখ বুজে। তার অনাগত সন্তানের মুখচ্ছবি কল্পনায়।
তলপেটের চাপটা আর সহ্য করতে না পারলে বাধ্য হয়ে রাহেলা ডাক দেয় সাহেব আলীকে। উঠে বসে চোখ কচলায় সাহেব আলী। গত কয়েক মাসে রাহেলার ডাকে ভোররাতে জেগে উঠে হারিকেন হাতে পিছু পিছু যাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে তার। কথা না বলে হারিকেন হাতে এগিয়ে যায়। ভারী শরীরটাকে টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় রাহেলাও। আর উঠে দাঁড়াতেই মনে হয় কোমরের কাছটাতে কামড়ে ধরেছে কিছু একটা, তলপেট ফেড়ে যেন বের হয়ে আসতে চাইছে তার গর্ভের সন্তান। রাহেলার ‘ও আল্লাগো’ চিত্কারে ঘুরে দাঁড়ায় সাহেব আলী। রাহেলার শাশুড়িও উঠে বসে গভীর ঘুম ভাঙা চোখে। হাসপাতালের ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেছিল, আরও তিন সপ্তা বাকি। কিন্তু সময়ের আগেই ওঠা প্রসব বেদনায় বিহ্বল হয়ে পড়ে সবাই।

‘একখান ভ্যান ডাইক্যা আন বাজান।’ তারস্বরে ছেলেকে ডেকে হুকুম করে রাহেলার শাশুড়ি। যেভাবেই হোক হাসপাতালে নিতে হবে রাহেলাকে। হাসপাতালে যাওয়ার আগেই যদি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে যায় রাহেলার, সর্বনাশ হয়ে যাবে তাহলে, আড়াই হাজার টাকা, আনুষঙ্গিক সবকিছুর জন্য এত দিনের অপেক্ষা, বৃথা যাবে সব। সবাই ভাবছে, প্রথমবার যেহেতু দু-দুটো দিন কষ্ট পেতে হয়েছে রাহেলাকে, এবারও নিশ্চয় তার ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ব্যথা ওঠার এক ঘণ্টার মধ্যেই পৃথিবীর আলো দেখে রাহেলার মেয়েসন্তান। সন্তানের কান্না কানে যেতেই আকুল হয়ে ওঠে সে, ‘আম্মা, আমারে একটু দেখাইবেন।’

কোনো উত্তর নেই শাশুড়ির। এদিক-ওদিক তাকায় রাহেলা। নাড়ি কাটার কোনো আয়োজন নেই, নেই বাচ্চাটাকে ন্যাকড়ায় জড়িয়ে বুকে চেপে ধরার তোড়জোড়। পাঁজাকোলে করে রাহেলাকে নিয়ে ভ্যানে ওঠায় সাহেব আলী। আর মায়ের শরীরের সাথে নাভির নাড়ি দিয়ে জুড়ে থাকা সন্তানটাকে কোলে নিয়ে ওঠে তার শাশুড়ি। ‘আমারে কই লইয়া যান, আম্মা?’ কাতর গলায় জানতে চায় রাহেলা। ‘চুপ কর মাঝির বেটি, হাসপাতালে নিয়া যাই তরে।’ শাশুড়ির ধমকে চুপ হয়ে যায় রাহেলা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চলতে শুরু করে ভ্যান। শাশুড়ি অনর্গল জপছে রাহেলার কানের কাছে, ‘শোন, হাসপাতালে যাইয়া কবি, বাচ্চা বাড়িতে হয় নাই, ভ্যানে কইরা হাসপাতালে আইতেছিলাম, ভ্যানেই বাচ্চা হইয়া গ্যাছে।’
অবাক হয় রাহেলা, ‘ক্যান?’ ‘ক্যান আবার, বাড়িত বাচ্চা হইছে কইলে টাকা-পয়সা পাবি?’ আবার ধমকের সুর শাশুড়ির কণ্ঠে। রাহেলার ইচ্ছে করছে চিত্কার করে বলে, দরকার নাই টাকা-পয়সার, আমার বুকে আমার বাছা ধনরে দ্যান, ওর নাড়িটা কাইটা দ্যান। বহু কষ্টে চিত্কার চেপে রাখে রাহেলা। বুকের ভারী কষ্টটা অনর্গল গলতে থাকে দু চোখের কোল বেয়ে। শাশুড়ির সেদিকে খেয়াল নেই। এক হাতে সে ধরে রেখেছে বাচ্চাকে আর এক হাতে পেঁচিয়ে রেখেছে নাড়িটা। রাহেলা বহু কষ্টে মুখটা উঁচু করে দেখতে চায় মেয়ের মুখটা। ফর্সা হয়ে এসেছে চারদিক। সকালের নরম রোদ এসে পড়েছে রাহেলার শরীরের সাথে এক টুকরো নাড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা শিশুটার মুখে। চোখ বুজে আছে মেয়েটা, আহারে! কিন্তু একি! এমন হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে কেন তার মেয়েটা! এমন কুঁকড়ে যাচ্ছে কেন মেয়েটার মুখের চামড়া! এত কষ্ট হচ্ছে কেন তার বাছাটার! গভীর রাতে শোনা ডাহুকের ডাকটা মনে পড়ে যায় রাহেলার। অনেক আগে একবার শুনেছিল, গভীর রাতে গলা ফাটিয়ে চিত্কার করে ডাকে মা ডাহুক। অনর্গল চিত্কারে গলা ফেটে রক্ত উঠে এলে মা ডাহুক সে রক্ত ঢেলে দেয় তার তা দেওয়া ডিমে। তবেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় ডাহুকের। মেয়ের নীল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বুকে মোচড় দেয় রাহেলার। মা ডাহুকের মতো সেও যদি বুক ফাটিয়ে চিত্কার দিতে পারত, একবার যদি বুকে জড়িয়ে ধরতে পারত মেয়েটাকে, বুকের সবটুকু শ্বাস জড়ো করে যদি ঢেলে দিতে পারত সন্তানের মুখে। আহারে, একবার যদি পারত! —–সুমন্ত আসলাম

দক্ষিণী ভাল্লুক

গ্রামে একটি কাঁচারাস্তা যখন পাকা হয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *