ঝরনা কাঁদে না তবু

মহানবীর (সা) অক্লান্ত শ্রম ও প্রচেষ্টায় ইসলামের আবাদে ফল-ফসলে ভরে উঠলো গোটা মদিনা। মদিনা এখন ইসলামের সবুজ ফসলের ক্ষেত, ফলভার বৃক্ষের সমাহার, সুশীতল ছায়াঘন বৃক্ষরাজি। মদিনা মানেই একখণ্ড উর্বর ও ফসলি ভূমি। রাসূল (সা), ইসলাম এবং এক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আহবানের ভিত্তি মজবুত হয়ে উঠেছে মদিনায়। সেখানকার ধনী, সম্পদশালী এবং খ্যাতিমান গোত্রপতিদের অনেকেই মহানবীর (সা) ডাকে সাড়া দিয়ে বদলে নিয়েছেন তাদের জীবনের পোশাক-আশাক এবং পুরনো আচার-আচরণ। ইসলাম মানেই তো এক আলো ঝলমলে মহা-দিগন্তের উন্মোচন। ইসলাম মানেই যত শান্তি, তৃপ্তি আর অনিঃশেষ নিরাপত্তা। যারা হতভাগ্য, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যারা বিবেকবান, তারা তো আর অন্ধের মত চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারেন না। তাদের খোলা আছে এক জোড়া সন্ধানী চোখ। খোলা আছে বিশাল বুকের চাতাল। সুযোগ পেলেই তারা সেই বুকের জমিনে ভরে নেন অঢেল প্রশান্তির সুবাতাস।

মদিনার এমনি একটি অভিজাত ও খান্দানী গোত্রের নাম খাযরাজ। খাযরাজ গোত্রের নাম মদিনার সকল মানুষের মুখে মুখে। ভেসে বেড়ায় তাদের সুখ্যাতি বাতাসের শরীর ছুঁয়ে। এই বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের নাজ্জার শাখার সন্তান আল হারেসা। আব্বার নাম সুরাকা, মায়ের নাম রাবী। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত নাদারের কন্যা। আশ্চর্য তার জীবনধারা। আর কী এক উজ্জ্বলতায় ভরা তার ভাগ্য। তিনি নারী হয়েও প্রিয় রাসূল (সা) এর একজন উঁচু স্তরের সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। আবার অন্যদিকে ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সা) এর খাদেম আসাদ ইবনে মালিকের আপন ফুফু। এমনি একটি আলোকিত-গর্বিত পরিবার ও গোত্রের সন্তান আল হারেসা। সুতরাং তার জীবনটাকেও তিনি খুব সহজে রঙিয়ে নিতে পারলেন মায়ের দেখানো পথে। রাসূল (সা) এর ভালোবাসা ও আল্লাহর প্রেমের করুণার বৃষ্টিধারায় তিনি পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে নিলেন আপন আত্মা।

আব্বা সুরাকা, তার নসিব হয়নি ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হবার, কারণ রাসূল (সা) এর মদিনায় আগমনের আগেই তিনি ইন্তেকাল করেছিলেন। কিন্তু মা! তিনি রাসূল (সা) এর দাওয়াত পাওয়ার সাথে সাথেই ইসলাম গ্রহণ করলেন। সাথে আদরের সন্তান আল হারেসাও। মা এবং ছেলে দুজনই কী অসীম সৌভাগ্যের অধিকারী!

সময় গড়াতে থাকলো কালের পিঠে। সে যেন বাতাসের ঘোড়া। নাকি অন্য কিছু? থামে না সময়, কেবলই বয়ে চলে কলকল করে। ক্রমাগত সামনের দিকে। সময়ের হাত ধরে এক সময় এসে গেল বদর যুদ্ধ। বদর মানেই তো মুসলমানদের জন্য এক কঠিন পরীক্ষার ক্ষেত্র। বদর মানেই তো আগুনের পর্বত, কিংবা উত্তপ্ত লাভাস্তূপ। এই বদর যুদ্ধে সোৎসাহে অংশ নিলেন আল হারেসা। রাসূল (সা) তিনিই এই যুদ্ধের মহান সেনাপতি। মহান সেনাপতির ছায়াতলে একজন দৃঢ়চিত্ত সৈনিক আল হারেসা। তিনিও যাচ্ছেন বদর প্রান্তরে। মহান সেনাপতির নির্দেশ লাভের পরই আদৌ দেরি না করে তিনিই সর্বপ্রথম উঠে বসলেন ঘোড়ার পিঠে। চলতে শুরু করলেন বদর অভিমুখে। তাজি ঘোড়ার পিঠে দুঃসাহসী সৈনিক আল হারেসা। ঘোড়া ছুটছে দুরন্ত গতিতে। টগবগিয়ে। ঘোড়া দুরন্ত পায়ে উড়ছে পথের ধুলো। মরুভূমির সাদ সাদা বালুর মেঘ। প্রমাগত এগিয়ে চলছেন ঘোড়ার পিঠে এক অসীম সাহসী যোদ্ধা আল হারেসা। সঙ্গে আছেন স্বয়ং সেনাপতি রাসূল মুহাম্মাদ (সা)। রাসূল (সা) হারেসাকেই তাঁর তত্ত্বাবধায়ক ও পর্যবেক্ষক হিসেবে সঙ্গে করে রেখেছেন।

নিজস্ব দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সদা সতর্ক আল হারেসা। কী সৌভাগ্যবান তিনি! কী বিশ্বস্ত এবং দায়িত্ববান! যার কারণে এই কঠিনতম বদর যুদ্ধের যাত্রা পথে রাসূল (সা) এর তত্ত্বাবধায়কের মত গুরুদায়িত্বে অভিষিক্ত হতে পারলেন! এ ছিল রাসূল (সা) পক্ষ থেকে পাওয়া হারেসার জন্য এক বিশাল পুরস্কার, যা পৃথিবীর অন্য কোনো সম্পদ কিংবা সম্পদের সাথে তুলনা করা যায় না। সত্যি, একমাত্র আল্লাহর রহমত, রেজামন্দি, মঞ্জুর ও রহমত ছাড়া এ ধরনের সৌভাগ্য অর্জনও সম্ভবপর হয় না।

শুকরিয়া আদায় করলেন আল হারেসা। হৃদয়ের সকল আকুতির আর অনুভূতি ও আবেগ নিয়ে হাত উঠালেন প্রভুর দরবারে। আল্লাহপাক তার হৃদয়কে প্রশস্ত এবং শীতল করে দিলেন। রাসূল (সা) তো সাথেই আছেন। সুতরাং তার আর কিসের ভয়? না, কোনো শঙ্কা কিংবা পরওয়া নয়। বদর অভিমুখে রাসূল (সা) সঙ্গে হারেসা এগিয়ে চলেছেন ক্রমাগত। চলতে চলতে এক সময় তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লেন আল হারেসা। বুকে আছে ঈমানের তেজ। হৃদয়ে আল্লাহ ও রাসূল (সা) প্রেমের সুবাতাস। মাথার ওপরে আছে রহমত ও বরকতের ছায়া। তবু, তবুও তৃষ্ণার্ত তিনি। তৃষ্ণার্ত- কারণ, তিনি তো মানুষ। জাগতিক প্রয়োজন ছাড়া কি কোনো মানুষ বাঁচতে বা চলতে পারে? চলা সম্ভবও নয়। মানুষ হিসাবে যা যা দুনিয়ায় প্রয়োজন হয়, তা তো পূরণ করতেই হয়। যেমন ক্ষুধা লাগলে খেতে হয়। পিপাসা পেলে পানি পান করতে হয়। এই প্রয়োজন কখনোই মানুষের পিছু ছাড়ে না। আল হারেসাও দারুণ পিপাসার্ত হয়ে উঠলেন। পিপাসায় তার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। তার এখন পানির প্রয়োজন। তিনি নামলেন ঘোড়ার পিঠ থেকে। তারপর দ্রুত গতিতে চলে গেলেন একটি ঝরনার কাছে। ঝরনা! কী মোহময় ছন্দে ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে ঝরনার পানি। আহ! কী চমৎকার! কী স্বচ্ছ! বুকটা জড়িয়ে যাচ্ছে আল হারেসার। তিনি পানি পান করছেন ঝরনা থেকে। আর তখন, ঠিক তখনই- একটি তীর এসে বিঁধে গেল তার শরীরে! পাপিষ্ঠ হিব্বান ইবন আরাফার নিক্ষিপ্ত তীর। তীরবিদ্ধ অবস্থায় ছটফট করছেন আল হারেসা। গড়িয়ে পড়লো তার হাতে ভরা ঝরনায় সুপেয় স্বচ্ছ তৃষ্ণার পানি। গড়িয়ে পড়লেন তিনি নিজেও। আর মুহূর্তেই নিস্তেজ হয়ে পড়লেন আল হারেসার শরীর। জাগতিক পিপাসা নিটলো না তার। পানির তৃষ্ণা থাকলেও সবচেয়ে বড় যে পিপাসা, সেই শহীদ হওয়ার পিপাসা ও তৃষ্ণা মিটিয়ে দিলেন মহান রাব্বুল আলামীন। তিনি শহীদ হলেন। আনসারদের মধ্যে আল হারেসাই প্রথম শহীদ। সুতরাং এখানেও রয়ে গেল তার অনন্য মর্যাদার আসন।

এমনি এক মহান মা রাবী, যিনি তার ছেলে আল হারেসাকে ভালোবাসতেন অত্যাধিক। তিনি ছিলেন রাসূল (সা) এর খাদেমের ফুফু। তার সেই সোনার ছেলে শহীদ হলেন! বদর থেকে মদিনায় ফিরে এলেন সেনাপতি রাসূল (সা)। রাসূলের (সা) ফিরে আসার খবর শুনেই তাঁর কাছে ছুটে গেলেন মা রাবী। রাসূলকে কাঁদোস্বরে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার ছেলে হারেসাকে আমি কতটা ভালোবাসি, তা আপনি জানেন। সে শহীদ হয়েছে। তাতে আমি খুশি। কিন্তু আমার আশঙ্কা দূর না হওয়া পর্যন্ত আমি কিছুতেই শান্তি ও স্বস্তি পাচ্ছি না। বলুন, বলুন হে দয়ার নবীজী (সা), আমার হারেসা কি জান্নাতের অধিকারী হয়েছে? যদি তা হয়, তাহলে আমি সবর করবো হাসিমুখে। ভুলে যাব আমার শোক-তাপ। আর যদি সে জান্নাতী না হতে পারে, তাহলে দেখবেন, আমি কি করি!”

রাসূল (সা) খুব মনোযোগের সাথে শুনলেন হারেসার মা রাবীর কথা। তারপর তিনি বললেন, “এসব কি বলছো তুমি? জান্নাতের সংখ্যা তো একটু দুটো নয়। জান্নাতের সংখ্যা অনেক। আর তোমার কলিজার টুকরো আল হারেসা সর্বশ্রেষ্ঠ জান্নাত আল-ফেরদৌসের অধিকারী হয়েছে।”

সত্যিই! রাসূলের (সা) মুখে ছেলের এই সুখবর শুনেই আনন্দে আত্মহারা মা। তারপর মৃদু হাসতে হাসতে উঠে গাঁড়ালেন। আর তখন তার মুখ থেকে উচ্চারিত হলো, “সাবাশ! সাবাশ! সাবাশ হে আল হারেসা!” মায়ের হৃদয়ের পুঞ্জিভূত কষ্ট মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল। ছেলের সাফল্যে মায়ের বুকটা আরব সাগরের চেয়েও বিশাল হয়ে গেল। কেন হবে না! কম কথা নয়, তিনি এখন মর্যাদাসম্পন্ন একজন শহীদের গর্বিত মা। কী সৌভাগ্য তার!

আল হারেসারও আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল শহীদ হবার। শহীদের তৃষ্ণায় তিনি ছিলেন কাতর। একবার রাসূল (সা) সঙ্গে পথে দেখা হলো হারেসার। রাসূল (সা) জিজ্ঞেস করলেন, “হারেসা! আজ তোমার সকাল কেমন হলো?” হারেসা বললেন, “এমন অবস্থায় যে, আমি একজন খাঁটি মুসলমান।” রাসূল (সা) বললেন, “একটু ভেবে বলো, হারেসা। প্রত্যেকটি কথার কিন্তু গূঢ় অর্থ থাকে।” আল হারেসা বিনম্র এবং প্রশান্ত কণ্ঠে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! ‍দুনিয়া থেকে আমি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। আমার রাত কাটে ইবাদাত-বন্দেগীতে। আর দিন কাটে রোযা রেখে। বর্তমান মুহূর্তে আমি যেন নিজেকে আরশের দিকে যেতে দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে জান্নাতীরা জান্নাতের দিকে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামের দিকে চলছে।”

আল হারেসার এই কথা শুনে রাসূল (সা) বললেন, “আল্লাহ পাক যে বান্দার অন্তরকে আলোকিত করেন, সে অন্তর আর আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না।” আল হারেসা প্রাণপ্রিয় রাসূল (সা) এর কাছে আরজ করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি আমার শাহাদাতের জন্য একটু দোয়া করুন। শাহাদাতই আমার একান্ত তৃষ্ণার পানি। হৃদয়ের একান্ত আরাধ্য বিষয়।”

আল হারেসার তৃষ্ণা এবং হৃদয়ের আকুতি দেখে খুশি হলেন দয়ার নবীজী (সা)। তিনি সত্যিই দোয়া করলেন হারেসার শাহাদাতের জন্য। রাসূল (সা) এর দোয়াতে, বৃথা যায় না কিছু। মহান রাব্বুল আলামীন কবুল করলেন তাঁর হাবীবের দোয়া। কবুল করলেন আল হারেসার পিপাসিত কামনাও। অতঃপর শহীদ হলেন তিনি বদরে। আর শাহাদাতের মাধ্যমে পেয়ে গেলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, মহান এবং বিরল এক পুরষ্কার।

মূলত, শাহাদাতের পিপাসার কাছে অতি তুচ্ছ জাগতিক পিপাসা কিংবা ঝরনার পানি। আল হারেসা! তিনি পিপাসা মেটাবার জন্য গিয়েছিলেন ঝরনার কাছে। হাতে তুলে নিয়েছিলেন তৃষ্ণার পানি। কিন্তু ঝরনাও হার মানলো। হার মানলো আল হারেসার শাহাদাতের সুতীব্র পিপাসার কাছে। এক সম্মানিত মেহমান এসেছিলেন পিপাসা মেটানোর জন্য ঝরনার কাছে। কিন্তু পারলো না সে! পরাস্ত হলো ঝরনা। ঝরনা কাঁদে না তবুও, সে কেবল অপলক চেয়ে থাকে এক সাফল্যের দ্যুতি জোতির্ময় নক্ষত্রের দিকে। তিনি, সেই নক্ষত্রটি আর কেউ নন- আল হারেসা। এমনি হয়। আল্লাহ পাক যাকে কবুল করেন, পৃথিবীর সকল কিছুই পরাস্ত হয়ে যায় তার কাছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ঝরনা কাঁদে না তবু

মহানবীর (সা) অক্লান্ত শ্রম ও প্রচেষ্টায় ইসলামের আবাদে ফল-ফসলে ভরে উঠলো গোটা মদিনা। মদিনা এখন ইসলামের সবুজ ফসলের ক্ষেত, ফলভার বৃক্ষের সমাহার, সুশীতল ছায়াঘন বৃক্ষরাজি। মদিনা মানেই একখণ্ড উর্বর ও ফসলি ভূমি। রাসূল (সা), ইসলাম এবং এক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আহবানের ভিত্তি মজবুত হয়ে উঠেছে মদিনায়। সেখানকার ধনী, সম্পদশালী এবং খ্যাতিমান গোত্রপতিদের অনেকেই মহানবীর (সা) ডাকে সাড়া দিয়ে বদলে নিয়েছেন তাদের জীবনের পোশাক-আশাক এবং পুরনো আচার-আচরণ। ইসলাম মানেই তো এক আলো ঝলমলে মহা-দিগন্তের উন্মোচন। ইসলাম মানেই যত শান্তি, তৃপ্তি আর অনিঃশেষ নিরাপত্তা। যারা হতভাগ্য, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যারা বিবেকবান, তারা তো আর অন্ধের মত চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারেন না। তাদের খোলা আছে এক জোড়া সন্ধানী চোখ। খোলা আছে বিশাল বুকের চাতাল। সুযোগ পেলেই তারা সেই বুকের জমিনে ভরে নেন অঢেল প্রশান্তির সুবাতাস।

মদিনার এমনি একটি অভিজাত ও খান্দানী গোত্রের নাম খাযরাজ। খাযরাজ গোত্রের নাম মদিনার সকল মানুষের মুখে মুখে। ভেসে বেড়ায় তাদের সুখ্যাতি বাতাসের শরীর ছুঁয়ে। এই বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের নাজ্জার শাখার সন্তান আল হারেসা। আব্বার নাম সুরাকা, মায়ের নাম রাবী। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত নাদারের কন্যা। আশ্চর্য তার জীবনধারা। আর কী এক উজ্জ্বলতায় ভরা তার ভাগ্য। তিনি নারী হয়েও প্রিয় রাসূল (সা) এর একজন উঁচু স্তরের সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। আবার অন্যদিকে ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সা) এর খাদেম আসাদ ইবনে মালিকের আপন ফুফু। এমনি একটি আলোকিত-গর্বিত পরিবার ও গোত্রের সন্তান আল হারেসা। সুতরাং তার জীবনটাকেও তিনি খুব সহজে রঙিয়ে নিতে পারলেন মায়ের দেখানো পথে। রাসূল (সা) এর ভালোবাসা ও আল্লাহর প্রেমের করুণার বৃষ্টিধারায় তিনি পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে নিলেন আপন আত্মা।

আব্বা সুরাকা, তার নসিব হয়নি ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হবার, কারণ রাসূল (সা) এর মদিনায় আগমনের আগেই তিনি ইন্তেকাল করেছিলেন। কিন্তু মা! তিনি রাসূল (সা) এর দাওয়াত পাওয়ার সাথে সাথেই ইসলাম গ্রহণ করলেন। সাথে আদরের সন্তান আল হারেসাও। মা এবং ছেলে দুজনই কী অসীম সৌভাগ্যের অধিকারী!

সময় গড়াতে থাকলো কালের পিঠে। সে যেন বাতাসের ঘোড়া। নাকি অন্য কিছু? থামে না সময়, কেবলই বয়ে চলে কলকল করে। ক্রমাগত সামনের দিকে। সময়ের হাত ধরে এক সময় এসে গেল বদর যুদ্ধ। বদর মানেই তো মুসলমানদের জন্য এক কঠিন পরীক্ষার ক্ষেত্র। বদর মানেই তো আগুনের পর্বত, কিংবা উত্তপ্ত লাভাস্তূপ। এই বদর যুদ্ধে সোৎসাহে অংশ নিলেন আল হারেসা। রাসূল (সা) তিনিই এই যুদ্ধের মহান সেনাপতি। মহান সেনাপতির ছায়াতলে একজন দৃঢ়চিত্ত সৈনিক আল হারেসা। তিনিও যাচ্ছেন বদর প্রান্তরে। মহান সেনাপতির নির্দেশ লাভের পরই আদৌ দেরি না করে তিনিই সর্বপ্রথম উঠে বসলেন ঘোড়ার পিঠে। চলতে শুরু করলেন বদর অভিমুখে। তাজি ঘোড়ার পিঠে দুঃসাহসী সৈনিক আল হারেসা। ঘোড়া ছুটছে দুরন্ত গতিতে। টগবগিয়ে। ঘোড়া দুরন্ত পায়ে উড়ছে পথের ধুলো। মরুভূমির সাদ সাদা বালুর মেঘ। প্রমাগত এগিয়ে চলছেন ঘোড়ার পিঠে এক অসীম সাহসী যোদ্ধা আল হারেসা। সঙ্গে আছেন স্বয়ং সেনাপতি রাসূল মুহাম্মাদ (সা)। রাসূল (সা) হারেসাকেই তাঁর তত্ত্বাবধায়ক ও পর্যবেক্ষক হিসেবে সঙ্গে করে রেখেছেন।

নিজস্ব দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সদা সতর্ক আল হারেসা। কী সৌভাগ্যবান তিনি! কী বিশ্বস্ত এবং দায়িত্ববান! যার কারণে এই কঠিনতম বদর যুদ্ধের যাত্রা পথে রাসূল (সা) এর তত্ত্বাবধায়কের মত গুরুদায়িত্বে অভিষিক্ত হতে পারলেন! এ ছিল রাসূল (সা) পক্ষ থেকে পাওয়া হারেসার জন্য এক বিশাল পুরস্কার, যা পৃথিবীর অন্য কোনো সম্পদ কিংবা সম্পদের সাথে তুলনা করা যায় না। সত্যি, একমাত্র আল্লাহর রহমত, রেজামন্দি, মঞ্জুর ও রহমত ছাড়া এ ধরনের সৌভাগ্য অর্জনও সম্ভবপর হয় না।

শুকরিয়া আদায় করলেন আল হারেসা। হৃদয়ের সকল আকুতির আর অনুভূতি ও আবেগ নিয়ে হাত উঠালেন প্রভুর দরবারে। আল্লাহপাক তার হৃদয়কে প্রশস্ত এবং শীতল করে দিলেন। রাসূল (সা) তো সাথেই আছেন। সুতরাং তার আর কিসের ভয়? না, কোনো শঙ্কা কিংবা পরওয়া নয়। বদর অভিমুখে রাসূল (সা) সঙ্গে হারেসা এগিয়ে চলেছেন ক্রমাগত। চলতে চলতে এক সময় তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লেন আল হারেসা। বুকে আছে ঈমানের তেজ। হৃদয়ে আল্লাহ ও রাসূল (সা) প্রেমের সুবাতাস। মাথার ওপরে আছে রহমত ও বরকতের ছায়া। তবু, তবুও তৃষ্ণার্ত তিনি। তৃষ্ণার্ত- কারণ, তিনি তো মানুষ। জাগতিক প্রয়োজন ছাড়া কি কোনো মানুষ বাঁচতে বা চলতে পারে? চলা সম্ভবও নয়। মানুষ হিসাবে যা যা দুনিয়ায় প্রয়োজন হয়, তা তো পূরণ করতেই হয়। যেমন ক্ষুধা লাগলে খেতে হয়। পিপাসা পেলে পানি পান করতে হয়। এই প্রয়োজন কখনোই মানুষের পিছু ছাড়ে না। আল হারেসাও দারুণ পিপাসার্ত হয়ে উঠলেন। পিপাসায় তার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। তার এখন পানির প্রয়োজন। তিনি নামলেন ঘোড়ার পিঠ থেকে। তারপর দ্রুত গতিতে চলে গেলেন একটি ঝরনার কাছে। ঝরনা! কী মোহময় ছন্দে ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে ঝরনার পানি। আহ! কী চমৎকার! কী স্বচ্ছ! বুকটা জড়িয়ে যাচ্ছে আল হারেসার। তিনি পানি পান করছেন ঝরনা থেকে। আর তখন, ঠিক তখনই- একটি তীর এসে বিঁধে গেল তার শরীরে! পাপিষ্ঠ হিব্বান ইবন আরাফার নিক্ষিপ্ত তীর। তীরবিদ্ধ অবস্থায় ছটফট করছেন আল হারেসা। গড়িয়ে পড়লো তার হাতে ভরা ঝরনায় সুপেয় স্বচ্ছ তৃষ্ণার পানি। গড়িয়ে পড়লেন তিনি নিজেও। আর মুহূর্তেই নিস্তেজ হয়ে পড়লেন আল হারেসার শরীর। জাগতিক পিপাসা নিটলো না তার। পানির তৃষ্ণা থাকলেও সবচেয়ে বড় যে পিপাসা, সেই শহীদ হওয়ার পিপাসা ও তৃষ্ণা মিটিয়ে দিলেন মহান রাব্বুল আলামীন। তিনি শহীদ হলেন। আনসারদের মধ্যে আল হারেসাই প্রথম শহীদ। সুতরাং এখানেও রয়ে গেল তার অনন্য মর্যাদার আসন।

এমনি এক মহান মা রাবী, যিনি তার ছেলে আল হারেসাকে ভালোবাসতেন অত্যাধিক। তিনি ছিলেন রাসূল (সা) এর খাদেমের ফুফু। তার সেই সোনার ছেলে শহীদ হলেন! বদর থেকে মদিনায় ফিরে এলেন সেনাপতি রাসূল (সা)। রাসূলের (সা) ফিরে আসার খবর শুনেই তাঁর কাছে ছুটে গেলেন মা রাবী। রাসূলকে কাঁদোস্বরে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার ছেলে হারেসাকে আমি কতটা ভালোবাসি, তা আপনি জানেন। সে শহীদ হয়েছে। তাতে আমি খুশি। কিন্তু আমার আশঙ্কা দূর না হওয়া পর্যন্ত আমি কিছুতেই শান্তি ও স্বস্তি পাচ্ছি না। বলুন, বলুন হে দয়ার নবীজী (সা), আমার হারেসা কি জান্নাতের অধিকারী হয়েছে? যদি তা হয়, তাহলে আমি সবর করবো হাসিমুখে। ভুলে যাব আমার শোক-তাপ। আর যদি সে জান্নাতী না হতে পারে, তাহলে দেখবেন, আমি কি করি!”

রাসূল (সা) খুব মনোযোগের সাথে শুনলেন হারেসার মা রাবীর কথা। তারপর তিনি বললেন, “এসব কি বলছো তুমি? জান্নাতের সংখ্যা তো একটু দুটো নয়। জান্নাতের সংখ্যা অনেক। আর তোমার কলিজার টুকরো আল হারেসা সর্বশ্রেষ্ঠ জান্নাত আল-ফেরদৌসের অধিকারী হয়েছে।”

সত্যিই! রাসূলের (সা) মুখে ছেলের এই সুখবর শুনেই আনন্দে আত্মহারা মা। তারপর মৃদু হাসতে হাসতে উঠে গাঁড়ালেন। আর তখন তার মুখ থেকে উচ্চারিত হলো, “সাবাশ! সাবাশ! সাবাশ হে আল হারেসা!” মায়ের হৃদয়ের পুঞ্জিভূত কষ্ট মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল। ছেলের সাফল্যে মায়ের বুকটা আরব সাগরের চেয়েও বিশাল হয়ে গেল। কেন হবে না! কম কথা নয়, তিনি এখন মর্যাদাসম্পন্ন একজন শহীদের গর্বিত মা। কী সৌভাগ্য তার!

আল হারেসারও আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল শহীদ হবার। শহীদের তৃষ্ণায় তিনি ছিলেন কাতর। একবার রাসূল (সা) সঙ্গে পথে দেখা হলো হারেসার। রাসূল (সা) জিজ্ঞেস করলেন, “হারেসা! আজ তোমার সকাল কেমন হলো?” হারেসা বললেন, “এমন অবস্থায় যে, আমি একজন খাঁটি মুসলমান।” রাসূল (সা) বললেন, “একটু ভেবে বলো, হারেসা। প্রত্যেকটি কথার কিন্তু গূঢ় অর্থ থাকে।” আল হারেসা বিনম্র এবং প্রশান্ত কণ্ঠে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! ‍দুনিয়া থেকে আমি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। আমার রাত কাটে ইবাদাত-বন্দেগীতে। আর দিন কাটে রোযা রেখে। বর্তমান মুহূর্তে আমি যেন নিজেকে আরশের দিকে যেতে দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে জান্নাতীরা জান্নাতের দিকে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামের দিকে চলছে।”

আল হারেসার এই কথা শুনে রাসূল (সা) বললেন, “আল্লাহ পাক যে বান্দার অন্তরকে আলোকিত করেন, সে অন্তর আর আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না।” আল হারেসা প্রাণপ্রিয় রাসূল (সা) এর কাছে আরজ করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি আমার শাহাদাতের জন্য একটু দোয়া করুন। শাহাদাতই আমার একান্ত তৃষ্ণার পানি। হৃদয়ের একান্ত আরাধ্য বিষয়।”

আল হারেসার তৃষ্ণা এবং হৃদয়ের আকুতি দেখে খুশি হলেন দয়ার নবীজী (সা)। তিনি সত্যিই দোয়া করলেন হারেসার শাহাদাতের জন্য। রাসূল (সা) এর দোয়াতে, বৃথা যায় না কিছু। মহান রাব্বুল আলামীন কবুল করলেন তাঁর হাবীবের দোয়া। কবুল করলেন আল হারেসার পিপাসিত কামনাও। অতঃপর শহীদ হলেন তিনি বদরে। আর শাহাদাতের মাধ্যমে পেয়ে গেলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, মহান এবং বিরল এক পুরষ্কার।

মূলত, শাহাদাতের পিপাসার কাছে অতি তুচ্ছ জাগতিক পিপাসা কিংবা ঝরনার পানি। আল হারেসা! তিনি পিপাসা মেটাবার জন্য গিয়েছিলেন ঝরনার কাছে। হাতে তুলে নিয়েছিলেন তৃষ্ণার পানি। কিন্তু ঝরনাও হার মানলো। হার মানলো আল হারেসার শাহাদাতের সুতীব্র পিপাসার কাছে। এক সম্মানিত মেহমান এসেছিলেন পিপাসা মেটানোর জন্য ঝরনার কাছে। কিন্তু পারলো না সে! পরাস্ত হলো ঝরনা। ঝরনা কাঁদে না তবুও, সে কেবল অপলক চেয়ে থাকে এক সাফল্যের দ্যুতি জোতির্ময় নক্ষত্রের দিকে। তিনি, সেই নক্ষত্রটি আর কেউ নন- আল হারেসা। এমনি হয়। আল্লাহ পাক যাকে কবুল করেন, পৃথিবীর সকল কিছুই পরাস্ত হয়ে যায় তার কাছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

মুগীরা ইবন শু’বা (রা)

নাম আবু আবদিল্লাহ মুগীরা, পিতা শু’বা ইবন আবী আমের। আবু আবদিল্লাহ ছাড়াও আবু মুহাম্মাদ ও…

সাপের তওবা

একটি সাপের ঘটনা বর্ণনা করছি। আমার কাছে যারা তালীম গ্রহন করতে আসে প্রথমেই আমি কাউকে…

আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহ আস-সাহমী-(রা)

আবু হুজাফাহ আবদুল্লাহ নাম। পিতার নাম হুজাফাহ। কুরাইশ গোত্রের বনী সাহম শাখার সন্তান। ইসলামী দাওয়াতের…