ফেরিওয়ালা বাহরাম

 

অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক ফেরিওয়ালা ছিল। তার স্ত্রীর সবেমাত্র এক সন্তান হলো, পুত্রসন্তান। ফেরিওয়ালা তার পুত্র সন্তানের নাম রাখলেন বাহরাম। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপারটি হলো ছেলেটি শৈশবেই তার ফেরিওয়ালা বাবাকে হারালো। সে কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হলো বাহরামের মাকে। এতো কষ্টের পরও বাহরামের মা চেয়েছিল সন্তানকে উপযুক্ত মানুষ বানাতে। কী করে ছেলেটাকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, কী করে তাকে দায়িত্ব সচেতন করে তোলা যায়-সে ব্যাপারেই ছিল মায়ের সকল চিন্তা ভাবনা।

 

এভাবে কেটে গেল বহু বছর। বাহরামের বয়স গিয়ে দাঁড়ালো ষোলো বছরে। বাহরামের বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের মধ্যে তেমন কিছুই ছিল না। মায়ের সম্পদ বলতে ছিল শুধুমাত্র চা বানানোর রূপালী রঙের একটি সামোভার।

সামোভার হলো চায়ের এমন এক পাত্র যার একদম ওপরে থাকে ছোট্ট একটি পাত্র, তাতে অল্প পানিতে চা পাতা সিদ্ধ হয়ে কড়া রঙ ধারণ করে। আর মূল পাত্রে থাকে পানি। বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস যার সাহায্যেই হোক না কেন পাত্রের পানি ফুটে গরম হয়। ঐ পাত্রে একটি ছোট্ট ট্যাপ থাকে। চা খেতে হলে গ্লাসে বা কাপে ঐ ট্যাপ থেকে পানি ঢেলে সামোভারের ওপরে রাখা ছোট্ট পাত্রের গাঢ় রঙের লিকার থেকে খানিকটা মিশিয়ে নিতে হয়। যে যেমন রঙের চা খেতে অভ্যস্ত সেই পরিমাণ লিকার পানিতে মিশিয়ে খেতে হয়। এই হলো সামোভার।

 

 

তো এই সামোভার ছাড়া বাহরামের মায়ের সম্পদ বলতে আর ছিল ছোট্ট একটি ঘর। মা তাঁর সম্পদের একাংশ অর্থাৎ রূপালী সামোভারটি বাজারে নিয়ে গেল। কয়েকটি দোকানে মুলামুলি করে শেষ পর্যন্ত তিনি সামোভারটি তিন শ দেরহামে বিক্রি করে দিলেন। ঐ তিন শ দেরহাম থেকে এক শ দেরহাম বাহরামের হাতে দিলেন। হাতে দিয়ে সুন্দর করে বললেন তোমার বাবা ছিলেন ফেরিওয়ালা। ফেরিওয়ালা মানে হলো বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র বিক্রি করার কাজ। তো তুমি এই টাকাটা দিয়ে কিছু রেশমগুটি কিনবে এবং সেগুলো তোমার বাবার মতো বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বিক্রি করবে।

 

বাহরামের মা আসলে চেয়েছিল তার ছেলেও যেন বাবার পেশা গ্রহণ করে এবং এ কাজে দক্ষ হয়ে ওঠে। বাহরাম মায়ের কথা অনুযায়ী টাকাটা নিয়ে বাজারে গেল। রেশম গুটি কেনার জন্যে যখন এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ঘুরাঘুরি করছিল তখন তার নজরে পড়েছিল তিনটি যুবককে।

তারা গাধার পিঠে যে রকম ঝাঁপি রাখা হয় সে রকম একটি ঝাঁপিতে একটি বেড়ালকে ঢুকিয়ে লাঠি দিয়ে ঐ প্রাণীটাকে পেটাচ্ছিল। যুবকদের এ কাণ্ড দেখে বাহরাম সামনে এগিয়ে গেল। সে তাদেরকে বললোঃ তোমরা এই নিরীহ প্রাণীটাকে কেন শুধুশুধু মারছো? যুবকরা বাহরামের কথা শুনে খিলখিল করে একরকম উপহাসের হাসি হাসলো। হাসতে হাসতে বাহরামকে বললোঃ তোমার কি খুব খারাপ লাগছে? যদি একটা বেড়ালের জন্যে তোমার এতোটাই খারাপ লেগে থাকে, যদি ওর জন্যে তোমার হৃদয় পুড়ে থাকে তাহলে এক কাজ করো! আমাদের এক শ দেরহাম দাও! আমরা বেড়ালটাকে আর মারবো না, ছেড়ে দেব।

 

বাহরাম মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। একদিকে নিরীহ একটি প্রাণীর মুক্তি। অপরদিকে তার জীবন জীবিকার যোগান, মায়ের দেওয়া আমানত। বাহরাম চিন্তা করতে করতে যুবকেরা বেড়ালটাকে আরো বেশি পেটাচ্ছিল। বেড়ালটা মিউ মিউ করে চীৎকার করছিল। বাহরামের আর সহ্য হচ্ছিল না। সে মায়ের দেওয়া এক শ দেরহাম যুবকদের হাতে দিয়ে বেড়ালটাকে মুক্ত করে দিলো। বেড়ালটা বিচ্ছুদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে বাহরামের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে বাহরামকে বললো- ‘দয়া এবং ভালোবাসার কথা কখনো ভোলা যায় না।’ এই বলেই বেড়ালটা দুষ্ট ছেলেগুলোর কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচলো।

 

বাহরাম শেষ পর্যন্ত খালি হাতেই ঘরে ফিরে গেল। মা যখন কারণ জানতে চাইলো, বাহরাম সব কথা মাকে খুলে বললো। পরদিন সকালবেলা মা আরো এক শ দেরহাম দিলো বাহরামকে। বললো রেশম গুটি কিনে নিয়ে আসবে। বাহরাম যথারীতি আজো বাজারে গেল। কিন্তু আজো সে দেখলো কটা ছেলে একটা কুকুরকে জ্বালাতন করছে। কুকুরটা কষ্টে কাতরাচ্ছে। বাহরাম রেগেমেগে চীৎকার করে বললো-কেন কুকুরটাকে পেটাচ্ছো তোমরা। ছেড়ে দাও! দুষ্ট ছেলেরা বললোঃ কেন, তোমার খারাপ লাগছে বুঝি! বেশি খারাপ লাগলে এক শ টা দেরহাম দাও, আমরা কুকুরটাকে ছেড়ে দেবো।’ বাহরাম নিরূপায় হয়ে তাই করলো। কুকুরটা মুক্তি পেয়ে বাহরামের দিকে তাকিয়ে বললো-“যে হাতে দেবে, সে হাতেই নেবে”। এই বলে কুকুরটা দ্রুত চলে গেল।

 

 

বাহরাম আজো খালি হাতে বাসায় ফিরে মাকে ঘটনা খুলে বললো। পরদিন সকালবেলা মা বাহরামের হাতে আরো এক শ দেরহাম দিয়ে বললোঃ বাবা! এটাই আমাদের শেষ সম্বল। এই টাকাটা নিজেদের মুক্তির জন্যে খরচ করো’। বাহরাম টাকাটা নিয়ে আজো বাজারে গেল। বাজারে গিয়ে রেশম গুটি খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে গেল। রাত হয়ে গেল, তবু রেশম গুটি মিললো না। এই দোকান সেই দোকান খুঁজে খুঁজে একেবারে বাজারের শেষ প্রান্তে গিয়ে পৌঁছলো। ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে এক কোণে খানিক বিশ্রাম নিতে বসলো। হঠাৎ তার নজরে পড়লো কয়েকজন লোক একটা বস্তা নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

 

কেউ কেউ আগুন জ্বালালো। তাদের একজন চেয়েছিলো বস্তাটাকে আগুনে ফেলে দিতে। বাহরাম তখন বললোঃ বস্তার ভেতরে কী? তারা বললোঃ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, নরম শরম এবং বিভিন্ন রঙের একটি সুদর্শন প্রাণী।’ বাহরাম বললোঃ এটা গুনাহের কাজ। বস্তাটা খুলে প্রাণীটাকে ছেড়ে দাও, ও চলে যাক। এভাবে তাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরো না। যারা আগুন জ্বালিয়েছিল, তাদের একজন বললোঃ এক শ দেরহাম দাও, মারবো না, ছেড়ে দেবো।

বাহরাম অগত্যা নিজের শেষ সম্বল এক শ দেরহাম দিয়ে প্রাণীটাকে বাঁচালো। বস্তাটা নিয়ে সে মরুভূমির দিকে চলে গেল। বস্তার মুখ খুলতেই বাহরামের অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেল।

 

বস্তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো প্রকাণ্ড একটা সাপ। বাহরাম ভয়ে জবুথবু হয়ে পেছনের দিকে যেতে চাইলো। কিন্তু সাপ বলে উঠলোঃ পালাচ্ছো কেন? তুমি না আমাকে বাঁচিয়েছো! এসো আমরা বন্ধু হই।

বাহরাম বিচিত্র শঙ্কা আর চিন্তিত মনে বসে পড়লো। যেহেতু সে সাপের মুক্তির জন্যে সব টাকা খরচ করে ফেলেছিল,সেহেতু সে ভেবে কূল পাচ্ছিলো না মাকে গিয়ে কী বলবে। সাপ জিজ্ঞেস করলোঃ কীসের জন্যে দুশ্চিন্তা করছো? বাহরাম সবকথা খুলে বললো। সাপ বললোঃ আমার সাথে এসো! আমার বাবা সাপের রাজা। আর আমি একমাত্র শাহজাদা। তুমি আমার বাবাকে আমার মুক্তির কথা খুলে বলবে। বাবা যদি তোমাকে পুরস্কার দিতে চায়, বলবে-আমি হযরত সোলায়মানের আংটিটা চাই।

 

এই বলে শাহজাদা বাহরামকে একটা গুহায় নিয়ে গেল। বাহরাম সাপের রাজাকে সব ঘটনা খুলে বললো এবং রাজা কী পুরস্কার চাও, জানতে চাইলে বাহরাম সোলায়মানের আংটি চাইলো। সাপের রাজা বললোঃ এই আংটি যদি কোনো খারাপ লোকের হাতে যায় তাহলে পৃথিবীটাকে নরক বানিয়ে ছাড়বে। শাহজাদা বললো বাহরাম খুবই ভালো মানুষ, সমস্যা নেই। সাপের রাজা আংটিটা বাহরামকে উপহার দিলো। বাহরাম আংটিটা নিয়ে রাজাকে ধন্যবাদ জানালো। শাহজাদা বাহরামকে শহর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললোঃ এই আংটিটা ডান হাতের মাঝের আঙুলে পরিয়ে বাম হাতটা যখনই আংটির পাথরের ওপর রাখবে, আংটির গোলাম তোমার সামনে হাজির হয়ে যাবে। তুমি তখন যা চাইবে তাই সে তোমার জন্যে নিয়ে আসবে।#

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!