কবরস্থানের রহস্য

ছোটবেলা থেকেই ব্যাখ্যার অতীত বিষয়সমূহ নিয়ে আমার সীমাহীন আগ্রহ ছিল। এসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে আমার কোনো ক্লান্তি নেই। তাই রহস্যের খোঁজ পেলে আর দেরি করি না, ছুটে যাই ঘটনাস্থলে। আর এ ধরনের ঘটনা সংগ্রহের জন্য নানা ধরনের লোকের সাথেই কথা বলতে হয়। এবারও তেমনি এক লোকের সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ এসেছে। লোকটির নাম করিম মিয়া। তিনি মৃত মানুষের জন্য কবর খোঁড়া এবং দাফন কাজ সামলান। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি এ কাজ করে আসছেন। আর আমি যে ধরণের গল্পের জন্য হয়রান, সেই ধরনের ঘটনা তার জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়।

গত বছর আমার এক আত্মীয়ের লাশ দাফনের সময় তার সাথে পরিচয় হয়। তখন তার মুখে বেশ কিছু কাহিনী শোনা যায়। যদিও তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক কাহিনী সে সেদিন বলতে চায়নি, অনেক জোর করার পরও। আমি আমার মোবাইল নম্বর তাকে দিয়ে আসি এবং প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে বলি। এর মাঝে কেটে গেছে অনেকদিন। তার কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। হঠাৎ গতকাল অচেনা একটি নম্বর থেকে ফোন পেলাম। হুম, সেই লোকের ফোন! তার চেয়ে বড় কথা, তিনি তার ঘটনাটি আমাকে বলতে চান। এই ঘটনা কাউকে না বলে নাকি তিনি শান্তি পাচ্ছেন না। তাছাড়া অন্য কেউ এই ঘটনা বিশ্বাসও করবে না।

পরদিন দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। করিম মিয়া বলল যে কবরস্থানে তিনি এ ঘটনার শিকার, তাই সেখানেই তিনি কাহিনী বলতে চান। আর সময়টাও রাতে হলে তার জন্য ভালো হয়। আমার কোনো আপত্তি ছিল না। সময় ঠিক করলাম রাত ১২ টা। আমি পৌঁছে গেছিলাম সময় মতো। কবরস্থানের একটু সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেশ রাত, আর জায়গাটাও কেমন নির্জন। তাই একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। যদিও সেসবে পাত্তা দিলাম না।

একটু পর ধীর পায়ে কারও এগিয়ে আসার শব্দ পেলাম। হ্যাঁ, করিম মিয়াই হবে। ছোটখাটো গড়নের করিম মিয়া ধীর পায়ে এগিয়ে আসছিল। কাছে এসে বলল,
“ভাইসাব, একটু দেরি কইরা ফেললাম।”

এই বলে আমাকে নিয়ে কবরস্থানের একটু সামনে বসার মতো একটি জায়গায় বসে পড়ল। কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই সে তার কাহিনী শুরু করল।

করিম মিয়ার ভাষায়:

সেদিন ছিল পূর্ণিমা। চাঁদের পূর্ণ আলোয় সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। আমি আর আমার নিত্যদিনের সঙ্গী জহির মিলে একটি কবরে বেড়া লাগানোর কাজ শেষ করে বাসার দিকে রওনা হলাম। কবরস্থানের গেটের কাছে এসে দেখলাম দুইজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পরনে সাদা পাঞ্জাবী, মুখে শুভ্র দাড়ি। তাদের হাতে একটি লাশ কাফনে মুড়ানো। দেখে বুঝলাম, কোন বাচ্চার লাশ হবে। তারা বলল, লাশ দাফন করতে হবে।

আমি বললাম, লাশ দাফনের আগে স্থানীয় হুজুরের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। আমি লোক দুজনকে দাঁড়াতে বললাম। হুজুরের বাসা সামনেই। আমি আর জহির হুজুরের বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। যাওয়ার সময় দেখেছিলাম, লোক দু’টি গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে। হুজুরের সঙ্গে কথা হল। তিনি আমাদেরকে কবরস্থানে গিয়ে দাঁড়াতে বললেন। তিনি কিছুক্ষণ পর এসে লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলবেন। আমরা আবার ফিরে চললাম। রাত তখন আরও গভীর। চারপাশ চাঁদের আলোয় ভিন্ন রূপে দেখা দিচ্ছিল।

কবরস্থানের গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিন্তু সেই দুই লোককে কোথাও দেখতে পেলাম না। একটু অবাক হলাম। জহির গেট খুলে কবরস্থানের ভিতরে ঢুকল। আমি বাইরেই খুঁজতে লাগলাম তাদের। তাদের তো ভিতরে ঢুকার কথা নয়। অনেক খুঁজেও না পেয়ে ধীর পায়ে কবরস্থানের ভিতরে ঢুকলাম।

সেই সময় জহিরের বিকট চিৎকার শুনলাম। একটি চিৎকারই কানে আসল। দৌড়ে গেলাম চিৎকার লক্ষ্য করে। কিছুদূর যাওয়ার পর চোখের সামনে যে দৃশ্য দেখলাম, তাতে সর্বাঙ্গে কাঁপন ধরল।

সেই লোক দুটির হালকা অবয়ব চোখে পড়ছিল। তারা পেছন দিকে মুখ করে আছে। তাদের হাতে সেই বাচ্চার কাফনে মোড়া লাশ। লাশের উপরের দিকে কাপড় ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। মাথাটা আলগে ধরে, দু’জনে মিলে গভীর আগ্রহে লাশটিকে নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে।

তাদের মুখ থেকে একধরণের জান্তব এবং উল্লাসিত গোঁ গোঁ জাতীয় আওয়াজ ভেসে আসছিল। পাশে পড়েছিল জহিরের নিথর দেহ। প্রাণ আছে কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। এসব দৃশ্য আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না।

অবস্থা এমন যে অজ্ঞানও হতে ভুলে গেছি। মনে হচ্ছিল দাঁড়িয়েই মৃত্যু ঘটবে। আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের গভীর আওয়াজে হঠাৎ সেই জন্তুগুলো ঘুরে তাকাল আমার দিকে।

সে এক অদ্ভুত, ভয়ংকর চেহারা। ঘাড়ের উপর গোলাকার এক মাংসের স্তূপ। সেখানে চোখ, নাক, ঠোঁটের কোনো অস্তিত্ব নেই। ঘাড়ের উপরে মাংসের পিণ্ডটি অনেকটা তরলজাতীয়, কেঁপে উঠছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল; চোখহীন অথচ ভয়ানক প্রখর দৃষ্টি, মুখে সূক্ষ্ম হাসির রেখা।

সহ্য করা সম্ভব হলো না। নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়লাম মাটিতে। এরপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে হাসপাতালে দেখলাম। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন সেই হুজুর। জহিরকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তাদেরকে আমি কিছু জানাইনি। শুধু বলেছি ভয়ংকর কিছু ঘটেছিল। হুজুর আর আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি।

এই ঘটনা আর কাউকে বলতে পারিনি। আজ আপনাকে বলে স্বস্তি পেলাম। ঘটনা শুনতে শুনতে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছিলাম। বড় একটি নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম,
“বড় অদ্ভুত কাহিনী, ঠিক বিশ্বাস হয় না।”

করিম মিয়া হেসে উঠে বলল,
“না হইলেই ভালো। অনেক রাত হয়ে গেছে, আপনার ফিরা উচিত।”

তার এ কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। সত্যিই অনেক রাত। উঠে দাঁড়ালাম; ফিরতে হবে। করিম মিয়া বলল,
“যাই তাহলে।”

আপনার সাথে পরে একদিন এই বিষয়ে আরও কথা বলব। উঠে দাঁড়াতেই মোবাইল বেজে উঠল। অচেনা একটি নাম্বার থেকে কল। কল ধরতেই পরিচিত একটি কণ্ঠ বলল,
“ভাইজান! বড় বিপদে পইরা গেছি। আজকে আর আসতে পারলাম না! ঘটনা হইছে কি? ঘটনা কি?”

মোবাইল মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। আমার বিস্মিত চোখ করিম মিয়ার দিকে। করিম মিয়া ধীরে ধীরে মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। তার ঘাড়ের উপর মাংসের দলা কিলবিল করছে। মুখে অপার্থিব এক ব্যঙ্গের হাসি, চোখহীন অথচ তীব্র এক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!