মিৎসুতারো ইয়ামাওকা
মিৎসুতারো ইয়ামাওকা (জাপানি: 山岡光太郎; ৭ মার্চ ১৮৮০ – ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯):
মিৎসুতারো ইয়ামাওকা যিনি উমার ইয়ামাওকা (জাপানি: ウマル・ヤマオカ) নামেও পরিচিত, একজন জাপানি ইসলামিক ও ইহুদি পণ্ডিত ছিলেন, এবং মক্কার প্রথম জাপানি তীর্থযাত্রী হিসেবে পরিচিত। ইয়ামাওকা জাপানের হিরোশিমা প্রদেশের ফুকুয়ামায় জন্মগ্রহণ করেন।ইয়ামাওকা টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে রুশ ভাষা অধ্যয়ন করেন। তিনি রুশ-জাপানি যুদ্ধে সামরিক স্বেচ্ছাসেবক হন এবং ১৯০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। ইসলাম গ্রহণের আগে মিৎসুতারো ইয়ামাওকার জীবন ছিল একজন উদ্যমী ও শিক্ষিত জাপানি যুবকের জীবন। তার এই ভাষা শিক্ষার পটভূমিতে ছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক দক্ষতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা, যা পরবর্তী সময়ে তাকে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে পরিচয় করিয়ে দেয়। ১৯০৫ সালে রুশ-জাপানি যুদ্ধে সামরিক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগদান করে তিনি দেশের জন্য নিজের অবদান রাখেন। যুদ্ধের পরে ইয়ামাওকা রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯০৯ সালে তিনি ইসলামের ধর্মীয় নেতা ও দার্শনিক আবদুররেশিদ ইব্রাহিমের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ইসলামের প্রতি তার আগ্রহ ও বিশ্বাস গড়ে ওঠার পেছনে ইব্রাহিমের প্রভাব ও ধর্মীয় শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইসলাম গ্রহণ এবং তার পরবর্তী সময়:
ইসলাম গ্রহণের পর মিৎসুতারো ইয়ামাওকা একটি নতুন পরিচয়ে পরিচিত হন, এবং তার নামকরণ করা হয় উমার ইয়ামাওকা। ইসলাম গ্রহণের প্রাথমিক উদ্দীপনা আসে আবদুররেশিদ ইব্রাহিমের সাথে মুম্বাইয়ে তার সাক্ষাৎ থেকে, যেখানে ইব্রাহিম তাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পরামর্শ দেন। ইয়ামাওকা তার পরামর্শে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং এরপর ইব্রাহিমের সাথে পবিত্র মক্কায় হজ করতে যান। এই তীর্থযাত্রা তাকে মক্কার প্রথম জাপানি মুসলিম তীর্থযাত্রী হিসেবে পরিচিতি দেয়।মক্কা সফরের পর ইয়ামাওকা ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিভিন্ন ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করেন, যার মধ্যে ছিল আরারাত পর্বত, মদিনা, দামেস্ক, জেরুজালেম, কায়রো এবং ইস্তাম্বুল। তিনি এসব স্থান ভ্রমণের মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতির গভীর অধ্যয়নে মনোযোগী হন। জাপানে ফিরে আসার পর ইয়ামাওকা ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। তিনি ১৯১২ সালে 「アラビヤ縦断記」 (“অ্যারাবিয়ান লংগিটিউডিনাল রেকর্ডস”) নামের একটি বই প্রকাশ করেন, যেখানে তার তীর্থযাত্রা ও ইসলাম সম্পর্কে অভিজ্ঞতার বর্ণনা ছিল। এই বইটি মেইজি সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী শোকেনের কাছে উপস্থাপিত হয়েছিল। এছাড়াও, তিনি ইসলাম নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ লেখেন এবং কোরআনের কিছু অংশ অনুবাদ করেন।১৯২৩ সালে ইয়ামাওকা কায়রোতে এক বছর এবং ইস্তাম্বুলে তিন বছর কাটান। এই সময়ে তিনি ইসলামের আরো গভীর জ্ঞান অর্জন করেন এবং মুসলিম সমাজের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। ১৯২৭ সালে তিনি পুনরায় জাপানে ফিরে আসেন এবং ইসলাম সম্পর্কে তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রসারের জন্য কাজ করে যান। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে ইয়ামাওকা মৃত্যুবরণ করেন। তার এই জীবন ছিল এক মহান তীর্থযাত্রার প্রতীক, যেখানে তিনি একটি সংস্কৃতি ও ধর্ম থেকে আরেকটি সংস্কৃতি ও ধর্মে যাত্রা করে ইসলামের আদর্শকে নিজের জীবনে ধারণ করেছিলেন এবং এ সম্পর্কে জাপানে সচেতনতা সৃষ্টি করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ইসলামিক জীবনে তার অবদান:
ইসলাম গ্রহণের পর মিৎসুতারো ইয়ামাওকা, যিনি উমার ইয়ামাওকা নামে পরিচিত হন, জাপানে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ইসলামের প্রতি তার গভীর অনুরাগ ও ধর্মীয় জ্ঞানের বিস্তার তাকে ইসলামী পণ্ডিত এবং প্রথম জাপানি মুসলিম তীর্থযাত্রী হিসেবে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে।
ইয়ামাওকা তার অভিজ্ঞতা এবং ইসলামের প্রতি তার উপলব্ধি জাপানিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য 「アラビヤ縦断記」 (“অ্যারাবিয়ান লংগিটিউডিনাল রেকর্ডস”) নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইটি তার হজযাত্রার অভিজ্ঞতা, ইসলামের শিক্ষা, এবং বিভিন্ন ইসলামী ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনের বিবরণ দিয়ে সমৃদ্ধ। বইটি মেইজি সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞী শোকেনের কাছে উপস্থাপিত হয়েছিল এবং এটি জাপানে ইসলাম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সহায়ক ছিল। ইয়ামাওকা বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখে ইসলামের দর্শন, মূল্যবোধ ও ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করেন। তিনি কোরআনের কিছু অংশও অনুবাদ করেন, যা জাপানি পাঠকদের জন্য কোরআনের বাণী উপলব্ধি করার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। তার লেখালেখির মাধ্যমে অনেকেই ইসলামের শিক্ষার মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে জানার সুযোগ পান। ইয়ামাওকা কায়রো ও ইস্তাম্বুলে দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করেন এবং সেখানে স্থানীয় মুসলিম সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি বিভিন্ন মুসলিম পণ্ডিত ও আলেমের সাথে পরিচিত হন এবং তাদের কাছ থেকে ইসলামের উপর গভীরতর জ্ঞান অর্জন করেন। তার এই আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলি জাপানে ইসলাম প্রচারে সাহায্য করে এবং দুই দেশের মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরি করে। ইয়ামাওকা ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী সংস্কৃতির একটি সেতু তৈরি করেন, যা জাপানের জনগণের মধ্যে ইসলামের প্রতি আগ্রহ ও প্রশংসা বৃদ্ধি করে। তার লেখালেখি, বক্তৃতা এবং অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান ইসলামের প্রতি একটি ইতিবাচক ধারণা গড়ে তোলে এবং মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে জাপানিদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সহায়তা করে। ইয়ামাওকা মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অংশে যেমন মক্কা, মদিনা, দামেস্ক, কায়রো ও জেরুজালেমে সফর করে ইসলামিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং এটি জাপানে প্রচার করেন। তার এসব ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাকে ইসলামের নীতি ও মূল্যবোধকে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে এবং জাপানি সমাজে তা প্রভাবিত করতে সক্ষম হন।মিৎসুতারো ইয়ামাওকার ইসলামিক জীবনের এই অবদানসমূহ তাকে জাপানে একজন অগ্রগামী মুসলিম ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। তার প্রচেষ্টা শুধু তার নিজের জীবনেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং জাপানে এবং তার বাইরেও ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মধ্যে গভীরতর আগ্রহ ও বোঝাপড়া সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইয়ামাওকা ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।