জুযারের ভাইয়েরা তাকে নৌকায় ভাসিয়ে দিয়ে মাকে পিটিয়ে যাদুর জিন এবং স্বর্ণমুদ্রাগুলো নিয়ে নেয়। কিন্তু ওই জিন কাজে লাগাতে পারে না তারা বরং বাদশাইর কারাগারে বন্দী হয়ে যায়। এদিকে ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে হজ্বে গিয়ে আব্দুস সামাদের সাথে দেখা হয় জুযারের। জুযার তাকে সব খুলে বলে এবং আব্দুস সামাদ আবারো তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। তাকে একটা যাদুর আংটি দেয়। আংটিটা আঙুলে পরে রাদের ঘাড়ে চড়ে সে। রাদ তর্জন গর্জন করে উড়াল দিয়ে ঘণ্টাখানেক শূন্যে উড়ে জুযারের বাড়ির আঙিনায় তাকে নামিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
জুযার বাসায় পৌঁছেই সব ঘটনা শুনে যাদুর আংটির পাথরে হাত রাখলো। রাদ এসে হাজির হয়ে গেল। রাদকে বললো তার দু ভাই সেলিম সালেমকে হাজির করতে। মায়ের সামনেই মাটিতে ফাটল সৃষ্টি হলো। ঐ ফাটলে ঢুকে গেল রাদ। মুহূর্তের মধ্যে তাদের নিয়ে হাজির হয়ে গেল। মায়ের চোখে তো অবাক বিস্ময়। জুযারকে দেখেই ভাইয়েরা কান্নাকাটি করে তাদের অপকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলো। জুযার আবারো সেলিম সালেমকে ক্ষমা করে দিলো। জুযার বুঝতে পেরেছিলো তার যাদুর জিন এখন বাদশাইর কোষাগারে। সে রাদকে ডেকে বললো শাহের কোষাগারটি যেন নিয়ে আসে। রাদ তাই করলো। কোষাগার থেকে জিনটা নিয়ে নিলো জুযার। তারপর রাদকে বললো এমন একটা জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ বানাতে যেখান বহু খাদেম, পরিচারক, লস্কর থাকবে। রাদ নিমেষেই তা করে ফেললো। ওই প্রাসাদটি জুযারর তার মাকে উপহার দিলো।
এদিকে শাহের প্রাসাদের কোষাগারের দায়িত্বে যে ছিল সে পড়েছে বিপদে। কোষাগারে যখন দেখলো যাদুর জিন নেই সে চীৎকার করতে করতে শাহের কাছে গিয়ে কোষাগার যে শূন্য সে খবর জানালো। শাহ আদেশ দিলো সিপাহিদের হাজির করতে। হাজির করা হলো। কিন্তু কেউই এ ঘটনার কিছুই জানতো না, কেবল যে যাদুর জিনের ব্যাপারে আগে খবর দিয়েছিল সে ছাড়া। সে বললো: হে বাদশাহ! গতরাতে আমি একটা এলাকা পার হচ্ছিলাম। দেখলাম অনেক লোক একটা প্রাসাদ বানাচ্ছে। আজ দেখলাম প্রাসাদ তৈরি হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওই প্রাসাদের মালিক হলো জুযার নামের এক লোক। লোকটা নাকি বহুদিন ভ্রমণ করার পর বহু অর্থসম্পদ নিয়ে এসেছে। নিজের দুই ভাইকেও নাকি কারাগার থেকে মুক্ত করেছে।
বাদশাহ এই কথা শুনে চীৎকার করে বললো: আমার শত্রুকে আমি চিনতে পেরেছি। যে সেলিম এবং সালেমকে কারাগার থেকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছে, আমার কোষাগারও খালি করেছে, সে জুযার ছাড়া আর কেউ নয়। এরপর বাদশাহ জুযারকে ধরে আনার আদেশ দিলো।
বাদশার এক মন্ত্রী ছিল বেশ সচেতন এবং চালাক চতুর। সে বললো: যে এক রাতে প্রাসাদ বানাতে পারে অবশ্যই সে ভীষণ শক্তিশালী লোক। তাকে না ক্ষেপিয়ে বরং প্রাসাদে দাওয়াত করা উচিত। প্রাসাদে এলেই বোঝা যাবে সে দুর্বল নাকি শক্তিশালী। তার অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া ভালো।
এই বলে সাদা পোশাকধারী মন্ত্রী একাই জুযারের প্রাসাদে গেল।
জুযারের প্রাসাদে গিয়ে মন্ত্রী সালাম করলো। তার সালামের জবাব দিলো এক দারোয়ান। বললো: হে মানব সন্তান! তুমি কে, কী চাও?
মন্ত্রী দারোয়ানের মুখে ‘মানব সন্তান’ সম্বোধন শুনে ভয়ে কেঁপে উঠলো। বুঝতে পেরেছে যে দারোয়ানরা জিন। তাই শান্তভাবে বললো: আমি বাদশার মন্ত্রী। এসেছি তোমার মালিককে বাদশার দরবারে আমন্ত্রণ জানাতে।
দারোয়ান জুযারের অনুমতি নিয়ে মন্ত্রীকে নিয়ে গেল প্রাসাদের ভেতর। মন্ত্রী যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে জুযারকে বাদশার পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানালো। কিন্তু জুযার বললো: আমি বাদশার দরবারে যাবো না। আমার সাথে বাদশার কোনো কাজ থাকলে এখানে আসতে বোলো!
এরপর রাদ’কে হাজির করে বললো পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট জামাটি মন্ত্রীর জন্য আনতে। রাদ মুহূর্তের মধ্যেই নিয়ে এলো। মন্ত্রী ওই পোশাক পরে বাদশার কাছে গেল।
বাদশা মন্ত্রীর পোশাক দেখে আর জুযারের প্রাসাদের গল্প শুনে সিদ্ধান্ত নিলো নিজেই জুযারের সাথে দেখা করবে। সৈন্য সামন্ত নিয়ে বাদশা রওনা হলো। জুযার এই খবর শুনে রাদ’কে বললো প্রাসাদে জিন এনে ভর্তি করে ফেলতে। জিনদেরকে যুদ্ধের পোশাক পরাতে এবং সারিবদ্ধভাবে প্রস্তুত থাকতে।
বাদশা জুযারের প্রাসাদে এলো। জিন সেনাদের দেখে বাদশা বুঝতে পারলো জুযারের শক্তি তার চেয়ে অনেক বেশি।
জুযার তার প্রাসাদের ভেতর জাঁকজমকপূর্ণ আসনে বসে ছিল। সেলিম এবং সালেম তার দুই পাশে দুই মন্ত্রীর মতো দাঁড়িয়ে ছিল। বাদশা সামনে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলো। জুযার উঠে দাঁড়িয়ে বাদশার সালামের জবাব দিলো।
একেবারে বাদশাহী খাবারের আয়োজন করলো। মধ্যরাত পর্যন্ত তারা খেলো আর গল্প গুজব করলো। বাদশা যখন উঠতে চাইলো জুযার তখন বাদশার সেনাদেরকে দামি উপহার দিতে আদেশ দিলো। বাদশার সাথে খোদাহাফেজি করলো এবং আবার আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বাদশাকে বিদায় দিলো। বাদশা আবার আসবে বলে কথা দিলো এবং সত্যিসত্যিই এরপর বহুবার বাদশা জুযারের প্রাসাদে গিয়েছিল।
কিছুদিনের মধ্যেই বাদশার সাথে জুযারের বন্ধুত্ব বেশ গভীর হলো। কিন্তু বাদশা তখনো জুযারের শক্তিকে ভয় করতো। একদিন তার মন্ত্রীকে ডেকে বললো: হে মন্ত্রী! আমি ভয় পাচ্ছি জুযারের মনে আমার প্রতি কোনো ক্ষোভ দ্বেষ আছে কিনা; আমাকে মেরে সে নিজে আমার আসন দখল করে কিনা।
মন্ত্রী বললো: আপনি যদি এই আশঙ্কাই করেন তাহলে আপনার মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দিয়ে দিন, ঝামেলা চুকে যাবে। আপনার জামাই হবে জুযার। আর কোনোদিন যদি সে মারা যায় আপনি হবেন তার সকল ধন সম্পদের মালিক।
কথাটা বাদশার মনোপুত হলো। রাজপ্রাসাদে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করে জুযারকে আমন্ত্রণ জানিয়ে কৌশলে বিয়ের ব্যবস্থা করলো। কিন্তু মন্ত্রী বাদশাকে বললো: মেয়ের জন্য প্রচুর পরিমাণ মোহরানা ধার্য করতে। শাহ তখন মেয়ের মোহরানা হিসেবে যাদুর জিনটা দাবি করলো। জুযার মেনে নিলো। এভাবে রাজকন্যাকে বিয়ে করে জুযার রাজার জামাই হয়ে গেল।
বেশ কিছুদিন পর বাদশাহ মারা গেল। জুযার তখন বাদশার আসনে আসীন হলো। সেলিম আর সালেমকে তার মন্ত্রী বানালো। জুযার ছিল ন্যায় পরায়ণ বাদশা। মানুষের কল্যাণ ছাড়া ক্ষতি করতো না। জনগণ ভীষণ খুশি ছিল তার রাজত্বে। তার জন্য সবাই দোয়া করতো। বছর খানেক এভাবে কাটার পর সেলিম ও সালেম জুযারকে মেরে যাদুর জিন, আংটি আর বাদশাহীর মালিক হতে ষড়যন্ত্র করলো। সালেম তার বাসায় জুযারকে দাওয়াত করে নিয়ে বিষাক্ত খাবার খাইয়ে জুযারেক মেরে ফেলে আংটিটা দখল করলো। সে রাদ’কে আদেশ দিলো সেলিমকে মেরে ফেলতে এবং দুই ভাইয়ের লাশ সেনা কমান্ডারের সামনে জাতীয় মর্যাদায় দাফন করতে। রাদ তা-ই করলো। সৈন্যরা এই ঘটনা দেখে ভয় পেয়ে গেল। সালেম নিজেকে বাদশা বলে ঘোষণা করলো এবং জুযারের স্ত্রীকে বিয়ে করতে চাইলো। কেউ তার বিরোধিতা করার সাহস করলো না।
এই ঘটনা জুযারের স্ত্রীর কানে পৌঁছার পর কিছুই বললো না সে। সালেম যখন স্ত্রীর প্রাসাদে গেল জুযারের স্ত্রী এক গ্লাস শরবত দিয়ে তাকে স্বাগত জানায়। সালেম ওই শরবৎ মজা করে খেয়ে দ্রুত মারা যায়। কারণ ওই শরবতেও বিষ মাখানো ছিল। সালেমের হাত থেকে আংটিটা খুলে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেয়। যাদুর জিনটাও দুই টুকরো করে ফেলে। তারপর দরবারের মুরব্বিদের ডেকে বলে: নতুন বাদশা মারা গেছে। আপনারা নতুন বাদশা নির্বাচন করুন।
এরপর জুযারের স্ত্রী কালো পোশাক পরে স্বামীর জন্য আজাদারিতে বসে পড়ে।#
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।