মহিলা বাসায় ফিরে দেখলো ঘরের দরোজা বন্ধ। বাড়ির ছাদে উঠে দেখলো তার স্বামী আর ছেলেরা খাবারের অভাবে এতোই কাহিল বা জবুথবু হয়ে পড়েছে যে নড়াচড়া করার শক্তিও তারা হারিয়ে ফেলেছে। যে গরুটা জবাই করেছিল তার গোশত শেষ হয়ে গেছে। এখন ঘরে খাদ্যবস্তু বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। না খেতে পেয়ে পেটের প্রচণ্ড জ্বালায় দুর্বল হয়ে পড়া তার সন্তানেরা এখন মৃত্যুর মুখে। মহিলা তার সন্তানদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। এমন সময় ছোট্ট ছেলে বলে উঠলো: হে খোদা! আমাকে খাবার দাও…! মহিলা সামান্য গোশত তার জন্য ফেললো। দ্বিতীয় ছেলে ওই গোশত দেখে মাথা উঠিয়ে বললো: হে খোদা! আমাকেও খাবার দাও…! মহিলা সামান্য গোশত তার জন্যও ফেললো। তৃতীয় সন্তান যখন দেখলো দু’ ভাইয়ের দোয়াই কবুল হয়েছে, সেও বললো: হে খোদা! আমাকেও খাবার দাও…! মহিলা সামান্য গোশত তার তৃতীয় সন্তানের জন্যও ফেললো।
এ অবস্থা দেখে মহিলার স্বামীও আল্লাহর কাছে খাবার চাইলো। মহিলা তখন ছাদের ওপর থেকে একটা ভারি ইট ছুঁড়ে মারলো। স্বামী বললো: এরকম রুযি চাচ্ছি না। অন্যদের মতো খাবার আমাকেও দাও। মহিলা এবার তার সন্তানদের বললো: দরোজা খোলো! বাচ্চারা তাদের মায়ের কণ্ঠ শুনে ভীষণ খুশি হয়ে গেল এবং তাড়াতাড়ি করে দরোজা খুলে দিলো। মহিলা ঘরে ঢুকলো। তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে সে বললো: আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়ে আস্ত একটা গরুর সমস্ত গোশত একা একাই তো খেলে, তাই না? পুরোটা শীতকাল পেরিয়ে গেছে। গরুর মাংসও শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি মরে যাই নি।
স্বামী জিজ্ঞেস করলো: তোমার দিনকাল কেমন কাটছে?
মহিলা বললো: বাসাবাড়ি ভালোই পেয়েছি, ভালোভাবেই জীবন কাটছে। তোমার জিনিসপত্র গুটিয়ে নাও, চলো সবাই একসাথে সেখানে যাবো।
মহিলা সমস্ত জিনিসপত্র তার স্বামীর ঘাড়ে চাপালো আর বাচ্চাদের হাত ধরে তাদের নিয়ে চললো গুহার দিকে। যেতে যেতে এক সময় গিয়ে পৌঁছলো গুহায়। গুহা দেখে সবাই অবাক। যা যা দরকার সবই আছে ওই গুহায়। চুলার ওপরেও বিশাল একটা পাতিল বসানো। মাংস পাক হচ্ছে ওই পাতিলে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ছোট্ট রাখাল তার মেষ পাল নিয়ে ফিরে এলো গুহায়। সবাই দেখলো মেষ, দুম্বা, উট, ছাগল, গরু যে যার মতো যার যার খোঁয়াড় বা গোয়ালে চলে গেল। আর রাখাল ছাগলের শিঙে চড়েই গুহার ভেতরে ঢুকলো। গুহায় মহিলার স্বামী ছেলে সন্তানদের দেখে ছাগলের শিঙ থেকে দ্রুত নেমে এলো নীচে। সবাইকে স্বাগত জানালো।
রাখাল লোকটি ছিল বেশ মহানুভব। সে মহিলার স্বামীকে নিজের পিতার মতো সম্মান দিলো আর তাদের সন্তানদের নিজের ভাইয়ের মতো আপন করে নিলো। ছেলেদেরকে প্রতিদিন সে তার সঙ্গে নিয়ে যেত চারণভূমিতে। স্বামী স্ত্রী গুহাতেই থাকতো। তারা দু’জন মিলে গুহাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করতো। এভাবেই কাটছিল তাদের দিনকাল। মোটামুটি সবাই মিলে সুন্দরভাবেই বসবাস করছিল। একদিন রাখাল চারণভূমি থেকে ফিরে এসে বাবাকে বললো: তুমি বাদশার দরবারে যাও! বাদশার কন্যার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব দাও! বাবা কিছুই বললো না। মনে মনে ভাবলো এই ময়লা পোশাক-আশাক নিয়ে কী করে বাদশার দরবারে যাবে। আর এক বিঘৎ সমান একটা ছেলের জন্য কী করে বাদশার মেয়ের মতো সুন্দরী শাহজাদির বিয়ের প্রস্তাব দেবে।
কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। ছেলের দাবি, যেতেই হবে এবং কোমরে একটা শাল বেঁধে মাথায় রুমাল পরে রওনা হলো। শহরে পৌঁছে বাদশার প্রাসাদের ঠিকানাটা যার কাছেই জানতে চাইলো সে-ই হেসে উঠলো। কিন্তু সে কিছুতেই পিছ পা হলো না। প্রাসাদে গেলই সে। প্রাসাদের প্রহরীরা জিজ্ঞেস করলো: কী কাজ তোমার।
সে বললো: এসেছি বাদশার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। প্রহরী হাসি-ঠাট্টা করলো এবং পরে ঢুকতে দিলো ঠিকই। কিন্তু তাকে পদে পদে বাধা দিতে লাগলো। বাদশা এ অবস্থা দেখে প্রহরীদের বললো: ওকে বাধা দিও না, আসতে দাও! বেচারা হয়তো ভিক্ষা চাইতে এসেছে। দরবারে তাকে কেউই তেমন একটা পাত্তা দিলো না। কিন্তু বাদশা তাকে তার পাশে বসার জন্য ইশারা করলো। সে বসলো বাদশার পাশে। সবাই এখন হিংসায় জ্বলে যেতে লাগলো।
বাদশার আগন্তুকের সাথে আলাপ করে যখন বুঝলো সে এসেছে তার ছেলের সাথে শাহজাদির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, প্রথমে ভাবলো এমন আচরণ করতে যাতে সবাই হাসে। কিন্তু তা না করে বাদশা বললো: এক শর্তে হতে পারে। শর্তটা হলো: ছেলের ঘর থেকে এই প্রাসাদ পর্যন্ত কালো হাঁটু বিশিষ্ট উটের লাইন থাকবে এবং প্রত্যেকটি উটের পিঠে থাকতে হবে স্বর্ণ রূপাভর্তি ভাণ্ডার। কাল্লেগাগের বাবা শর্ত মেনে নিলো এবং প্রাসাদ থেকে ফিরে গেল গুহায়। ছেলেকে বাদশার শর্তের কথা জানালো। ছেলে তা শুনে খুশি হয়ে বললো: এটা কোনো ব্যাপারই না। সে কালো জানুর উটের সারি জমা করলো। বস্তার ভেতর স্বর্ণ-রূপা ভরলো। সেগুলোকে উটের পিঠে রেখে প্রথম উটের লাগাম দিলো বাবার হাতে। নিজে ছাগলের শিঙে উঠে বসলো। উটের পিছে পিছে রওনা হলো প্রাসাদের দিকে।
উটের সারি পৌঁছে গেল প্রাসাদে, তখনো গুহার মুখ পর্যন্ত কালো জানুর উট শেষ হয় নি । এ অবস্থা দেখে বাদশার সেনারা বাদশাকে খবর দিলো। বাদশা তো শুনে অবাক হয়ে গেল। নিরুপায় হয়ে আদেশ দিলো ময়লা জামা পরা লোককে যেন প্রাসাদে ঢুকতে দেয়। কিন্তু লোকজন এতো এতো উট আর স্বর্ণ গয়না দেখে বিস্মিত হয়ে গেল। তারা নিজেদের আঙুল কামড়াতে শুরু করলো। গুনগুন করে বলতে লাগলো: ছেঁড়া আর ময়লা জামা পরা একটা লোকের পক্ষে এতো মালামাল এনে হাজির করা কী করে সম্ভব।#