বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, বাংলাদের প্রকৃতির রূপের কোনো তুলনা হয় না। এর সৌন্দর্য অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয় বাহারি রঙের সুন্দর সুন্দর পাখি। পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ, বিচিত্র স্বরে ডাকাডাকি, গান গাওয়া ইত্যাদি মিটিয়ে দেয় মানুষের চোখ ও মনের ক্ষুধা। ক্ষতিকর নানা রকম পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, সাপ, ইঁদুর খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও পাখিদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। নানাভাবে মানুষের উপকারে আসা এই পাখিদেরই একটি হলো বুলবুল পাখি। যার কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ হয়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গান-‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল.। শুধু বিদ্রোহী কবির গানেই নয়, বুলবুল শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায় বহুল ব্যবহৃত একটি নাম। ইরান, ভারত, চীনসহ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা জাতের বুলবুল। বাংলাদেশে ৮ রকমের দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে লালপুচ্ছ বুলবুল, কালো বুলবুল, হলুদ বুলবুল, সিপাহী বুলবুল ও দুধরাজ বুলবুলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বুলবুলরা হচ্ছে পাইকনোনোটিডি গোষ্ঠীর পাখি। এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি লম্বায় ১৪ সেন্টিমিটার, বড়টি হয় ২৮ সেন্টিমিটার। লেজ বাদে শরীর প্রায় ১৮ সেন্টিমিটার। সব মিলে গড়ে প্রায় ৪৯ সেমি. লম্বা হয়ে থাকে একেকটি বুলবুল। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যায় আর তা হলো- পৃথিবীর আশি ভাগ বুলবুল পাখিই খুব সাহসী। তেত্রিশ ভাগ ভালো গায়ক। বাষট্টি ভাগ মোটামুটি গায়ক। তাছাড়া, প্রায় সব বুলবুলই চঞ্চল। এক বাগানের এক মালি ছিল যেমন রুচিবান তেমনি প্রতিভাবান। সে তার বাগানটাকে সুন্দর পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখত। এতো সুন্দর করে গাছপালা লাগিয়েছিল যে দেখতেই চোখটা জুড়িয়ে যেত। ওই বাগান থেকে ফিরতে মন চাইত না। তার বাগানে রুচিসম্মত বিচিত্র ফুলগাছ ছিল। সুগন্ধি ফুল যেমন ছিল, তেমনি দৃষ্টিনন্দন ফুলও ছিল। ফুলগুলোর তেমন ঘ্রাণ না থাকলেও দেখতে ছিল ভীষণ সুন্দর। গাছগুলোকে সে প্রতিপালন করত খুব আদর-যত্ন করে। বাগানের মালি ছিল পড়ন্ত বয়সের মানে বৃদ্ধপ্রায়। প্রত্যেক দিন সকালবেলা সূর্য ওঠার আগেই সে বাগানে ঢুকে পায়চারি করত এবং সকাল বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিয়ে শরীর-মন চাঙ্গা করে তুলত। সুগন্ধিতে ভরপুর সকালের ফুল আর বাগানের দূষণমুক্ত বাতাস বলে কথা। কেবল বাতাস কেন সকালের তরতাজা ঘাস, সদ্য ফোটা ফুল আর অন্যান্য গাছ দেখে বিস্মিত হয়ে যেত, নাকের কাছে নিয়ে সুগন্ধি শোঁকার চেষ্টা করত। বাগানের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সে ভীষণভাবে উপভোগ করতে এবং সে মোটামুটি প্রফুল্লই থাকত সবসময়। এ কারণে তার বন্ধুরা তাকে বলত প্রাণবন্ত বৃদ্ধ। অন্যান্যদের মতো সেও বিশ্বাস করত, যে ভোরে ঘুম থেকে ওঠে এবং ফুলবাগানে অন্যান্য গাছের মাঝে কিছুক্ষণ পায়চারি করে সে কখনো বুড়ো হয় না, সবসময় সবুজ, সতেজ এবং প্রাণবন্ত থাকে। বাগানে বহু রকমের ফুলগাছ ছিল কিন্তু মালি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিল লাল রঙের ফুলের প্রতি। ওই ফুল দেখতে যেমন একটু ভিন্নরকম সুন্দর তেমনি ঘ্রাণেও অনন্য। এই ফুল গাছের টবটাও ছিল লাল রঙের মাটি দিয়ে সুন্দর করে বানানো। মালি প্রতিদিনই ওই ফুল গাছের কাছে যেত এবং একটা একটা করে প্রতিটি ফুলের ঘ্রাণ নিত। ঘ্রাণ নিতে নিতে বলত: বুলবুল পাখি যে লাল রঙের ফুলের প্রেমে আকৃষ্ট হয় এমনি এমনি হয় না। লাল ফুলের প্রেমে পড়ার যৌক্তিকতা আছে। লাল ফুল জীবন মনকে প্রাণবন্ত সতেজ ও প্রফুল্ল করে তোলে। একদিন ভোরবেলা মানে সূর্য ওঠার আগেভাগে বৃদ্ধ মালি বাগানে পায়চারি করছিলেন। পায়চারি করতে করতে যথারীতি তিনি গেলেন তাঁর প্রিয় লাল ফুল গাছের কাছে। গিয়ে দেখলেন একটা বুলবুল ওই ফুল গাছের শাখায় বসে আছে আর মাঝে মাঝে ফুলের পাতাগুলোকে উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে বুলবুল গান গাচ্ছে। মালি বুলবুলের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন তার সুরেলা উপস্থিতিতে সে খুশিই। বুলবুল গান গাইতে গাইতে প্রতিটি ফুলের পাপড়ি পাখা ঝাপটিয়ে ছুয়ে দিচ্ছিল। বৃদ্ধ মালি কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে বুলবুলির গান শুনল। ফুলের সাহচর্যে বুলবুলের আনন্দ দেখে বৃদ্ধের খুব ভালো লাগল। কিন্তু যখন দেখলো বুলবুলের অতিরিক্ত ভালোবাসায় ফুলের পাপড়িগুলো খসে পড়ছে তখন কিছুটা খারাপ লাগল। কিছুক্ষণ পর বুলবুল যখন বুঝতে পারল বাগানের মালি তাকে দেখতে পাচ্ছে তখন সে উড়ে চলে গেল। পরদিন সকালেও একই ঘটনা ঘটল। আজও মালির উপস্থিতি টের পেয়ে উড়ে চলে গেল বুলবুল। কিন্তু তার প্রিয় ফুলের ছিন্ন ভিন্ন পাপড়ি দেখে মালির মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে বলল- বুলবুল ফুলকে ভালোবাসতেই পারে, তার মানে তো এই নয় যে, ফুলগুলোকে ছিঁড়েখুঁড়ে রাখবে। ফুলের প্রতি ভালোবাসা মানে ফুল দেখা, ফুলের ঘ্রাণ নেয়া। কিন্তু পাপড়ি ছিঁড়ে ফেলাটা তো অন্যায়। আমি এতো কষ্ট করে এই ফুলগুলোকে প্রতিপালন করলাম, বুলবুল কেন সেগুলোকে নষ্ট করে ফেলবে? তৃতীয় দিনেও বৃদ্ধ দেখলো সকালবেলা বুলবুল গান গাইতে গাইতে মাটিতে পড়ে থাকা ফুলের পাপড়িগুলোর সাথে কথা বলছে। বৃদ্ধের রাগ হলো। বলল: বুলবুলি মুক্ত জীবনের অসদ্ব্যবহার করছে, এর শাস্তি হলো খাঁচায় বন্দী করা। মালি লাল ফুল গাছে জাল পেতে বুলবুলকে আটক করল এবং খাঁচায় বন্দী করে ফেলল। বন্দী বুলবুলকে সে বলল: তুমি তোমার স্বাধীনতার মর্যাদা বোঝ নি। এখন এই খাঁচায় বন্দী থেকে বোঝার চেষ্টা কর, ফুলের পাপড়ি নষ্ট করার পরিণতি কী? খাঁচায় বন্দী করার কারণে বুলবুল ক্ষিপ্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। মালিকে বলল: প্রিয় বন্ধু আমার! তুমি এবং আমি উভয়েই লাল ফুলের প্রেমিক। তুমি যে ফুলগুলোকে পরিচর্যা করে তাতে আমি ভীষণ খুশি। তুমিও আমার গান শুনে নিশ্চয়ই খুশি হও! আমিও চাই তোমার মতো মুক্ত থাকতে এবং বাগানের ভেতর ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু তুমি আমাকে কী কারণে এভাবে খাঁচায় বন্দী করলে? যদি তুমি আমার গান শুনতে চাও তাহলে তোমার ফুল বাগান হলো আমার বাসা, সেখানে আমাকে ছেড়ে দাও! আমি সারা দিনরাত গান গাইব। এর বাইরে যদি আমার আটক করার অন্য কোনো কারণ থেকে থাকে তাহলে বল! মালি বলল: তুমি আমার প্রিয় ফুলগুলোকে নষ্ট করে আমাকে কষ্ট দিয়েছ। তুমি যখন মুক্ত থাক তখন এতো বেশি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাও যে ফুলগুলোকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেল। তোমার এই ধ্বংসাত্মক কাজের শাস্তিই হলো খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকা যাতে অন্যরাও এ থেকে শিক্ষা নেয়। বুলবুল বলল: হে অবিবেচক মালি! তুমি আমাকে খাঁচায় বন্দী করে আমার মনটা ভেঙে দিয়েছ, আমার আত্মাকে কষ্ট দিয়েছ। আবার শাস্তির কথা বলছ? তুমি কি ভাবছ না তোমার গুনাহ অনেক বেশি? কেননা তুমি মন ভেঙেছ আর আমি একটা ফুলের পাপড়ি খসিয়েছি মাত্র। বুলবুলের কথাগুলো মালিকে বেশ নাড়া দেয়। পাখির জবাবে সে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ছেড়ে দিল। বুলবুল উড়ে চলে গেল। সোজা গিয়ে বসে পড়ল লাল ফুল গাছের শাখায়। সেখান থেকে মালিকে বলল: যেহেতু তুমি আমার মঙ্গল করেছ আমিও তাই ভালো কিছু করে পুষিয়ে দিতে চাই। মাটির নীচে একটি পাত্রভর্তি স্বর্ণমুদ্রা আছে। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেখানে মাটির নীচে। সেগুলো তুলে নাও, সুখ-শান্তিতে বসবাস কর। মালিকে মাটি খুঁড়ে সত্যিই স্বর্ণমুদ্রা পেল। বুলবুলকে সে বলল: আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে, তুমি মাটির নীচের পাত্রও দেখতে পাও! অথচ তোমার জন্য যে জাল আমি পেতেছিলাম সেটা তুমি দেখতে পাও নি। বুলবুল বলল: এর দু’টি কারণ আছে। প্রথমত জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার বাইরেও তকদির বলে একটা বিষয় তো আছেই। দ্বিতীয়ত, আমি তো স্বর্ণের পাগল নই। স্বর্ণ দিয়ে আমি কী করব! সেজন্য ওগুলো দেখে আমি কোনো গুরুত্বই দেই নি। কিন্তু যেহেতু আমি লাল ফুলের প্রেমিক তাই ওর প্রেমে এতটাই বুঁদ হয়েছিলাম যে, অন্য কোনো দিকে আর খেয়ালই করি নি। আসলে যে কোনো ব্যাপারেই সীমা লঙ্ঘন করলে কিছুটা কষ্ট এবং ঝামেলায় পড়তেই হয়। এমনকি প্রেমের বাহুল্যও সেই পরিণতি থেকে মুক্ত নয়। বুলবুল এভাবে কথা বলতে উড়ে গেল লাল ফুলের শাখায়। ফুলের সৌন্দর্য সে উপভোগ করতে লেগে যায়। মুখে গাইতে থাকে থাকে সুরেলা গান।#
বুলবুল পাখি ও মালি
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, বাংলাদের প্রকৃতির রূপের কোনো তুলনা হয় না। এর সৌন্দর্য অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয় বাহারি রঙের সুন্দর সুন্দর পাখি। পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ, বিচিত্র স্বরে ডাকাডাকি, গান গাওয়া ইত্যাদি মিটিয়ে দেয় মানুষের চোখ ও মনের ক্ষুধা। ক্ষতিকর নানা রকম পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, সাপ, ইঁদুর খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও পাখিদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। নানাভাবে মানুষের উপকারে আসা এই পাখিদেরই একটি হলো বুলবুল পাখি। যার কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ হয়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গান-‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল.। শুধু বিদ্রোহী কবির গানেই নয়, বুলবুল শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায় বহুল ব্যবহৃত একটি নাম। ইরান, ভারত, চীনসহ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা জাতের বুলবুল। বাংলাদেশে ৮ রকমের দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে লালপুচ্ছ বুলবুল, কালো বুলবুল, হলুদ বুলবুল, সিপাহী বুলবুল ও দুধরাজ বুলবুলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বুলবুলরা হচ্ছে পাইকনোনোটিডি গোষ্ঠীর পাখি। এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি লম্বায় ১৪ সেন্টিমিটার, বড়টি হয় ২৮ সেন্টিমিটার। লেজ বাদে শরীর প্রায় ১৮ সেন্টিমিটার। সব মিলে গড়ে প্রায় ৪৯ সেমি. লম্বা হয়ে থাকে একেকটি বুলবুল। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যায় আর তা হলো- পৃথিবীর আশি ভাগ বুলবুল পাখিই খুব সাহসী। তেত্রিশ ভাগ ভালো গায়ক। বাষট্টি ভাগ মোটামুটি গায়ক। তাছাড়া, প্রায় সব বুলবুলই চঞ্চল। এক বাগানের এক মালি ছিল যেমন রুচিবান তেমনি প্রতিভাবান। সে তার বাগানটাকে সুন্দর পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখত। এতো সুন্দর করে গাছপালা লাগিয়েছিল যে দেখতেই চোখটা জুড়িয়ে যেত। ওই বাগান থেকে ফিরতে মন চাইত না। তার বাগানে রুচিসম্মত বিচিত্র ফুলগাছ ছিল। সুগন্ধি ফুল যেমন ছিল, তেমনি দৃষ্টিনন্দন ফুলও ছিল। ফুলগুলোর তেমন ঘ্রাণ না থাকলেও দেখতে ছিল ভীষণ সুন্দর। গাছগুলোকে সে প্রতিপালন করত খুব আদর-যত্ন করে। বাগানের মালি ছিল পড়ন্ত বয়সের মানে বৃদ্ধপ্রায়। প্রত্যেক দিন সকালবেলা সূর্য ওঠার আগেই সে বাগানে ঢুকে পায়চারি করত এবং সকাল বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিয়ে শরীর-মন চাঙ্গা করে তুলত। সুগন্ধিতে ভরপুর সকালের ফুল আর বাগানের দূষণমুক্ত বাতাস বলে কথা। কেবল বাতাস কেন সকালের তরতাজা ঘাস, সদ্য ফোটা ফুল আর অন্যান্য গাছ দেখে বিস্মিত হয়ে যেত, নাকের কাছে নিয়ে সুগন্ধি শোঁকার চেষ্টা করত। বাগানের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সে ভীষণভাবে উপভোগ করতে এবং সে মোটামুটি প্রফুল্লই থাকত সবসময়। এ কারণে তার বন্ধুরা তাকে বলত প্রাণবন্ত বৃদ্ধ। অন্যান্যদের মতো সেও বিশ্বাস করত, যে ভোরে ঘুম থেকে ওঠে এবং ফুলবাগানে অন্যান্য গাছের মাঝে কিছুক্ষণ পায়চারি করে সে কখনো বুড়ো হয় না, সবসময় সবুজ, সতেজ এবং প্রাণবন্ত থাকে। বাগানে বহু রকমের ফুলগাছ ছিল কিন্তু মালি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিল লাল রঙের ফুলের প্রতি। ওই ফুল দেখতে যেমন একটু ভিন্নরকম সুন্দর তেমনি ঘ্রাণেও অনন্য। এই ফুল গাছের টবটাও ছিল লাল রঙের মাটি দিয়ে সুন্দর করে বানানো। মালি প্রতিদিনই ওই ফুল গাছের কাছে যেত এবং একটা একটা করে প্রতিটি ফুলের ঘ্রাণ নিত। ঘ্রাণ নিতে নিতে বলত: বুলবুল পাখি যে লাল রঙের ফুলের প্রেমে আকৃষ্ট হয় এমনি এমনি হয় না। লাল ফুলের প্রেমে পড়ার যৌক্তিকতা আছে। লাল ফুল জীবন মনকে প্রাণবন্ত সতেজ ও প্রফুল্ল করে তোলে। একদিন ভোরবেলা মানে সূর্য ওঠার আগেভাগে বৃদ্ধ মালি বাগানে পায়চারি করছিলেন। পায়চারি করতে করতে যথারীতি তিনি গেলেন তাঁর প্রিয় লাল ফুল গাছের কাছে। গিয়ে দেখলেন একটা বুলবুল ওই ফুল গাছের শাখায় বসে আছে আর মাঝে মাঝে ফুলের পাতাগুলোকে উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে বুলবুল গান গাচ্ছে। মালি বুলবুলের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন তার সুরেলা উপস্থিতিতে সে খুশিই। বুলবুল গান গাইতে গাইতে প্রতিটি ফুলের পাপড়ি পাখা ঝাপটিয়ে ছুয়ে দিচ্ছিল। বৃদ্ধ মালি কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে বুলবুলির গান শুনল। ফুলের সাহচর্যে বুলবুলের আনন্দ দেখে বৃদ্ধের খুব ভালো লাগল। কিন্তু যখন দেখলো বুলবুলের অতিরিক্ত ভালোবাসায় ফুলের পাপড়িগুলো খসে পড়ছে তখন কিছুটা খারাপ লাগল। কিছুক্ষণ পর বুলবুল যখন বুঝতে পারল বাগানের মালি তাকে দেখতে পাচ্ছে তখন সে উড়ে চলে গেল। পরদিন সকালেও একই ঘটনা ঘটল। আজও মালির উপস্থিতি টের পেয়ে উড়ে চলে গেল বুলবুল। কিন্তু তার প্রিয় ফুলের ছিন্ন ভিন্ন পাপড়ি দেখে মালির মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে বলল- বুলবুল ফুলকে ভালোবাসতেই পারে, তার মানে তো এই নয় যে, ফুলগুলোকে ছিঁড়েখুঁড়ে রাখবে। ফুলের প্রতি ভালোবাসা মানে ফুল দেখা, ফুলের ঘ্রাণ নেয়া। কিন্তু পাপড়ি ছিঁড়ে ফেলাটা তো অন্যায়। আমি এতো কষ্ট করে এই ফুলগুলোকে প্রতিপালন করলাম, বুলবুল কেন সেগুলোকে নষ্ট করে ফেলবে? তৃতীয় দিনেও বৃদ্ধ দেখলো সকালবেলা বুলবুল গান গাইতে গাইতে মাটিতে পড়ে থাকা ফুলের পাপড়িগুলোর সাথে কথা বলছে। বৃদ্ধের রাগ হলো। বলল: বুলবুলি মুক্ত জীবনের অসদ্ব্যবহার করছে, এর শাস্তি হলো খাঁচায় বন্দী করা। মালি লাল ফুল গাছে জাল পেতে বুলবুলকে আটক করল এবং খাঁচায় বন্দী করে ফেলল। বন্দী বুলবুলকে সে বলল: তুমি তোমার স্বাধীনতার মর্যাদা বোঝ নি। এখন এই খাঁচায় বন্দী থেকে বোঝার চেষ্টা কর, ফুলের পাপড়ি নষ্ট করার পরিণতি কী? খাঁচায় বন্দী করার কারণে বুলবুল ক্ষিপ্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। মালিকে বলল: প্রিয় বন্ধু আমার! তুমি এবং আমি উভয়েই লাল ফুলের প্রেমিক। তুমি যে ফুলগুলোকে পরিচর্যা করে তাতে আমি ভীষণ খুশি। তুমিও আমার গান শুনে নিশ্চয়ই খুশি হও! আমিও চাই তোমার মতো মুক্ত থাকতে এবং বাগানের ভেতর ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু তুমি আমাকে কী কারণে এভাবে খাঁচায় বন্দী করলে? যদি তুমি আমার গান শুনতে চাও তাহলে তোমার ফুল বাগান হলো আমার বাসা, সেখানে আমাকে ছেড়ে দাও! আমি সারা দিনরাত গান গাইব। এর বাইরে যদি আমার আটক করার অন্য কোনো কারণ থেকে থাকে তাহলে বল! মালি বলল: তুমি আমার প্রিয় ফুলগুলোকে নষ্ট করে আমাকে কষ্ট দিয়েছ। তুমি যখন মুক্ত থাক তখন এতো বেশি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাও যে ফুলগুলোকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেল। তোমার এই ধ্বংসাত্মক কাজের শাস্তিই হলো খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকা যাতে অন্যরাও এ থেকে শিক্ষা নেয়। বুলবুল বলল: হে অবিবেচক মালি! তুমি আমাকে খাঁচায় বন্দী করে আমার মনটা ভেঙে দিয়েছ, আমার আত্মাকে কষ্ট দিয়েছ। আবার শাস্তির কথা বলছ? তুমি কি ভাবছ না তোমার গুনাহ অনেক বেশি? কেননা তুমি মন ভেঙেছ আর আমি একটা ফুলের পাপড়ি খসিয়েছি মাত্র। বুলবুলের কথাগুলো মালিকে বেশ নাড়া দেয়। পাখির জবাবে সে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ছেড়ে দিল। বুলবুল উড়ে চলে গেল। সোজা গিয়ে বসে পড়ল লাল ফুল গাছের শাখায়। সেখান থেকে মালিকে বলল: যেহেতু তুমি আমার মঙ্গল করেছ আমিও তাই ভালো কিছু করে পুষিয়ে দিতে চাই। মাটির নীচে একটি পাত্রভর্তি স্বর্ণমুদ্রা আছে। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেখানে মাটির নীচে। সেগুলো তুলে নাও, সুখ-শান্তিতে বসবাস কর। মালিকে মাটি খুঁড়ে সত্যিই স্বর্ণমুদ্রা পেল। বুলবুলকে সে বলল: আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে, তুমি মাটির নীচের পাত্রও দেখতে পাও! অথচ তোমার জন্য যে জাল আমি পেতেছিলাম সেটা তুমি দেখতে পাও নি। বুলবুল বলল: এর দু’টি কারণ আছে। প্রথমত জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার বাইরেও তকদির বলে একটা বিষয় তো আছেই। দ্বিতীয়ত, আমি তো স্বর্ণের পাগল নই। স্বর্ণ দিয়ে আমি কী করব! সেজন্য ওগুলো দেখে আমি কোনো গুরুত্বই দেই নি। কিন্তু যেহেতু আমি লাল ফুলের প্রেমিক তাই ওর প্রেমে এতটাই বুঁদ হয়েছিলাম যে, অন্য কোনো দিকে আর খেয়ালই করি নি। আসলে যে কোনো ব্যাপারেই সীমা লঙ্ঘন করলে কিছুটা কষ্ট এবং ঝামেলায় পড়তেই হয়। এমনকি প্রেমের বাহুল্যও সেই পরিণতি থেকে মুক্ত নয়। বুলবুল এভাবে কথা বলতে উড়ে গেল লাল ফুলের শাখায়। ফুলের সৌন্দর্য সে উপভোগ করতে লেগে যায়। মুখে গাইতে থাকে থাকে সুরেলা গান।#