নবী জীবনের গল্প

আজকের আসরে আমরা এমন এক মহামানবের কথা বলব- তাঁর চেয়ে উত্তম কোনো সন্তান আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো মা জন্ম দিতে পারেননি, আর পারবেনও না কোনোদিন। গঠন প্রকৃতির দিক থেকে তিনি যেমন অনন্য, তেমনি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন অসাধারণ। পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে কলঙ্ক থাকলেও তাঁর চরিত্রে ছিল না বিন্দুমাত্র কলুষতার চিহ্ন। চাঁদ-সেতারাও তাঁর সৌন্দর্যের কাছে ছিল লজ্জিত। মাটির তৈরি মানুষ হয়ে নূরের তৈরি ফেরেশতাদের হাজার গুণ উপরে চলে গিয়েছিলেন তিনি। আকারে-আকৃতিতে জ্ঞানে-গুণে, স্বভাব-চরিত্রে তিনি অনন্য। তাঁর উত্তম চরিত্রের সার্টিফিকেট দিয়েছেন স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন। খোদাপ্রদত্ত সব গুণই ছিল তাঁর মধ্যে বিদ্যমান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো যে, আমরা কার কথা বলছি। হ্যাঁ, আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কথা বলছি। যিনি এই রবিউল আওয়াল মাসেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে নিয়ে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। তিনি হচ্ছেন, বিশ্বের সকল কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী এবং লেখকদের লেখনীর উৎস। যাকে নিয়ে লেখার অন্ত নেই, রচনার শেষ নেই। সব দেশের সব ভাষাতেই মহানবী (সাঃ) কে নিয়ে এত বিপুল সংখ্যক বই-পুস্তক রচিত হয়েছে যে, এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী রেকর্ড ও বিষ্ময়!

কিন্তু চৌদ্দ শতাধিক বছরের এই ক্রমাগত আলোচনার পরও মনে হয়, মহানবী (সাঃ) নিয়ে এতদিনের এই আলোচনা যেন মূল আলোচনার একটি ভূমিকা মাত্র। প্রকৃত আলোচনা এখনও শুরুই হয়নি। আর তাইতো পৃথিবীর বাঘা বাঘা কবি সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ ও লেখকরা রাসূলের গুণের হিসাব করতে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক! আইরিশ লেখক জর্জ বার্নাড শ’ বলেছেন ‘মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনী হল, এক তলাবিহীন সাগর এবং সীমাবিহীন সীমানার ন্যায়।’ অন্যদিকে ইতিহাসবিদ যোশেফ হল বলেছেন, “মুহাম্মদ (সাঃ) এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যাকে না পেলে বিশ্ব অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তিনি নিজেই নিজের তুলনা। তাঁর কীর্তিময় ইতিহাস মানব জাতির ইতিহাসে এক সমুজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছে।”

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, দয়া, মমতা, আচারনিষ্ঠা, পরমতসহিষ্ণুতা, মহানুভবতা, খোদাভীরুতা ও চারিত্রিক মাধুর্যতায় রাসূল (সাঃ)এর সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বিশ্ববাসীর জন্য শিক্ষণীয়; প্রতিটি ধাপই অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। আর তাইতো, রাসূল (সাঃ) যেদিন এই দুনিয়ায় আগমন করেন সেদিন মানুষ, পশু-পাখি, পাহাড়, পর্বত, মরুভূমি, গাছগাছালিসহ সবাই খুশীতে আত্মহারা হয়েছিল। কবি নজরুলের ভাষায়- বয়ে যায় ঢল, ধরে নাকো জল আজিকি জমজম কুপে সাহারা আজিকে উথলিয়া ওঠে অতীত সাগর রূপে। পুরাতন রবি উঠিল না আর সেদিন লজ্জা পেয়ে নবীন রবির আলোকে সেদিন বিশ্ব উঠিল ছেয়ে।

বন্ধুরা, রাসূলের আগমনে পর প্রকৃতিতে কী ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার কিঞ্চিৎ বর্ণনা জানলে কবি নজরুলের এ কবিতাটি থেকে। তোমরা যারা ছোট তাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে- বিশ্বনবীর প্রতি আল্লাহর সৃষ্ট সব জীবের এত শ্রদ্ধা ও সম্মানের কারণ কি? কেনইবা তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের মর্যাদা পেলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। কিন্তু রংধনুর এ ছোট্ট আসরে এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলা যাবে না। তবে এটুকু বলা যায়, পাপাচারে ভরপুর জাহেলি সমাজে বাস করেও তিনি ছিলেন পূত-নিখুঁত। সে সমাজেও তিনি ‘আল-আমীন’ এবং ‘আস-সাদিক’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।

শুধু তাই নয়, কৈশোরের চপলতার কারণে তিনি সামান্যও পথবিচ্যুত হননি। যৌবনের বাঁধভাঙা জোয়ার, সীমাতিরিক্ত আবেগের কাছে তিনি পরাস্ত হননি। বংশপরম্পরায় চলে আসা গোত্রীয় যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়িয়ে পড়েননি তিনি। জীবনে কাউকে কোনোদিন কটু কথা পর্যন্ত বলেননি। তাঁর দ্বারা কেউ কোনোদিন বিন্দুমাত্র কষ্ট পাননি। কোনো বিপদগ্রস্ত মানুষকে তাঁর কাছ থেকে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে যেতে হয়নি। নিজের চিরশত্রুকে হাতের কাছে পেয়েও কোনো ধরনের প্রতিশোধ নেননি।

রাসূল (সা.) ছিলেন নিরাশ্রয়ের আশ্রয়দাতা, নিরন্নের অন্নদাতা, অসহায়ের আশার স্থল। সমাজের অধিপতি থেকে শুরু করে পথের ধূলিমাখা সুবোধ বালকও তাঁর বিশাল নিরাপত্তাময় বুকে স্থান পেয়ে ধন্য হতো। আকাশসম উদার হৃদয় দ্বারা তিনি আপন করে নিয়েছিলেন প্রতিটি মানুষকে। আর এজন্যই তিনি ছিলেন সবার আদর্শ।

এ পর্যায়ে আমরা শিশু-কিশোরদের প্রতি রাসূলের স্নেহ-ভালবাসা সম্পর্কে কিছু কথা বলব। তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছো যে, শিশুদের সঙ্গে রাসূল (সাঃ) এর  ব্যবহার ছিল স্নেহপূর্ণ, কোমল এবং বন্ধুসূলভ। তিনি তাদের হাসি আনন্দে যোগ দিতেন। ছোটদের চপলতায় তিনি কখনও অসন্তষ্ট কিংবা বিরক্ত হতেন না। তাদের সঙ্গে সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন তিনি। শিশুরা তাঁর কাছে এলে নিজেদের সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যেতো।

একদিন প্রিনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) খেতে বসেছিলেন। কিন্তু খানা তখনও শুরু করেননি। উম্মে কায়েস বিনতে মুহসিন (রাঃ) তার শিশুপুত্রটিকে কোলে করে রাসূলের সাথে দেখা করতে আসলেন। শিশুটিকে দেখে রাসূল (সাঃ) তার দিকে এগিয়ে এলেন। পরম আদরে কোলে তুলে নিয়ে খাবারের জায়গায় গিয়ে বসলেন। শিশুটি নবীজীর আদর পেয়ে তাঁর কোলেই পেশাব করে ভিজিয়ে দিলো। এ ঘটনায় রাসূল (সাঃ) স্মিত হাসলেন। তাঁর চেহারায় বিরক্তি প্রকাশ পেলো না। তিনি পানি আনার জন্য একজনকে বললেন। পানি আনা হলে যে যে জায়গায় পেশাব পড়েছিল সেখানে পানি ঢেলে দিলেন। রাসূলেখোদা মনে করতেন, ‘বাগানের ফুল যেমন পবিত্র, মায়েব কোল থেকে নেয়া শিশুও তেমনি পবিত্র।’ তিনি আরো বলেছেন, “তোমরা শিশুদেরকে স্নেহ কর এবং তাদের প্রতি দয়ালু হও।”

শিশুদের প্রতি মহানবী (সাঃ)’র স্নেহ ও পিতৃসূলভ আচরণের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ৷ রাসূল (সাঃ) শিশুদের সাথে খেলতেন এবং এমনকি তাদের খেলনা ও পোষা প্রাণীরও খবর নিতেন ৷ তিনি তাঁদের সাথে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে ও নীচু কন্ঠে কথা বলতেন ৷ বিশেষ করে নাতি ইমাম হাসান ও হোসাইনের প্রতি রাসূলের ভালোবাসা ও স্নেহের কথা কমবেশী সবাই জানে৷ মহানবী (সাঃ) তাঁর এ নাতিদের সাথে খেলাধুলা করতেন এবং অন্যদের সামনে তাদের চুমু দিতেন ৷ তিনি প্রতিদিন তাঁদের সান্নিধ্য দিতেন ৷ আর এভাবে তিনি মুসলমানদের বাস্তবে শিখিয়ে গেছেন যে, কিভাবে শিশুদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়।

Written By

More From Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You May Also Like

লোভী পিঁপড়া

‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ কিংবা ‘লোভের ফল ভাল নয়’-এই প্রবাদ দু’টি সবাই জানে। এ প্রবাদ…

হৃদয়ের ব্যাধি সারানোর উপায় !

এক ব্যক্তি এসে সুফয়ান আস- সাওরীকে জিজ্ঞেস করলোঃ “আমি হৃদয়ের ব্যাধিতে ভুগছি, আমাকে কোনো প্রতিষেধক…

হযরত হামযা (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ

নবুয়তের ষষ্ঠ বছরে হযরত হামযা (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন। একবার আবূ জাহেল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে…