ইসলামের প্রথম শহীদ ও কোরাইশদের প্রতিবাদ

প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ পাওয়ার পর গৃহীত বিভিন্ন ব্যবস্থা যে ফলবতী হয়নি, তা উপরে বলা হয়েছে, কিন্তু তাওহীদ, ইসলাম, ইসলামের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে মক্কার সর্বত্র বিভিন্নভাবে আলোচনা চলতে থাকে। এ সময় একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কয়েকজন নও-মুসলিমকে সাথে নিয়ে কাবা শরীফে বসে তাওহীদ সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। তাঁর তাওহীদ সম্পর্কিত আলোচনায় অবিশ্বাসী কুরাইশদের মধ্যে মহা হুলস্থল পড়ে যায়।

তারা অগ্নিমূর্তি ধারন করে ছুটে আসে। এ সময় হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত সন্তান হারেস বিন আবী হালা কাফেরদের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করায় কুরাইশরা ক্ষিপ্ত হয়ে তার উপর আক্রমণ চালিয়ে এ নিরপরাধ নও-মুসলিম যুবকের শোণিতে কাবা প্রাঙ্গণ রঞ্জিত করে। এভাবে হারেস বিন আবী হালা ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শহীদ হবার মর্যাদা লাভ করেন।


উক্ত ঘটনার পর কুরাইশরা সংঘবদ্ধভাবে ইসলাম প্রচারে বাধা দিতে শুরু করল। পবিত্র খানায়ে কাবার পড়শী ও কাবা ঘরের চাবি তাদের হাতে থাকায় নিজেদেরকে আল্লাহর আওলাদা বলে মনে করত এবং সমগ্র দুনিয়ার মানুষের উপর একচেটিয়া মান মর্যাদার অধিকারী বলে তারা মনে করত। তাই পূর্ব পূরুষদের দ্বীনের বিরুদ্ধে কোন কথা তারা বরদাস্ত করতে পারত না।


তাদের ধারণা মতে ওলীদ বিন মুগীরা উমাইয়া বিন খলফ এবং আস বিন ওয়ায়েল নবুয়তের যোগ্য পাত্র। এ কারণে তারা হযরত মুহাম্মদের নবুয়তকে স্বীকার করতে পারে না।
দ্বিতীয়তঃ ইসলামের অনেক বিষয় খ্রীষ্টান ধর্মের মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখে। অথচ আরবের লোকেরা খ্রীষ্টান ধর্মের প্রতি আন্তরিক ঘৃণা পোষণ করত। আর এ ঘৃণা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী আবরাহা বাদশাহ যখন কাবাগৃহে আক্রমণ করল তখন হতে।


এদিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বায়তুল মুকাদ্দাসকে কিবলা হিসেবে মেনে চলে। এটাও তাদের ঘোর আপত্তির কারন হল। অপরদিকে কুরাইশদের মধ্যে বনু হাশেম ও বনু উমাইয়ার মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে দ্বন্ধ্ব চলে আসছে। খানা কাবার উপর বনু হাশেমের কর্তৃত্ব তারা বরদাশত করতে পারত না। তবে আব্দুল মুত্তালিব পর্যন্ত বনু হাশেমের নেতৃবৃন্দ স্বীয় চরিত্র ও প্রতিপত্তির বলে বনু উমাইয়াকে দুর্বল করে রেখেছিল।

কিন্তু আবদুল মুত্তালিবের ইনতিকালের পর আবূ তালিব, লাহাব প্রমুখ হাশেমী নেতারা তাদের প্রতিপত্তি বহাল রাখতে সক্ষম হয়নি। তাদের চারিত্রিক অধঃপতনের কারণে তারা সামাজিক মর্যাদা হারিয়ে ফেলল। আবূ লাহাব স্বয়ং কাবাগৃহের অভ্যন্তর হতে একটি স্বর্ণের হীরক চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। এসব কারণে বনু উমাইয়ার লোকেরা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে নবীরুপে বরণ করতে রাজী ছিল না। কেননা, তিনি হাশেমী বংশের লোক।


নবী করীম (সাঃ) এর প্রচারের বিরুদ্ধে তারা জোর তৎপরতা চালাল তাদের বিরোধিতার ভিতর ও প্রত্যেক গোত্রেরই দু চারজন লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ফলে তারা প্রকাশ্য বিরোধিতা করতে পারত না।
এ সব কারণে তারা প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে এই সমস্যার সমাধান কল্পে কয়েকজন সরদারকে নির্বাচন করে আবূ তালিবের কাছে পাঠাল।


আরবের যেসব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) – এর বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে আবূ তালিবের কাছে উপস্থিত হয়েছিল তারা হচ্ছে আবূ লাহাব, আবূ জাহেল, ওলীদ বিন মুগীরা, ওতবা, শায়বা, আবূ সুফীয়ান, আবুল বোখতরী, আস বিন ওয়ায়েল এবং মুনাব্বেহ প্রমুখ কুরাইশের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির তারা আবূ তালিবের কাছে বলল, তোমার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাদের পূর্ব পুরুষের দেব-দেবীকে গালি দিয়ে থাকে।

আমাদেরকে নির্বোধ বলে। তুমি তাকে এ সকল প্রচার হতে নিবৃত্ত করার ব্যবস্থা কর। আবূ তালিব তাঁকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, চাচা আপনি তাদের সকলকে ডাকুন। আমি তাদের সকল প্রস্তাব মেনে নিতে পারব যদি তারা কেবল আমার একটি কথা মেনে নেয়। নবীজী (সাঃ) -এর কথা শুনে আবূ তালিবের অন্তরে আনন্দের সঞ্চার হল। সে মনে করল এখন একটি মীমাংসা অবশ্যই হয়ে যাবে। কারণ ভাতিজার মধ্যে অনেকটা নমনীয়ভাব তার ধারণা অনুযায়ী পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কথা অনুসারে আবূ তালিব কোরাইশের সরদারদেরকে ডেকে নিজগৃহে একত্রিত করেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তাদের প্রস্তাব সমূহ কি কি? তারা বলল প্রথমতঃ মুহাম্মদ আমাদের মাবুদদের বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে পারবে না। আমরাও তার মাবুদের বিরুদ্ধে কোন কথা বলব, না।
দ্বিতীয়তঃ আমাদেরকে কোন ভর্ৎসনা করতে পারবে না। তৃতীয়তঃ আত্নীয়তার বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না। চতুর্থতঃ উচ্চঃস্বরে কোরআন পাঠ করতে পারবে না। পঞ্চমতঃ খানায়ে কাবাতে প্রকাশ্যে নামায পড়া বা কোরআন তিলাওয়াত কিছুই করতে পারবে না। সে চাইলে নিজ গৃহে চুপে চুপে পড়বে ইত্যাদি।

নবী করীম (সাঃ) ধৈর্য সহকারে তাদের সমস্ত কথা শুনলেন এবং বলেন, আমি আপনাদের সকল প্রস্তাব মেনে নিতে পারি যদি আপনারা আমার মাত্র একটি কথা মানতে পারেন। পারবেন কিনা আমাকে বলুন। তারা বলল, নিশ্চয় এতগুলো প্রস্তাবের মুকাবিলায় একটি প্রস্তাব আমাদের মেনে নিতে কোন প্রকার আপত্তি থাকবে না। তবে আপনার প্রস্তাবটি বলুন।


নবীজী (সাঃ) বলেন, আপনারা সকলে বলুন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”। একথা শুনে তারা চিৎকার করে উঠে বলল এই কালেমা মেনে নিতে পারলে তো আপনার সাথে আমাদের কোন বিবাদই থাকত না। এই বলে তারা হৈচৈ করে আবূ তালিবের গৃহ হতে প্রস্থান করলো।

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।