হস্তীবাহিনী
হস্তীবাহিনী ধ্বংস আবদুল মুত্তালিবের জীবনের আর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্মের ৫৫ (পঞ্চান্ন) দিন পূর্বে এ ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। যার বিবরণ হল, আবিসিনিয়ার (হাবশার) বাদশাহের পক্ষ হতে আবরাহ নামক জনৈক হাবসী ইয়ামনের শাসক নিযুক্ত হয়েছিল।
সে দেখল মক্কা শরীফে পবিত্র খানায়ে কাবার জেয়ারতে হাজার হাজার লোক প্রতি বছর মক্কায় আগমন করে এবং বহু নজর নেয়াজ ও হাদিয়া উক্ত ঘরের জন্য চতুর্দিকে হতে আসছে। এটা দেখে সে হিংসার বসবর্তী হয়ে ইয়ামনের রাজধানী সানয়াতে একটি সুরম্য গীর্জা নির্মাণ করে তার নাম দিল কাবায়ে ইয়ামনী। আর কাবাগৃহের নাম দিল কাবায়ে শামী। ইয়ামনবাসীকে ফরমান জারী করল, সকলেই কাবায়ে জেয়ারত ও তাওয়াফ করবে। এখানেই হজ্জ করা হবে। কেউ মক্কায় যেতে পারবে না।
মক্কার লোকেরা যেহেতু আবাহমান কাল থেকে কাবার খেদমত করে আসছে। কাজেই তারাই জানে কাবার খেদমত কিভাবে করতে হয়। তাই আবরাহা তার কাবার খিদমতের জন্য আরবের কাছে খাদেম চাইল। আরবরা একে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে কিছু সংখ্যক লোক কাবায়ে ইয়ামনের খিদমতের জন্য আবরাহার চাকুরী নিল।
এক রাতে তারা আবরাহার নির্মিত কাবা ঘরে মলমূত্র ত্যাগ করে উহাকে সম্পূর্ণ নাপাক করে পলায়ন করল। ঘটনাচক্রে সেই রাতে শীতের প্রকোপ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করেছিল। রাতে প্রচন্ড ঝড় শুরু হল। ফলে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঐ ঘরে পড়ে সম্পূর্ণ ঘর জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দিল। ফলে তারা ভয়ে রাতারাতি পলায়ন করল।
আবরাহা এ সংবাদ পেয়ে ক্রোধান্বিত হল এবং মক্কার পবিত্র খানায়ে কাবা ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এক বিরাট সৈন্য বাহিনী নিয়ে মক্কা অভিমুখী যাত্রা করল। বাহিনীতে মোট তেরটি জঙ্গী হাতী ছিল তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ হাতীর নাম ছিল মাহমুদ। স্বয়ং আবরাহা তার উপর সওয়ার হল। মক্কা শরীফের নিকটবর্তী হয়ে সে এক স্থানে অবস্থান করল।
এদিকে তার কিছু সৈন্য মক্কা পাঠিয়ে আরববাসীকে সাবধান করে দিল তারা যেন কেউ আবরাহার মুকাবিলা না করে। কেননা, আবরাহা শুধু কাবা ঘরকে ধ্বংস করতে আসছে আরববাসীর উপর কোন অত্যাচার করতে আসেনি। কিন্তু বাধা সৃষ্টি করলে তাদের বংশ নিঃবংশ করে দেবে।
এ হুমকী শুনে আবদুল মুত্তালিব সমগ্র মক্কাবাসীকে নির্দেশ দিল যে, তারা যেন বিভিন্ন পাহাড়ের গুহায় নিরাপদ স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদিকে আবরাহার সৈন্যরা লুটতরাজ আরম্ভ করল। আবরাহার সৈন্যরা আবদুল মুত্তালিবের দুশ উটও লুট করে নিয়ে গেল। আবদুল মুত্তালিব আবরাহার কাছে তাঁর উট ফিরিয়ে আনতে গেলেন। আবরাহা সিংহাসন হতে অবতরণ করে আবদুল মুত্তালিবকে নিজের পার্শ্বে বসিয়ে তার উপস্থিতির কারণ জিজ্ঞেস করল।
আবদুল মুত্তালিব তাঁর উটগুলো ফেরত চাইলো। বাদশাহ মুচকি হেসে বলল, আমি আপনাকে দর্শন করে ভেবেছিলাম আপনি একজন মহাজ্ঞানী। আপনার চেহারা দর্শনে আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আপনি কাবাগৃহের প্রতি হামলা না করার অনুরোধ করলে আমি আপনার অনুরোধ রক্ষা করব। আবদুল মুত্তালিব বলল, আমি উটের মালিক এজন্য উট নেয়ার জন্য এসেছি। কাবাঘরের মালিক আমি নই। এর মালিক যিনি তিনিই তা রক্ষা করবেন। তাঁর এ উত্তরে আবরাহা অবাক হয়ে গেল।
আবরাহা আবদুল মুত্তালিবের উটগুলো ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিল। আবদুল মুত্তালিব উট নিয়ে চলে গেলেন এবং মক্কার সরদারদেরকে নিয়ে কাবাঘরের গেলাফ ধরে আল্লাহর দরবারে সারা রাত কান্নাকাটি করলেন এবং পবিত্র ঘরের হিফাজতের জন্য দোয়া মুনাজাতের মাধ্যমে রাত কাটালেন।
পরিদিন আবরাহা তার সৈন্যবাহিনীকে বায়তুল্লাহ শরীফ আক্রমণের নির্দেশ দিল। সেও তার বাহিনী ওয়াদীয়ে মুহাচ্ছার নামক স্থানে উপনীত হল যা মুজদালাফায় অবস্থিত। তখন তার প্রধান হাতী মাহমুদ জমিনে বসে পড়ল শত চেষ্টা করেও হাতীকে সামনে অগ্রসর করাতে পারল না। এদিকে জিন্দার দিক হতে ছোট ছোট পাখি ঠোঁটে একটি ও দু পায়ে দুটি পাথর নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসতে দেখা গেল। এ পাখির ঝাঁককে কোরআনে “আবাবীল” বলা হয়েছে।
এ পাথরগুলোতে আবরাহার সৈন্য বাহিনীর প্রত্যেক সৈন্য ও হাতির নাম লিখিত ছিল। আবাবীল পাখির ঝাঁক তাদের মস্তকের উপর উপনীত হয়ে ঐ পাথরগুলো নিক্ষেপ করতে লাগল। যার নামে যেই পাথর, সেই পাথর তার মস্তকের উপর পড়ে পায়খানার রাস্তা দিয়ে বের হল।
পেটের নাড়ি ভুড়ি সম্পূর্ণ বের করে ফেলল এবং যে সওয়ারীর উপর উপবিষ্ট ছিল সেই সওয়ারীর পেট ফেড়ে বের হয়ে যমীনে পড়তে লাগল। এভাবে অত্যাচারী জালেম বাদশাহ আবরাহা ও তার সৈন্যদল নিপাত হয়ে গেল। তারপর সমুদ্র হতে জলোচ্ছ্বাস হয়ে আরবের মরুপ্রান্তে বন্যার পানি প্রবেশ করল এবং সেই বন্যার পানিতে ঐ সমস্ত মৃতদেহ ভাসিয়ে সমুদ্র বক্ষে ফেলে দিল।