শাদ্দাতের বেহেশত তৈরির কাহিনী
শাদ্দাদ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল আল্লাহর বেহেশতের মত একটি বেহেশত সে দুনিয়াতে তৈরি করবে। তার ভাগ্নে জোহাক তাজী তখন এক বিরাট রাজ্যের বাদশাহ ছিল। তদুপরি বাদশাহ জামশিদের বিশাল সাম্রাজ্য অধিকার করে সে প্রায় বিশ্বজয়ী বাদশাহর মর্যাদাও ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল। বাদশাহ শাদ্দাদ তার দূত মারফত খবর পাঠাল যে, হে আমার ভাগ্নে তোমার রাজ্যে যত স্বর্ণ-রৌপ্য এবং মূল্যবান লাল, মোতি ও জওহেরাত প্রভৃতি আছে, তা সব সংগ্রহ করে আমার দরবারে পাঠিয়ে দেবে ও মেশক আম্বর এবং জাফরানাদি যা কিছু আছে, তাও যেন পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমি দুনিয়ায় একটি বিরাট ও অনুপম বেহেশত তৈরি করতে চাই। সুতরাং আমার এ সকল দ্রব্যের একান্তই প্রয়োজন।
ভাগ্নে ছাড়া শাদ্দাদের অনুগত অন্যান্য যে সব রাজা-বাদশাহ ছিল তাদের নিকটও নির্দেশ পাঠাল যে, বাদশাহ শাদ্দাদ বেহেশত তৈরি করবে। সুতরাং তাদের যার যার দেশে যত সোনা ও মনি-মুক্তা, হীরা-জহরত আছে সব যেন সংগ্রহ করে শাদ্দাদের দরবারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সকলেই শাদ্দাদের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করল।
বেহেশতের স্থান নির্বাচনের জন্য সর্বত্র অসংখ্য লোক নিয়োগ করা হল। তারা বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখে অবশেষে আরব সীমান্তে ইয়ামন প্রদেশের একটি স্থানকে বেহেশত নির্মাণের জন্য উপযুক্ত বলে মনে করল এবং তা শাদ্দাদকে অবহিত করা হল। ঐ স্থানের আয়তন ছিল একশ চল্লিশ ক্রোশ।
বেহেশত নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন দেশ হতে হাজার হাজার সুদক্ষ কারিগর এসে হাজির হল। তাদের থেকে তিন হাজার সুদক্ষ কারিগর কাজে নিয়োগ করা হল। নির্মাণকার্য শুরু হওয়ার পর বাদশাহ শাদ্দাদ তার অধীনস্থ সকল রাজ্যের জনসাধারণের কাছে ঘোষণা করে দিল যে, যার নিকট যে কোন ধরণের স্বর্ণ-রৌপ্যের সন্ধান পাওয়া যায়, তবে তাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। দলে দলে লোক নিযুক্ত করল তল্লাশি কার্য চালাত।
একস্থানে এক বিধবা বৃদ্ধার নাবালিকা কন্যার কণ্ঠে মাত্র চারআনা রুপার তৈরি ক্ষুদ্র একটি অনলঙ্কার ছিল। এক তালাশকারীর চোখে পড়ায় সে এ গহনাটি এ বালিকার কণ্ঠ হতে ছিনিয়ে নেয়। দরিদ্র-দুঃখিনী বালিকাটি তার গহনার মায়ায় কেঁদে ধূলায় গড়াগড়ি দিতে লাগল। এ দৃশ্য দেখে বালিকার বৃদ্ধা মা দুঃখ বেদনায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাল। হে আমার রব। তুমি সবই অবগত। দুঃখিনীর প্রতি জালিম শাদ্দাদের অত্যাচারের দৃশ্য তোমার অদেখা নয়। তুমি ছাড়া আমাদের ফরিয়াদ শ্রবণ করার আর কেউ নেই। তুমি নিষ্ঠুর বাদশাহ শাদ্দাদকে ধ্বংস করে তোমার দুর্বল বান্দাকে রক্ষা কর। বৃদ্ধার এ আহাযারী করুণ প্রার্থনা দরবারে মঞ্জুর হয়েছিল।
এদিকে বাদশাহ শাদ্দাদের বেহেশত কাজ পুরাদমে চলছে। এ কাজে হাজার হাজার সুদক্ষ রাজমিস্ত্রি কারিগরি লিপ্ত হল। সর্বপ্রথম বিশাল ভূখণ্ডের চতুর্দিকে চল্লিশ গজ নিচ থেকে মর্মর পাথর দ্বারা বেহেশতের প্রাসাদের ভিত্তি স্থাপন করা হল। তার উপর স্বর্ণ-নির্মিত ইট দ্বারা প্রাচীর নির্মান করা হল। প্রাচীরের উপরের জবরজদ এবং জবরজদ পাথরের ভীম ও বর্গার উপরে লাল বর্ণের আলমাছ প্রস্তর দ্বারা ঢালাই করে ছাদ নির্মাণ করা হল। মূল প্রাসাদের ভিতরে অসংখ্য অট্টালিকা সোনা ও রূপা দ্বারা প্রস্ত ইট দ্বারা তৈরি করা হল। যেমনই বিস্ময়কর তেমনই অভাবনীয় সৌন্দর্য মণ্ডিত ও বটে। সে বেহেশতের কথা আল্লাহ পাক স্বয়ং পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন যে, হে মুহাম্মাদ! শাদ্দাদ পৃথিবীতে এমন বেহেশত নির্মাণ করেছিল পৃথিবীর আর কোন বাদশাহ কোনদিনই তেমন প্রাসাদ নির্মণ করতে পারেনি। হে মুহাম্মাদ! তুমি তো দেখনি তোমার প্রতিপালক সে বিরাট প্রাসাদ নির্মাণকারীদের সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছেন।
শাদ্দাতের সে বেহেশতের মাঝে নির্মাণ করা হয়েছিল সোনা ও রূপার দ্বারা অপূর্ব বৃক্ষসমূহ। তার শাখা-প্রশাখাগুলো তৈরি হয়েছিল ইয়াকুত পাথর দিয়ে আর পত্রপল্লবসমূহ নির্মাণ হয়েছিল ছঙ্গে জবরজদ দিয়ে। এ বৃক্ষসমূহে মূল্যবান মণি, মুক্তা ও হীরা-জহরতের তৈরি বিভিন্ন ধরণের ফল শোভা পাচ্ছিল। বেহেশতে মাটির পরিবর্তে শোভা পাচ্ছিল মেশক আম্বর এবং তার মাঝে তৈরি হয়েছিল মূল্যবান পাথর দিয়ে এ পাথরসমূহ গাঁথুনির জন্য ব্যবহারিত হয়েছিল সুরখীর বদলে মোতি মুক্তা ও চুন্নী পান্নাসমূহ। বেহশতের প্রাঙ্গন ঢালাই করা হয়েছিল মণি-মুক্তা দিয়ে এবং স্থানে স্থানে পয়ঃপ্রণালী নির্মাণ করে তা দ্বারা সর্বদা দুগ্ধ, শরাব এবং মধু প্রবাহিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বেহেশতের দরজার নিকটে চারটি বিরাট ময়দান তৈরি করে ওতে রং-বেরঙয়ের মেওয়াদার বৃক্ষ লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। এ বৃক্ষগুলো অপূর্ব সুন্দর পরিপক্ক মেওয়াজাত ফল এবং নানাবিধ ফুল শোভা পাচ্ছিল। ময়দানসমূহের প্রত্যেকটিতে লক্ষাধিক সোনার কুরসী স্থাপন করা হয়েছিল। প্রত্যেকটি কুরসীর সামনে একটি করে টেবিল পেতে তাতে বিভিন্ন প্রকারের নিয়ামতসমূহ সাজিয়ে রাখা হয়েছিল।