আব্দুর রহমান জামী

ইরানের খোরাসান প্রদেশের একটি ছোট শহর। নামতার জাম। এই শহরে মোল্লাহ নূরউদ্দিন আবদুর রহমানের জন্ম হয়। দিনটি ছিল ৭ই নভেম্বর। আর সাল ছিল ১৪১৪। জন্মভূমি জাম থেকেই তিনি জামী উপাধ পান এবং এই নামেই বিখ্যাত হন।

তাঁর পিতা ছিলেন একজন নামকরা পন্ডিত ব্যক্তি। পিতার কাছেই তিনি আরবী ফার্সি ভাষা শেখেন। তিনি তফসিরে কোরআন, হাদিস, ফিকাহ ও আরবী ব্যাকরণ পিতার কাছ থেকেই ভালাভাবে আয়ত্ব করেন।

পিতার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ সম্পর্কে জামী বলেন, আমি যদি সত্যিই কারও ছাত্র হই, তবে তা আমার পিতার। কারণ তিনিই আমাকে ভাষা শিক্ষা দেন। ছোটবেলায় জামী খুবই দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন। বিদ্যালয়ের বাঁধা ধরার মধ্যে তিনি হাঁপিয়ে উঠতেন। সুযোগ পেলেই তিনি পালিয়ে গিয়ে খেলাধুলা করতেন। তাঁর বুদ্ধি ছিল অত্যন্ত প্রখর। মেধা ছিল তীক্ষ্ন আর স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। এ কারণেই ছোট বেলা থেকেই তিনি সহজেই কঠিন পড়া মুখস্ত করতে পারতেন।

কোন সময় দেখা গেল তিনি পথে বসে খেলাধুলা করছেন। এদিকে বিদ্যালয়ে যাবার সময় হয়ে গেছে। অথচ তিনি বিদ্যালয়ের পাঠবই খুলেও দেখেননি। কাজেই তার পাঠ মুখস্থ হয়নি। হঠাৎ তিনি কোন সহপাঠির কাছ থেকে বই কেড়ে নিয়ে সেদিনের পাঠ দেখে নিলেন। তারপর ক্লাসে সুন্দরভাবে পড়া দিলেন। এতে সকলেই মুগ্ধ হয়ে যেত। এরকম ঘটনা তাঁর জীবনে বহুবার ঘটেছে।

তিনি ইতিহাস, দর্শন, সুফীতত্ত্ব, কবিতা রচনা, ছন্দ প্রকরণ ও সঙ্গীতে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। মোলআ জুনায়েদ ও খাজা আলী সমরকান্দী ছিলেন তাঁর প্রধান দু’জন শিক্ষখ। জামী এতই প্রতিভাবান ছাত্র ছিলেন যে খাজা আলীর কাছ থেকে ৪০টি পাঠ নিয়ে তাঁর শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তিনি সমরকন্দের কাজী রুমের মত পন্ডিত ব্যক্তির কয়েকটি বক্তৃতা শুনেই তাঁর সঙ্গে বিতর্কে লড়েন এবং শিক্ষককে পরাজিত করেন। উদারমনা শিক্ষক কাজী রুম এতে কোন অপমান বোধ করেননি। বরং তিনি এমন প্রতিভাবান ছাত্র পেয়ে গৌরববোধ করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, সমরকন্দ শহরের পত্তন হওয়ার পর জামীর মত এতবড় পন্ডিত আর কখনো আসেননি।

 

ছোট বেলা থেকেই জামী পীর দরবেশদের খুবই ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। যারা আল্লাহর ভালবাসায় মতোয়ারা হয়ে দুনিয়ার সাময়িক সুখ বর্জন করেন এমন লোকরা তার কাছে প্রিয় ছিল। এজন্যে সুযোগ পেলেই তিনি ওলি দরবেশের সাথে সময় কাটাতেন। জাম তখন শিশু। তার আব্বা একজন প্রসিদ্ধ দরবেশের কোলে তাকে তুলে দিয়ে তাঁর দোয়া কামনা করেছিলেন।

জামী তখন যুবক। এ সময় অনেক নামকরা সুফীর সাথে তিনি ‍উঠাবসা করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, শাম্‌সউদ্দিন মোহাম্মদ আসাদ ও ওবায়দুল্লাহ আহরার। তিনি বিখ্যাত সাধক আল সাদ আদ দীনের হাতে দীক্ষা নেন। তাঁর শিক্ষক তাকে তাসাউফের শিক্ষা দান করেন। জামী একজন সত্যিকার সাধকের মতই সব ধরনের কৃচ্ছতা অবলম্বন করে সহজ সরল জীবন যাপনের অভ্যাস করেন। সাদ আল দীন তাঁর সাধনায় মুগ্ধ হয়ে তাকে আবার লোকজনের সাথে মেলামেশার অনুমতি দেন।

জামী একবার হজ্বের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। প্রথমেই তিনি বাগদাদে এলেন। তাঁর বিরোধী পক্ষের লোকজন তাকে শায়েস্তা করার জন্র তাঁর কবিতার অংশ বিশেষ বিকৃত করেন তার বিরুদ্ধে জোরপ্রচার চালায়। ফলে জামীকে এক বিরাট সভায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলতে হয়। বাগদাদের শাসক এই সভা পরিচালনা করেন এবং এতে উপস্থিত ছিলেন, হানাফী, শাফেয়ী ও শিয়া সম্প্রদায়ের পন্ডিত ব্যক্তিগণ। তাঁর শত্রুপক্ষ কবিতাটি পাঠ করলে তিনি আসল কবিপা পাঠ করেন। তাদে ধরা পড়ে যে শত্রু পক্ষ আসল কবিতাটির প্রথম ও শেষ অংশ বাদ দিয়ে এমন একটি অংশ জুড়ে দিয়েছে যাতে বাগদাদের জনসাধারণকে সহজেই ক্ষেপানো যায়। জনগন আসল কবিটাটি শুনে খুশি হল এবং কবিকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করলো।

জামী বাগদাদে ৪মাস থাকার পর মক্কা শরীফের দিকে রওয়ানা হলেন। পথে প্রত্যেক শহরেই কবিকে বিশেষ সম্বর্ধনা জানানো হয়। আলেপ্পোতে থাকাকালে জামী পাঁচহাজার স্বর্ণমুদ্রাসহ বহু উপহার সামগ্রী পান। তুরষ্টের সুলতান দ্বিতীয় বায়যিদ এসব উপহার পাঠিয়েছিলেন। জামী তাব্রিজ যান। সেখঅনকার শাসক হাসান বেগও কবিকে সেখানে থেকে যাওয়ার জন্য বহু অনুরোধ জানান। কবি বৃদ্ধা মায়ের সাথে দেখা করার কথা জানিয়ে তাব্রিজ ত্যাগ করে খোরাসানে ফিরে আসেন। কিন্তু খোরাসানেও তার রেহাই নেই। চারদিক থেকে রাজা বাদশাহ আর সর্বস্তরের মানুষ কবিকে অজস্র উপহার সামগ্রী পাঠাতে লাগলেন। সাধক কবি জামী ভক্তদের ভালবাসার অত্যাচার থেকে বাঁচার আশায় হিরাতের এক নির্জন স্থানে চলে যান এবং এক মনে আল্লাহর বন্দেগীতে মশগুল হন। এভাবে নির্জন স্থানে থাকা কালে ১৪৯২ সালের ৯ই নভেম্বর ৭৮ বছর বয়সে জামী ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের খবরে খোরাসানে মানুষ শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অনেক যত্ন ও তাজিমের সাথে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। অনেক রাজা বাদশাহ, আমীর ওমরাহ, আলেম ও মুফতী সহ লাখ লাখ লোক তার জানাযায় শরীক হন।

জামী একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন। তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তিনি একজন অসামান্য পন্ডিতও ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে বিখ্যাত পন্ডিত নাসুলীজ বলেছৈন, কেবল কবি হিসেবেই নয়, পন্ডিত হিসেবে বিবেচটনা করলে একথা বলা যায়, জামী একজন অসামান্য প্রতিভাদীপ্ত পন্ডিত ছিলেন।

জামী তার পীর ও মারেফাতের শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করতেন। তিন সমসাময়িক কবিদের মতো কখনো ধনী বা ক্ষমতাশালীদের দুয়ারে ধন্না দেননি বা চাটুকারদের মতো সুলতান বা আমীরদের প্রশংসা করে কোন কবিতা লিখে তাদের দয়া প্রার্থনা করেননি। কবি জামী তাঁর জীবিতকালেই সে সময়কার রাজাবাদশাহ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের ভালবাসা, ভক্তি ও শ্রদ্ধা লাভ করেছেন। কিন্তু এতে কিছুর পরেও কিন্তু গরীব দুঃখী মানুষকে ভুলতেন না। তিনি তাদের দুখ দূর করার জন্য অকাতরে দান করতেন।

 

জামী বিভিন্ন বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত তুহফা ই সামী গ্রন্থে তাঁর লিখিত ৪৬টি গ্রন্থের উল্লেখ আছে। তিনি শেখ সাদীর গুলিস্তার অনুকরণে ‘বাহারিস্তান’ (বসন্তের দেশ) নামে একটি বিখ্যাত গদ্যগ্রন্থ ১৪৮৭ সালে রচনা করেন। এতে ৮টি রওযা (উদ্যান) নামে অধ্যায় আছে প্রত্যেক রওযায় সুফী ও দরবেশ, দার্শনিক ও জ্ঞানী, সুলতান খলিফাদের ন্যায় বিচার, দানশীলতা, পেম রসিকতা ও বাকপটুতা, কবি ও অবোধ প্রাণীদের সম্পর্কে মনোরম ও চরমৎকার কাহিনী বর্ণিত আছে। বইটি গুলিস্তাঁর মতই গত্য ও পদ্যের সংমিশ্রণে লিখিত।

জামীল ‘লওয়ায়ীহ’ একটি বিখ্যাত বই। এতে তিনি আল্লাহর প্রেমিকদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি পার্থিব জ্ঞানের তুচ্ছতা ঘোষণা করে আল্লাহর পথেই জ্ঞান বিকাশের মহিমা গেয়েছেন। তিনি বলেন,

ছায়াবাজির মিথ্যা খেলায় মত্ত তুমি আজ

তাঁর হুকুমে মিলিয়ে যাবে তোমায় দিয়ে লাজ।

সঁপো হৃদয় তাঁর নিকটে নেইকো যাহার লয়

সকলকালে থাকবে যিনি হয়ো তোমা-ময়।

জামী সাতটি মসনবী কাব্য এবং তিনটি দিওয়ান বা গযল কবিতা সংগ্রহ রচনা করেন। সাতটি মসনবী কাব্যের ১টি হচ্ছে সিল সিলাতুল যাহাব। এতে সাতহাজার দুশো বয়েত আছে। এতে দার্শনিক, নৈতিক ও ধর্মীয় জ্ঞান বিষয়ক বহু উপাখ্যান আছে। আছে দ্বিতীয় কাব্য হচ্ছে সলমান ওয়া আবসাল। এটি একটি অনন্য সাধারণ রূপক কাব্য। এতে নশ্বর বিকৃত প্রেমের বন্ধনমুক্ত স্বর্গীয় অবিনশ্বর প্রেমের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। তৃতীয় কাব্য হচ্ছে, “তুহ্‌ফাতুল আহ্‌রার।” এটি একটি নীতিগর্ভকাব্য। তাঁর চতুর্থকাব্য হচ্ছে ‘সবহাতুল আবরার’ (ধার্মিকের জপমালা)। এটিও দার্শনিক, নৈতিক ও মিষ্টিক ভাবপ্রধান কাব্য। পঞ্চম কাব্য হচ্ছে, ইউসুফ ওয়া জুলায়খা। এটি একটি শ্রেষ্ঠ প্রেমমূলক কাব্য এবং সবচেয়ে বেশী প্রচারিত ও সমাদৃত। ষষ্ঠ কাব্য হচ্ছে লায়লা ওয়া মজনু এবং সপ্তম কাব্য হচ্ছে, খিরদ নামা-ই-সিকান্দারী।

 

জামীর কবিতা সম্পর্কে পন্ডিত মির্জা বিহরুজ বলেন, জামীর কবিতা নিজামীর কবিতা সমক্ষ। কাব্যরূপ, মাধুর্য ও সারল্যে তার কবিতা অসাধারণ। তাঁর কবিতা অনায়াসে সকলে পড়তে পারে। এজন্য তিনি ইরানের বাইরেও জনপ্রিয়। অপরদিকে নিজামীর কবিতা বুঝতে হলে ফার্সি ভাষায় গভীর জ্ঞান থাকতে হয়। পন্ডিত লোক ছাড়া অন্য কেউ নিজামীর কাব্যের মর্ম বুঝতে পারবে না।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!