এক হাজার বছর আগেকার কথা। হাইয়ান তখন কুফা নগরীর চিকিৎসক। কুফা ইরাক দেশে অবস্থিত। উমাইয়া শাসনের রাজধানী তখন কুফা। উমাইয়া বংশের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ ভাব। তাই মাতৃভূমি দক্ষিণ আরব ছেড়ে কুফায় এলেন তিনি। মনে দুনিয়ার অশান্তি। মাথায় তাঁর রাজ্যের চিন্তা কিভাবে উমাইয়া রাজতন্ত্রের অবসন ঘটানো যায়। এই ইচ্ছা পূরণের জন্য সংগ্রাম চালাতে হাইয়ান সপরিবারে তুস নগরের দিকে যাত্রা করলেন। সেই সময় তাঁর একটি ছেলে সন্তান ভূমিষ্ট হয়।
ছেলেটির নাম রাখা হয় জাবীর ইবনে হাইয়ান। মা বুকের মাঝে আগলে রাখলেন। মায়ের আদর আর বাপের স্নেহ দুই-ই পেলেন জাবীর। কিন্তু পাবের স্নেহ তাঁর ভাগ্যে বেশি দিন মিললো না। হাইয়ানের ষড়যন্ত্রের কথা খলিফা জানতে পারলেন। খলিফা হাইয়ানকে ধরে আনলেন এবং মৃত্যুদণ্ড দিলেন।
অসহায় শিশু জাবীরকে নিয়ে মা যাত্রা করলেন দক্ষিণ আরবে। সাধারণ শিশু পরে সারা মুসলিম জাহানে পরিচিত হন একজন রসায়নবিদ হিসেবে। জাবির ইবনে হাইয়ান তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন দক্ষিণ আরবের স্থানীয় বিদ্যালয়ে। ইয়েমেনের নাম করা গণিত শিক্ষক হারবী আল হিমারী তাঁকে গণিত শিক্ষা দেন। চিকিৎসকের ছেলে জাবীর। তাই চিকিৎসার উপরও জ্ঞানলাভ করলেন তিনি অনেক।
তখনকার দিনে বর্তমান যুগের মতো বড়ো বড়ো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো না। সুযোগ-সুবিধাও ছিলো কম। যাঁরা জ্ঞান পিপাসু তাঁরা অনেক কষ্ট করতেন। কষ্ট ও মেহনত করে তাঁদের জ্ঞান আহরণ করতে হতো। বহুদুর দেশ পাড়ি দিতে হতো তাঁদেরকে।
জাবীর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ফেললেন। এতে তাঁর সাধ মিটলো না। তাই তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য দক্ষিণ আরব ছেড়ে পায়ে হেঁটে চলতে লাগলেন। সেই ধু ধু বালুময় পথে। কখনো মরুভূমি, কখনো পাহাড়-পর্বত, বনজংগল পেরিয়ে পথ হাঁটছেন তো হাঁটছেনই। বুকে তাঁর অনেক আশা। তাই পথের কোন বিপদই তাঁকে ঠেকাতে পারলো না। অবশেষে অনেক পথ হেঁটে পিতার কর্মস্থল কুফা নগরীতে এসে হাজির হলেন।
ইমাম জাফর আস সাদিক তখন কুফার বড়ো জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি জাবীরকে সাধ্যমত বিদ্যা শিক্ষা দিলেন। কিন্তু এতেও তাঁর মন শান্ত হলো না –তৃপ্তি পেলেন না। তিনি যন্ত্রপাতি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। হাতে কলমে রসায়নের বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করলেন তিনি। অতঃপর তিনি ‘নাইট্রিক এসিড’ আবিস্কার করলেন। ইমাম জাফর আস সাদিকের কাছেই জাবির রসায়নশাস্ত্র শেখেন। রসায়ন চর্চা করে তিনি অনেক খ্যাতি অর্জন করেন।
ইমাম জাফরের সাথে পরিচয়ে জাবিরের অনেক লাভ হয়। তাঁরই চেষ্টায় তিনি শাহী দরবারের নেক নযরে পড়েন। তখন ঘটে একটি চমৎকার ঘটনা। খলীফা হারুন অর-রশীদের উযিরে আযম ইয়াহিয়ার এক সুন্দরী বাঁদী ছিলো। একবার বাঁদীর কঠিন অসুখ হয়। দেশ বিদেশ থেকে অনেক হেকিম ডাকা হলো তাঁর চিকিৎসার জন্য। সবাই একে একে করলেন। কিন্তু সে অসুখ কিছুতেই সারে না। কেউ সারাতেও পারলেন না। শেষে ডাক পড়ে জাবিরের। আর তাঁর সুচিকিৎসায় বাঁদীর অসুখ একদম সেরে যায়। ফলে জাবির উযিরের আপন জন হয়ে পড়েন। আর সেই সুযোগে তিনি খলীফা হারুন অর-রশীদেরও সুনজরে পড়েন। জাবির খুব খুশি। এবার কুফা ছেড়ে তিনি বাগদাদে চলে আসেন। সেখানে একদিকে চলে তাঁর ডাক্তারী আর এক দিকে চলে বিজ্ঞানের নানান বিষয় নিয়ে গবেষণা।
কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই রাজনীতির নানা রকম খেলা শুরু হলো সেখানে। জাবিরের রাজনীতি ভালো লাগে না। তবুও দুষ্ট লোকেরা চক্রান্ত করে তাঁকে জড়িয়ে ফেলে। খলীফা তাঁকে দুশমন ভাবলেন। তিনি রাজদ্রোহী বলে সাব্যস্ত হন।
জাবির মহাভাবনায় পড়ে গেলেন। তিনি জানেন রাজদ্রোহীর একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। জান বাঁচানোর উপায় খুঁজতে থাকেন তিনি। অনেক ভাবনার পর উপায় না দেখে তিনি কুফায় পালিয়ে গেলেন। কুফায় তিনি বসবাস শুরু করেন। এবং বিজ্ঞান সাধনায় মনোযোগ দেন।
তাঁর জীবন ছিলো এতোদিন কষ্টের আর সংগ্রামের। কুফায় ফিরে এসে তিনি পেলেন শান্তি। এখানে তিনি গড়ে তুললেন একটি ল্যাবরেটরি –গবেষণাগার। তিনি নিজেই গবেষণা করবেন এতে। ল্যাবরেটরী ছাড়া বিজ্ঞানের গবেষণা ভালো চলে না।
কুফায় তিনি যে ল্যাবরেটরি তৈরী করেন সেটাই ছিলো দুনিয়ার প্রথম বিজ্ঞান গবেষণাগার। জীবনের শেষ দিনপর্যন্ত জাবির এই ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানের সাধনা করেছেন।
পরবর্তী জীবনে জাবির একদিকে ডাক্তার আর এক দিকে রসায়নবিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু তিনি শুধুমাত্র এই দুটি বিষয় নিয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দেন নি। আরো নানা রকম বিষয়ে তিনি গবেষণা করেছিলেন। সে কারণেই তাঁর খ্যাতি ছিরো দুনিয়াজোড়া।
জাবির ডাক্তারী আর রসায়নসহ নানা বিষয়ের উপর বহু বই লিখেছেন। তাঁর এসব বইয়ের বিষয় ছিলো চিকিৎসা, রসায়ন, খনিজ পদার্থ, বিশেষ করে নানা রকম পিাথর এবং দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি।
শুধুমাত্র ডাক্তারীর উপর তিনি বই লেখেন পাঁচ শ’র মতো। তাঁর লেখা ডাক্তারী বইগুলোতে ছিলো ঔষধ বানানোর কায়দা-কানুন, রোগ ধরবার উপায়, ঔষধ নির্বাচন ও এ্যানাটমি সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব জ্ঞানের অনেক কথা। এতে আরো ছিলো চিকিৎসা সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বিবরণ। এমনকি বিষের উপরেও তাঁর লেখা একখানি বই ছিলো। বইটির নাম আল-জহর।
ধারণা করা হয় তাঁর নিজের চিন্তাভাবনা আর গবেষণার ফলে চিকিৎসা বিষয়ের উপর এতো বই লেখা সম্ভব হয়েছে যা বিশে আজও সমাদ্রিত। তবে চিকিৎসার উপর এতো বই লিখলেও এবং পেশায় তিনি ডাক্তার হলেও আসরে রসায়নবিদ হিসেবে ছিলো তাঁর নামডাক।
প্রতিনি ধাতুরই বিশেষ বিশেষ গুণ আছে, কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। জাবির এ সবের কথা ভালোভাবে জানতেন। গ্রীক দেশের বিজ্ঞানীরা তাঁর আগে এ সকল জিনিস নিয়ে সবচেয়ে বেশী গবেষণা করেছিলেন। তাঁদের জ্ঞান থেকেও এ সকল বিষয়ে জাবিরের জ্ঞান ছিলো আরো বেশী।
গ্রীক বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকেও তাঁর গবেষণা ছিলো অনেক উন্নত। এর জন্য তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা ইউরোপে। ইউরোপ যখন রসায়ন শিক্ষায় খুব উন্নত তখনও সেখানকার বিজ্ঞানীরা ধাতু সম্পর্কেত তাঁর মতামত এক কথায় মেনে নিয়েছেন। আজ থেকৈ দু’শ বছর আগেও সেখানে তাঁর নামডাক ছিলো।
খনি থেকে তোলা কোন ধাতুই সব সময় একেবারে খাঁটি অবস্থায় পাওয়া যায় না। তার সাথে প্রায়ই কিছু আজে বাজে জিনিস মিশে থাকে। এসব বাদ দিয়ে কিভাবে আসল ধাতুটুকু বের করে নিতে হয় জাবির তা প্রথম দুনিয়াকে জানান। তাঁর এই জ্ঞান লোহার বেলায় তিনি সবচেয়ে বেশী কাজে লাগিয়েছেন আর এসবের কথা তিনি তাঁর বইপত্রে লিখে রেখে গেছেন। তাঁর বইয়ে এমনি আরো অনেক জিনিস তৈরীর নিয়মকানুন লেখা আছে।
কাপড় আর চামড়ার জন্যে পাকা রং, ওয়াটার প্রুফ কাপড়ে আর লোকার মরচে ধরা পরিস্কার করা, বার্নিশ, চুলের নানা রকম কলপ ইত্যাদি তৈরীর কথা ও কৌশলও লেখা আছে তাঁর বইয়ে।
লেখার জন্য কম খরচে পাকা ও উজ্জ্বল রংয়ের কালি তৈরী করা হতো।
কাঁচ তৈরীর কৌশল তিনিই আবিস্কার করেছিলেন। রসায়নের গবেষণার কাজে লাগে এরূপ এ্যাসিটিক এসিড, নাইট্রিক এসিড তৈরীর কৌশলও তিনি আবিস্কার করেছিলেন।
জাবিরের একটা বড়ো গুণ ছিলো। তিনি লবণ তৈরী করতে পারতেন। প্রথমে তিনি লতাপাতা আর একটা জিনিস পুড়িয়ে ছাই করে পটাশ আর সোডা তৈরী করতেন। পটাশ আর সোডা এসিডের সাথে মিশিয়ে তিনি লবণ তৈরী করেছিলেন। গন্ধককে খারের সংগে তাপ দিয়ে সিলভার অব সালফার এবং মিল্ক অব সালফার তৈরীর কৌশলও তিনি আবিস্কার করেন।
গবেষণা কাজে ব্যবহৃত হয় এমন ধাততু যেমন সাইট্রিক এসিড, আর্সেনিক, এ্যন্টিমনি, সিলভার নাইট্রেট, কিউপ্রিক ক্লোরাইড ইত্যাদি জিনিসের জ্ঞানও তাঁর যথেষ্ট ছিলো। তাছাড়া রসায়নের গবেষণা কাজে তিনি এসব জিনিস ব্যবসারও করেছেন এবং ভিট্রিওল, ফিটকিরি, সল্টফিটার ইত্যাদি অনেক রসায়নিক জিনিস তিনি তৈরী করতে পারতেন।
জাবির বলেছিলেন, রসায়নে গবেষণা করা চাট্টিখানি কথা নয়। রাসয়নবিদদের সবচেয়ে বড়ো কাজ হচ্ছে হাতে-কলমে কাজ করা আর তার পরীক্ষা চালানো। হাতে কলকে কাজ না করলে কিংবা নিজে পরীক্ষা না চালালে রসায়ন নিয়ে পড়াশোনায় কোন ফায়দা হয় না। তাই সব ব্যাপারেই পরীক্ষা চালাতে হবে। তবেই পাওয়া যাবে সেই বিষয় সম্পর্কে পুরো ধারনা বা জ্ঞান।
জাবির আরো বলেছিলেনঃ আমার ধন-দওলত, টাকা-পয়সা আমার ছেলেরা ভাইয়েরা ভোগ করবে। কিন্তু জ্ঞানের সাধনা করে আমি যা পেয়েছি, লোকে আমাকে কেবল তারই জন্যে স্মরণ করবে।
রকেট। রকেটের নাম কে না শুনেছে। মানুষ রকেটের সাহায্যে মহাশূন্যে পাড়ি দিচ্ছে। এটম বোমা –এই বোমা দ্বারা পৃথিবীকে করা যায় ধ্বংস। মানুষ ইচ্ছে করলে তা দিয়ে পারে বিশ্বকে নতুন করে গড়তে। রসায়ন নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা করে আজ বিজ্ঞানীরা এগুলো আবিস্কার করেছেন।
অনেক আরব বিজ্ঞানী এই রসায়নের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করে অমর হয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে থেকে সবার আগে নাম করতে হয় জাবির ইবনে হাইয়ানের। তাঁর জ্ঞান সাধনা থেকেই আরব জগতে রসায়ন গবেষণা শুরু হয়। এমন কি তিনি সম্ভবত সারা দুনিয়ারই প্রথম রসায়নবিদ-বৈজ্ঞানিক।
তাঁর জ্ঞান সাধনা দেখে কে না অবাক হবে। আরো অবাক হবার মতো ব্যাপার, জাবির ছিলেন চিকিৎসকের ছেলে। কিন্তু তিনি কিনা চিকিৎসক না হয়ে হয়েছিলেন বিজ্ঞানী। বর্তমান বিশ্বের বিজ্ঞানীর আজও তাঁর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। রসায়ন বিজ্ঞানের উপর তাঁর দেয়া পদ্ধতি এখনো গবেষণা কাজে ব্যবহৃত হয়। তোমরা বড়ো হয়ে যখন রসায়ন বিজ্ঞানের গবেষণা ও নানা রকম পরীক্ষা চালাবে তখন বুঝতে পারবে বিজ্ঞানে জাবিরের অবদান কত বেশী। তোমাদের জন্য কত কি আব্সিকার করে গেছেন মহান বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান।
এই মহান বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান ৮০৪ খৃষ্টাব্দে ইনতিকাল করেন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।