মহান দার্শনিক

মুসলিম জাহানের একটি দেশ। নাম ইরান। আগে দেশটির নাম ছিলো পারস্য। সেই ইরান দেশের একটি দেশ খোরাসান। খোরাসান প্রদেশের তুস জেলা। জেলার দু’টি শহর তাহেরান এবং তাকান। তাহেরান শহরের একটি ছেলে। নাম তাঁর আল-গাযযালী (রঃ)। পুরা নাম আবু হামিদ মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে তাওস আহম্মদ আল তূসী আল সাফী আল নিশাপুরী।

ছোটবেলা থেকেই আল-গাযযালী (রঃ) একটু ভিন্ন রকম ছিলেন। একা এবং নিরিবিলিতে থাকতে তাঁর বেশী ভালো লাগতো।

তাঁর আব্বা ছিলেন খুবই পরহেজগার লোক। সব সময় পাক পবিত্র থাকতেন। সময় পেলেই কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আল গাযযালী (রঃ) তখনও শিশু। তাঁর পিতা ইনকিতাল করলেন। পিতার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে মা দুটি সন্তান রেখে মারা যান। পিতা নাবালক ছেলে দু’টিকে এক পরহেজগার বন্ধুর কাছে রেখে যান। বন্ধুর হাতে কিছু টাকা দিয়ে তাঁকে অনুরোধ করলেন এই টাকা দ্বারা তাঁদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতে।

বেশী টাকা পয়সা তিনি রেখে যেতে পারলেন না। কারণ তাঁদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলো না।

পিতার বন্ধুর নিকট আল-গাযযালী (রঃ)-র প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হলো। পড়াশোনায় তিনি ছিলেন খুবই মনোযোগী। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর অনেক কিছু শেখা হয়ে গেলো। সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ মুখস্থ করা ছাড়াও হাদীস শরীফ পাঠেও তিনি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। অল্প বয়সেই ভালো ছাত্র হিসেবে তাঁর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

শুধুমাত্র ওস্তাদের নিকট বই পড়েই তিনি সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন না। জীবন, জগত ও প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি চিন্তা করতেন গভীরভাবে। তিনি যে বিষয়ে পড়াশোনা করতেন তা শেষ না করে থামতেন না। পিতার বন্ধু তাঁর জ্ঞান পিপাসা দেখে অবাক হয়ে যেতেন। তিনি দু’হাত তুলে তাঁর জন্য আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করতেন।

এবার তাঁর উচ্চ শিক্ষার পালা। সেই সময়ে স্কুল কলেজ খুব বেশী ছিলো না। নামকরা ওস্তাদগণ নিজেদের বাড়ীতে অথবা মসজিদে ছাত্রদের শিক্ষা দান করতেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মসজিদেই সব কিছু হতো, শিক্ষা বলো, বিচার বলো, দেশ শাসন বলো, সকল কিছুই মসজিদে হতো। ধনী লোকেরা সে রকম শিক্ষায় অর্থ সাহায্য করতেন, ছাত্রদের থাকা-খাওয়ার খরচও তাঁরা বহন করতেন।

 

সবেমাত্র তাঁর আঠার বছর বয়স। আল-গাযযালী (রঃ) উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য পায়ে হেঁটে জুর্জান প্রদেমে হাজির হলেন।

সেই সময়ে শিক্ষাদানের একটা নিয়ম ছিলো। শিক্ষক ক্লাসে যা পড়াতেন ছাত্ররা তা লিখে রাকতো। এ রকম লিখে রাখা খাতাকে নোট বই বলা হয়।

একদিন জুর্জান প্রদেশ থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ী ফেরার পথে ডাকাত দল বালক গাযযালীকে (রঃ) আক্রমণ করলো। ডাকাতরা তাঁর দেহ তল্লামী করে তাঁর নিকট থেকে সব কেড়ে নিলো। ডাকাতরা তাঁর নোটবইগুলোও কেড়ে নিলো। আল-গাযযালী (রঃ) এতে খুবই দুঃখিত হলেন; কিন্তু ভয় পেলেন না। কিছুক্ষণ পর সাহস করে তিনি ডাকাত সরদারের কাছে নোট বইগুলো ফেরত চাইলেন। ডাকাত সরদার তাচ্ছিল্যের স্বরে বললোঃ ওহ তোমার বিদ্যা তো আমার হাতে! তুমি তো এখন বিদ্যাহীন। বিদ্যা পুস্তকে রেখেও বিদ্বান হওয়া যায় নাকি? যাও, তোমার নোটবইগুলো নিয়ে যাও।

 

গাযযালী (রঃ) ডাকাত সরদারের কথায় লজ্জিত ও অনুতপ্ত হলেন। বাড়ী ফিরে রাত দিন পড়ার কাজে পরিশ্রম করতে লাগলেন। অবশেষে তিন বছরের মধ্যে তিনি সমস্ত নোট মুখস্থ করে ফেললেন।

১০৭৭ সাল। আল-গাযযালী (রঃ)-এর বয়স তখন বিশ বছর। আরও উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি নিশাপুরে হাযিল হলেন। তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান ছিলো নিশাপুর। বাগদাদের নিযামিয়া মাদ্রাসার মতো নিশাপুরের বায়হাকিয়া মাদ্রাসারও তখন খুব নাম ডাক। এটি ছিলো ইসলাম জগতের সর্বপ্রথম মাদ্রাসা। দেশ বিদেশের বহু ছাত্র এখানে এসে পড়াশোনা করতো।

ইমামুল হারামাইনের মুসলিম বিশ্বের প্রসিদ্ধ বুযুর্গ ও আলেম। আল-গাযযালী (রঃ) মনের মস্ত দরদ আর ভালোবাসা দিয়ে এ বুযুর্গ আলেমের নিকট জ্ঞান সাধনা করতে থাকলেন। জ্ঞান অর্জনে তাঁর আগ্রহ আর অসাধারণ প্রতিভা অল্প দিনের মধ্যেই ইমামুল হারামায়েনের নজরে পড়লো। আর কেনই বা পড়বে না? তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান সাধক। আল-গাযযালী (রঃ)-এর মতো প্রতিভাকে চিনতে তাঁর ভুল হবে কেন? তাঁর দিকে তিনি আরো মনোযোগ দিলেন। ফলে অল্প দিনের মধ্যে তিনি মুসলিম জাহানের এক বড় প্রতিভা হিসেবে সুনাম অর্জন করলেন। তখন আল-গাযযালী (রঃ)-এর মতো এত বড়ো আলেম আর একজনও ছিলেন না।

আল-গাযযালী (রঃ) পরবর্তীকালে মস্ত বড়ো আলেম, মুহাদ্দিস, মুফাছছির ও ইসলামী দর্শনবিশারদ হয়েছেন।

 

পরনিন্দা করা ভালো নয়। কাজে বা কথায় একজন অন্যজনের নিন্দা করাকে বলে পরনিন্দা। ইসলামে পরনিন্দাকে গীবত বলে। গীবত করা গুনাহর কাজ। ইমাম গাযযালী (রঃ) গীবতের কারণ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। কেন মানুষ একে অপরের গীবত করে? তার উত্তরে তিনি আটটি কারণের কথা বলেছেনঃ

১। মানুষ যখন কারো কোন কথায় রাগ হয়, রাগের মাথায় সে অন্যের সমালোচনা করে। এতে সে মনে করে প্রতিশোধ গ্রহন করেছে। এতে তার রাগ কমে।

২। এক সাথে বসে কয়েকজন লোক যদি কারো গীবত করে আর সেই সময় যদি কোন লোক সেখানে এসে উপস্থিত হয় তখন সেও গীবত করে থাকে। কারণ তার চুপচাপ বসে থাকা কেউ পছন্দ করবে না।

৩। কোন লোক যদি মনে করে যে, ভবিষ্যতে লোকটি আমার দুর্নাম করতে পারে তবে সে ঐ ব্যক্তির নামে কুৎসা রটনা করে। এতে সে বোঝাতে চায় যে, লোকটি সম্পর্কে সত্য কথা বলায় সে আমার সাথে এমন শত্রুতা করছে।

৪। কারো প্রতি যখন মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হয় তখন সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য অন্য লোককে অপবাদ দেয়।

৫। নিজের কৃতিত্ব প্রমাণ করার জন্য সাধারণত অন্য লোকের দোষ গেয়ে বেড়ায়।

৬। পরশ্রী লোক তার সমসাময়িক কোন লোকের সুনাম সহ্য করতে পারে না। অবশেষে কোন উপায় না দেখে গীবত করে যাতে লোকের কাছে তার সুনাম নষ্ট হয়।

৭। হাসি তামাসার জন্য অনেক সময় খেয়াল খুশি মতো একে অন্যের গীবত করে থাকে।

৮। কারো প্রতি ব্যঙ্গবিদ্রুপ এবং উপহাস করার উদ্দেশ্যে অনেক সময় গীবত করা হয়।

ইমাম গাযযালী গীবতকে অত্যন্ত ঘৃণা করতেন।

শিক্ষা গ্রহণের সময়ই দেশের চারদিকে ইমাম গাযযালী (রঃ)-র সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

 

জ্ঞানসাধনার সাথে সাথে তিনি এক আল্লাহর খোঁজ করতে লাগলেন। রাতদিন পরিশ্রমের ফলে তাঁর শরীরও দুর্বল হয়ে পড়লো। তাঁর খাওয়া-দাওয়া কমে গেলো। রাত্রে ঘুম হতো না। শরীর দুর্বল ও রক্তহীন হয়ে পড়লো। লোকের অনুরোধে তিনি ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করলেন। ডাক্তার তাঁকে নিয়মমত ওষুধ দিলেন। কিন্তু কোন কাজ হলো না। তাঁর এ রোগ আল্লাহকে পাবার জন্য। তাঁকে না পাওয়া পর্যন্ত তাঁর এ রোগ ভালো হবে না। তাই দুনিয়ার সব কিছু ভুলে তিনি একমাত্র আল্লাহর চিন্তায় মশগুল থাকতেন। ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন চঞ্চল। পরাধীনতাকে তিনি ঘৃণা করতেন। স্বাধীনভাবে থাকতে তিনি ভালবাসতেন। ঘর সংসারের মায়া ত্যাগ করলেন। আত্মীয় পরিজন সবাইকে ভুলে গেলেন। ধন-সম্পদ ও মূল্যবান পোষাক-পরিচ্ছদ ত্যাগ করলেন। মাত্র একখানা মোটা কম্বল গায়ে দিয়ে ঘরবাড়ী ছেড়ে তিনি আল্লাহর খোঁজে বের হয়ে পড়লেন। একমাত্র ভাবনা কোথায় গেলে তিনি আল্লাহর খোঁজ পাবেন। আল্লাহর চিন্তায় তিনি ডুবে গেলেন।

আল্লাহর প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিলো অনেক বেশী। সম সমস্যার সমাধান করতেন তিনি কুরআন ও হাদীসের আলোকে।

মানুষের শরীর। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গতিবিধি। বুকের মধ্যে যে হৃদপিণ্ডটি ধুক ধুক করে তা আত্মা নয়। আত্মা ভিন্ন বস্তু। হৃদপিণ্ডের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। হৃদপিণ্ড একটি গোশতপিণ্ড মাত্র। মানুষ মরে গেলেও হৃদপিণ্ড থাকে। মরলে কিন্তু আত্মা থাকে না। মানুষের শরীর ধ্বংস হয়, কিন্তু আত্মা কখনও ধ্বংস হয় না। মৃত্যুর পরও আত্মা জীবিত থাকে। ইমাম গাযযালী (রঃ) এ সত্যকে নিয়ে গবেষণা করেণ। এবং তাঁর গবেষণার ফলে আল্লাহ তাঁকে জ্ঞান দান করেন। তাঁর গভীর জ্ঞান দেখে ছোট বড়ো সবাই মুগ্ধ হয়ে যেতো। তখন দুনিয়া জুড়ে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় মুসলিম জাহানে তাঁর মত জ্ঞানী লোক আর দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। তাই তাঁকে ইমাম গাযযালী উপাধি দেওয়া হয়। ইমাম অর্থ নেতা। তিনি কোন রাজ্যের নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন জ্ঞান ও চিন্তারাজ্যের নেতা।

 

ইসলামী দর্শনে ছিলো অগাধ জ্ঞান। মুসলমানদের কাছে তিনি দার্শনিক হিসেবেই পরিচিত। এই দার্শনিক হিজরী ৫০৫ সালে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। সম্পূর্ণ সুস্থ শরীরেই তিনি ইনতিকাল করেন। মৃত্যুর দিন ভোরে উঠে অযু করে তিনি ফজরের নামায পড়েন। অতঃপর কাফনের কাপড় আনতে আদেশ করেন। কাপড় আনা হলে তাতে চুমু দিলেন ও কেবলামুখী হয়ে মুয়ে পড়েন এবং জীবনের স্রষ্টাকে জীবন দান করেন। এই মহামনিষী ও দার্শনিক আবু হামেদ মোহাম্মদ আল গাযযালী সমস্ত দুনিয়ায় আজ ও ইমাম গাযযালী নামে প্রসিদ্ধ।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!