সবার ধারনা তিনি খৃষ্টান

শায়েখ মোগাদেরী (রঃ) বলেন, জীবনের একটি দীর্ঘসময় ও উল্লেখযোগ্য অংশ জেহাদ ও দেশ ভ্রমণ করে কাটিয়ে দিয়েছি। বিশেষ প্রয়োজনে কোন অমুসলিম দেশে প্রবেশ করলে আমি নিজেকে তাদের দৃষ্টি হতে অদৃশ্য করে রাখতাম। আবার যখন কোন আশংকা না হত তখন নিজেকে প্রকাশ করতাম। আমি নিজেকে যখন অদৃশ্য করে ফেলতাম তখন আমি সকল মানুষের সাথেই বিচরণ করতাম। কিন্তু মানুষ আমাকে দেখতে পেত না। অর্থাৎ আমি তাদেরকে ঠিকই দেখতে পেতাম।

একবার আল্লাহ্‌ পাকের পক্ষ হতে আমাকে হুকুম করা হল যে, অমুক অমুসলিম দেশে প্রবেশ করে সেখানকার অমুক বুজুর্গের সাথে সাক্ষাৎ কর। সুতরাং এ আদেশ পাওয়ার পর আমি সে দেশে গিয়ে নিজেকে তাদের সাথে প্রকাশ করলাম। আমার বাহ্যিক বেশ ভূষার মুসলিম পরিচয় পাওয়ার পর এক ব্যক্তি আমাকে আটক করে উল্লাশ প্রকাশ করতে লাগল। অতঃপর আমাকে পিছ মোড়া দিয়ে বেঁধে বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে আমি যে বুজুর্গের সাথে দেখা করতে এখানে এসেছি। তাঁর সাথে দেখা করার সহজ উপায় হিসেবেই আমি স্বেচ্ছায় এ পরিস্থিতি বরণ করে নিলাম। বাজার থেকে এক ব্যক্তি আমাকে ক্রয় করে নিয়ে গেল। এবং পরে এক গির্জায় খেদমতের জন্য আমাকে ওয়াকফ করা হল।

অতঃপর আমি যথারীতি ঐ গীর্জার খেদমত করতে লাগলাম। বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন লোকেরা সমগ্র গীর্জা ধোয়ামোছা করে তাতে মূল্যবান কার্পেট বিছিয়ে সুগন্ধি ছড়াতে লাগল। আমি একজনকে জিজ্জেস করলাম, কি ব্যপার এত আয়োজন কিসের আজ? সে বলল, এ দেশের বাদশাহর নিয়ম হল, তিনি বছরে নির্দিষ্ট একদিন গীর্জায় এসে এবাদাত করেন। আজই বাদশাহর আগমনের দিন। তার আগমন উপলক্ষেই এ আয়োজন করা হচ্ছে। সে আরো বলল যে, বাদশাহ যেদিন গীর্জায় এবাদাত করেন সেদিন গীর্জা সম্পুর্ণ খালি করে দেয়া হয়। ভেতরে অপর কাওকেও থাকতে দেয়া হয় না।

বাদশাহর আগমনের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হওয়ার পর যখন তারা গীর্জা খালি করে তার ফটক বন্ধ করতে লাগল। আমি তখন তাদের দৃষ্টি হতে অদৃশ্য হয়ে গীর্জার ভেতরে রয়ে গেলাম। ইত্যবসরে গীর্জা আঙ্গিনায় বাদশাহ আগমন করলে তার জন্য ফটক খুলে দেয়া হল। বাদশাহ একা ভেতরে প্রবেশ করার পর পূনরায় এর ফটক বন্ধ করে দেয়া হল।

বাদশাহ এবার গীর্জার ভেতর ভালভাবে ঘুরে ঘুরে দেখলেন, ভেতরে অন্য কোন মানুষ আছে কি না। আমি তাকে দেখছি কিন্তু তিনি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না। পরে তিনি যখন নিশ্চিত হলেন যে ভেতরে অন্য কোন মানুষ নেই তখন তিনি কেবলার দিকে দাঁড়িয়ে আল্লাহ আকবার বলে নামাযে দাঁড়ালেন। এ সময় আমাকে অদৃশ্য হতে বলা হল, এই সেই ব্যক্তি যার সাথে দেখা করতে তোমাকে বলা হয়েছে।

এবার আমি প্রকাশ হয়ে তার পেছনে দাড়ালাম। তিনি সালাম ফিরায়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তুমি কে? আমি বললাম আপনার মতই একজন মুসলমান। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন- কোন বস্তু এখানে তোমাকে আকর্ষণ করেছে।

উত্তরে আমি বললাম- আপনার আকর্ষনেই আমি এখানে এসেছি। এবার তিনি আমাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে আমার বিস্তারিত অবস্থা জানতে চাইলেন। আমি সংক্ষেপে বললাম আমাকে আদেশ করা হয়েছিল আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে, কিন্তু আপনি যেহেতু একজন খৃষ্টান রাষ্টপ্রধান, সেহেতু একজন সাধারণ মুসলমান প্রকাশ্যে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে বাধার সম্ভাবনা ছিল প্রচুর। এদিকে জানতে পারলাম, বছরে একদিন আপনি একাকী গীর্জায় অবস্থান করেন। অতঃপর আমি বহু ত্যাগ ও কৌশল অবলম্বন করে এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

বাদশাহ আমার বিবরণ শুনে প্রীত হলেন। আমি আমার কাশফের হালাত দ্বারা বাদশাহর প্রতি নজর দিয়ে দেখলাম বাদশাহ একজন আল্লাহ্‌ ওয়ালা বুজুর্গ। তিনিও আমার হালত দেখলেন। আমি জিজ্জেস করলাম, কাফেরদের মাঝে আপনার অবস্থানের রহস্য কি? তিনি বললেন, হে আবুল হেজাজ! কাফের পরিবেষ্টিত সমাজে অবস্থান করে আমার যে উপকার হচ্ছে, মুসলিম সমাজে অবস্থান করে তা মোটেও সম্ভব ছিল না। আমি আরজ করলাম, বিষয়টি একটু খুলে বলুন।

তিনি বললেন, আমার ঈমান ও ইসলাম এবং যাবতীয় নেক আমল একমাত্র আল্লাহ্‌ পাকের জন্য নিবেদিত। আমার এ সকল আমলে রিয়া ও লোক দেখানো মনোবৃত্তির কোন সুযোগই নেই। কারণ এ কাফের পরিবেষ্টিত এলাকায় আমাকে এমন গোপনভাবে শরীয়তের আহকাম পালন করতে হয় যে, আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কারনেই তা আল্লাহ্‌ ব্যথিত অন্য কারো সামনে প্রকাশ করার সুযোগ থাকে না। আমি সর্বদা এমন হালাল রিজিক গ্রহণ করি যাতে হারামের গন্ধও স্পর্শ করতে পারে না। একটি খৃষ্টান দেশের প্রধান হওয়ার সুবাদে আমি মুসলমানদের এমন এমন উপকার করে থাকি, যা একজন মুসলিম রাষ্ট-প্রধানের দ্বারা সম্ভব নয়। আমি কৌশলে কাফেরদের অনিষ্ট হতে মুসলমানদের রক্ষা করি এবং একই উপায়ে কাফেরদের মধ্যে সর্বদা এমন দ্বন্ধ-কলহ ও সংঘাত লাগিয়ে রাখি যা কোন মুসলমান রাজার দ্বারা সম্ভব নয়। কেননা, তারা আমাকে তাদের রাজা ও নিজেদের স্বজাতি হিসেবে সহজেই আমার এমনসব পরামর্শ গ্রহণ করে  বসে যার সহজ পরিণতিতে তারা কখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না এবং পারস্পরিক আত্মকলহ খুন খারাবীর ফলে নিজেদের শক্তি নিজেরাই ধ্বংস করে রাখে।

অতঃপর বাদশাহ বললেন, ইনশাআল্লাহ কিছুক্ষণ পরই আমি তোমাকে আমার তৎপরতায় কিছু নিদর্শন দেখাব। এ সময় আমরা পরস্পর হতে বিদায় গ্রহণ করলাম এবং আমি আবার মানুষের দৃষ্টি হতে অদৃশ্য হতে অদৃশ্য হয়ে পড়লাম। বাদশাহ গীর্জার দরজা খুলে গীর্জার সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের উপস্থিত হতে নির্দেশ দিলেন। সবাই হাজির হলে গীর্জার প্রধান কর্মকর্তাদেরকে বাদশাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল। বাদশাহ তাদেরকে জিজ্জেস করলেন, গীর্জার সার্বক্ষণিক দেখাশুনা ও খেদমতের দায়িত্ব কার? বাদশাহর প্রশ্নের উত্তরে লোকেরা ঐ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করল যারা আমাকে ক্রয় করে গীর্জায় খেদমতের জন্য নিয়োগ করলেন। তারা বলল, তিনি একজন কয়েদীকে কিনে এনে গীর্জার খেমতের জন্য নিয়োগ করেছেন। বাদশাহ তাদের এই জবাব পাওয়ার পর ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন তোমরা কি আল্লাহর ঘরের খেদমতের ব্যপারে এতই অবহেলা শুরু করে দিয়েছ? তোমরা এত খৃষ্টান থাকতে কেমন করে একজন বিধর্মী ও অপবিত্র মানুষ দ্বারা আল্লাহ্‌র ঘরের খেদমত গ্রহণ করছ? এ কথা বলেই তিনি তলোয়ার বের করে তাদের এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে তাদেরকে হত্যা করলেন। অতঃপর আমাকে উপস্থিত হতে আদেশ করলেন। আমি হাজির হওয়ার পর উপস্থিত দর্শকমণ্ডলইকে লক্ষ্য করে বাদশাহ বললেন, এ লোকটি আমাদের গীর্জার খেদমত করে এমন বরকত হাসিল করেছেন যে, এখন আমরা সবাই মিলে তার খেদমত করে বরকত হাসিল করা উচিত। সে এই অহংকারী নিহত ব্যক্তিদের তুলনায় বহু উত্তম। তোমরা স্বয়ং তাকে হাদিয়া তোহফা ও সওয়ারীর  ব্যবস্থা করে দিয়ে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা কর। অবশেষে তারা তাই করল।

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।