ইরাক দেশ। অনেক অনেক দিন আগে দেশটাকে বলা হতো মেসোপটেমিয়া। দেশটির দু’পাশে দুটি নদী। নাম দজলা ও ফোরাত। নদীতে বড়ো বড়ো ঢেউ। ঢেউয়ের তালে তালে পাল তুলে চলে নৌকা।
দেশটি দেখতে অনেক সুন্দর। সেই দেশের একটি সুন্দর শহর কূফা। তখনকার দিনে কূফা ছিলো সে দেশের রাজধানী। শহরে সাবিত নামে এক লোক বাস করতেন। তাঁর ছিলো অনেক বড়ো ব্যবসা। দেশে বিদেশে সওদাগরী করতেন তিনি। অঢেল তাঁর টাকা-পয়সা। কিন্তু তিনি ছিলেন বড়ো পরহেজগার। কাউকে ঠকাতেন না। তাই সবাই তাঁকে ভালোবাসতো। সম্মান করতো। ভাবতো আপন মানুষ।
সেই যুগে ইরাকের বাদশারা ছিলেন খুবই প্রতাপশালী। তাঁরা ছিলেন উমাইয়া বংশের। সামরিক দিক থেকে প্রতাপশালী। তাঁরা ছিলেন উমাইয়া বংশের। সামরিক দিক থেকে তাঁরা ছিলেন বড়ো শক্তিশালী। খুব কম সময়ে অনেক দেশ জয় করে নেন তাঁরা। তাঁদের রাজ্য ছিলো অনেক বড়ো। সুদূর স্পেন পর্যন্ত ছিলো তাঁদের রাজ্যসীমা। কিন্তু তারা ছিল বিলাসী ও আরাম প্রিয়। তাই তাঁরা ছিলো খুবই দুর্বল। দেশের মধ্যে সুখ ছিলো না, শান্তি ছিলো না, ছিলো না আইন-শৃঙ্খলা। প্রায় সবখানেই বিরাজ করছিলো হিংসা বিদ্বেষ, অত্যাচার ও হানাহানি। তাঁরা ইসলামের নিয়মনীতি থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন। তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন ইসলামের মহান শান্তির বাণী। ভুলে গিয়েছিলেন সাম্যের বাণী। ভুলে গিয়েছিলেন রসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রদর্শিত পথ। অন্যায় অবিচারে তাঁরা যেনো বর্বর হয়ে উঠলো।
আলিম সমাজ তাঁদের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে লাগলেন। ফলে অনেক আলিম ও জ্ঞানী জনকে হত্যা করলো তাঁরা। ধর্মীয় শিক্ষা প্রায় বন্ধ। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করার চেয়ে ব্যবসা করা অনেক ভালো। এতে টাকা পয়সা আসে আর কাজকর্মেরও স্বাধীণতা থাকে। সাবিতের স্ত্রীও পরহেজগার মহিলা। স্ত্রীর সাথে তিনি পরামর্শ করলেন, যদি তাঁদের ছেলে হয় তবে ছেলেকে একজন বড় ব্যবসায়ী বা সওদাগর বানাবেন। স্ত্রীও বললেনঃ তবে তাই হোক। আলিম হলে উমাইয়াদের কুনজরে পড়বে। ছেলেকে হারাবো, ব্যবসা হারাবো। সবই তো লুট করে নেবে ওরা।
৬৯৯ সাল। সেই কূফা শহরে একদিন সাবিতের স্ত্রীর কোল জুড়ে এলো এক ফুটফুটে ছেলে। ছেলেটি যেমন তেমন ছেলে নন। অনেক সুন্দর দেখতে তিনি। তাঁর চোখ দুটো ছিল উজ্জ্বল। চমৎকার দেহের গড়ন। চঞ্চল শিশু নন। খুব শান্ত। ধীর স্থির। কণ্ঠস্বর উচ্চ। কথাগুলো মিষ্টি। ভাষা ছিল পরিস্কার ও সহজ।
বাপ-মা আদর করে ছেলেটির নাম রাখলেন নুমান। অনেক গুণের অধিকারী ছেলেটি। বড়ো হয়ে তিনি হন মস্ত বড়ো জ্ঞানী। তাঁর মতো জ্ঞানী দুনিয়ায় কুব কমই জন্মগ্রহণ করেছেন। জ্ঞান সাধনার দ্বারা তিনি মুসলিম জাতির অনেক উপকার করেছিলেন। এই অসামান্য শিশু মুসলিম জাহানে পরিচিত হন একজন বড়ো ইমাম হিসেবে। মুসলমানরা তাঁকে বলে ইমাম-ই-আযম।
সাবিতের মনে শান্তি নেই। দেশের আলিম সমাজের উপর অত্যাচার করা দেখে তিনি দুঃখিত হলেন। নুমানকে সাধারণ ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তানের মতোই গড়ে তুলতে লাগলেন।
নুমানের লেখাপড়ার মন নেই। তাঁর ইচ্ছা তিনি একজন বড়ো ব্যবসায়ী হবেন। তিনি পতার কাছে শুনেছেন ব্যবসা করা হালাল। সুদ খুব খারাপ জিনিস। তাই তিনি সব সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা ভাবেন। ভাবেন কি করে বড়ো সওদাগর হবেন।
৭১৮ সাল। নুমানের বয়স যখন ১৮/১৯ তখন হযরত ওমর বিন আবদুল আজিজ (রঃ) শাহী তখতে আরোহণ করেন। তাঁর সময়ে সারা দেশে পুনরায় শান্তি ফিরে আসলো। তিনি খুলাফায়ে রাশেদীনের মতো সরল জীবন যাপন করতেন। খলীফাদের মতো নিজেকে তিনি সাধারণ মানুষ বলেই ভাবতেন। প্রিয় নবী (সাঃ)-এর আদর্শকে তিনি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করলেন। ফলে ঘরে ঘরে কুরআন ও হাদীস শিক্ষা শুরু হতে লাগলো।
সেই সময়ের একটি চমৎকার ঘটনা। কূফা শহরের নামকরা আলিম শা’বী। তিনি নুমানকে প্রায়ই দেখেন কোথায় যেনো যাওয়া-আসা করে রোজ। তিনি ভাবতেন, এমন সুন্দর ছেলেটি কে? কোথায় যায় সে? কি কাজ তার? ছেলেটি কি পড়াশোনা করে, না কি ঘুরে বেড়ায়? কি তার পরিচয়? আহা! ছেলেটি যদি পড়াশোনা করতো হয়তো অনেক বড়ো হতো। কোথায় যাওয়া-আসা করে রোজ? ৱ
একদিন নুমান তাঁর বাড়ীর পাশ দিয়ে বাজারে যাচ্ছেন। শা’বীর সাথে তাঁর দেখা হয়ে গেলো। শা’বী ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন কিছুক্ষণ। ছেলেটির চোখে মুখে বুদ্ধি আর প্রতিভার ছাপ। শা’বী জিজ্ঞেস করলেন,
: তুমি কোথায় যাচ্ছ খোকা?
: বাজারে যাচ্ছি, ছেলেটি বললো।
: সেখানে কি করো তুমি?
: ব্যবসা করি। আমাদের কাপড়ের ব্যবসা আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করে আমি বড়ো সওদাগর হবো। সওদাগরী করলে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে পারবো। শা’বী বললেন: তুমি কি লেখা-পড়া করো না? কোনো জ্ঞানী লোকের কাছে যাওয়া-আসা করো নাকি? নুমান বললো: না, আমি জ্ঞানীগুণীদের কাছে যাই না। তাঁদের কাছে যাওয়ার দরকারই বা কী? তাছাড়া আমার পিতার ইচ্ছা আমি ব্যবসায়ী হবো।
নুমানের কথা শুনে শা’বী হাসলেন। বললেনঃ ব্যবসা করে টাকা কামাই করা যায়। কিন্তু বড়ো হওয়া যায় না। জ্ঞান ছাড়া বড়ো হয় না কেউ। ব্যবসা-বাণিজ্য সব সময়ই করতে পারবে। তোমার এখন লেখাপড়া করার সময়। জ্ঞানীগুণীদের কাছে তোমার যাওয়া উচিত। উচিত জ্ঞান সাধনা করা। আল্লাহতায়ালা তোমাদের দ্বারা দুনিয়ার বুকে অনেক উপকার করাবেন। বাজারে যাচ্ছ যাও। যেতে যেতে আমার কথাগুলো ভেবে দেখো। আমি দোয়া করি, তুমি অনেক বড়ো হবে।
নুমান বাজারে যেতে যেতে ভাবতে লাগলেন। তিনি ভাবলেন: সত্যিই তো। জ্ঞান অর্জন করা ছাড়া মানুষ বড়ো হয় না। জ্ঞানেই মানুষ বড়ো হয়। জ্ঞান অর্জন করা ছাড়া আল্লাহ ও রসূলকে বোঝা যায় না। তিনি তখন থেকে লেখাপড়ার দিকে মন দিলেন। তাঁর পিতাও ছেলের আগ্রহ দেখে আর বাঁধা দিলেন না। নীরবে সম্মতি দিলেন। তখন থেকে ব্যবসা করার জন্য এতো বেশী বাজারে যাওয়া-আসা তিনি করেন না। আর শহরের বড়ো বড়ো জ্ঞানীদের কাছে যাওয়া শুর করলেন তিনি। জ্ঞান সাধনায় তাঁর সময় কাটতে লাগলো।
তিনি ছিলেন খুবই ভালে ছাত্র। একবার যা শুনতেন কখনো তা ভুলতেন না। শিক্ষকদের কাছে তিনি ছিলেন খুবই প্রিয় ছাত্র। পড়া-শোনায় ছিলেন অনেক মনোযোগী। অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কিছু শিখে ফেলতেন। তাঁর সংগের ছাত্ররা সাত দিনে যতটোকু পড়াশোনা করতো, নুমান দু’একদিনেই তা শিখে ফেলতেন।
তখনকার দিনের পড়াশোনার নিয়ম অনুযায়ী নুমান ছাত্রদের পিছনে বসতেন। শিক্ষক যখন তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেলেন তখন তাঁকে সবার সামনে বসার আদেশ দিলেন। ভালো ছাত্ররা সামনে বসার অনুমতি পায়। নুমান যখন শিক্ষকের কাছে পড়ার সবক নিতেন তখন তিনি দুনিয়ার সব কিছুকে ভুলে যেতেন।
বর্তমানে বিদ্যালয়ে মানুষের লিখে যাওয়া জ্ঞানের কথা পড়ানো হয়। চিন্তাশীল ব্যক্তিরা যা লিখেছেন তা পড়তে দেওয়া হয়। নুমান যখন শিক্ষা লাভ করেছেন তখন প্রচলিত ছিলো অন্য রকম নিয়ম কানুন। তখন শিক্ষা বলতে কুরআন ও হাদীস শিক্ষা কেই বোঝাতো।
কুরআন কি?
কুরআন আল্লাহর কালাম মুসলমানদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ। এতে সারা দুনিয়ার জ্ঞান রয়েছে। এমন কোন জ্ঞানের বিষয় নেই, যা কুরআন শরীফে নেই। মানুষ কিভাবে আল্লাহকে চিনবে, এতে লেখা আছে সেসব কথা। দুনিয়ার পরিচয়, আকাশ, মাটি ও সাগরের নীচেকার রহস্য, সব কিছু রয়েছে কুরআন শরীফে। এ ছাড়াও আছে আরো নানা জ্ঞানের আলোচনা।
হাদীস কি? হাদীস, রসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বাণী, ইসলামী আদর্শ অনুযায়ী জীবন চলার নানা নিয়ম কানুন, আদেশ উপদেশ। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বিবরণ।
ইসলামী নিয়মকে বলে শরীয়ত। শরীয়তের নানা রকম প্রশ্নের জবাব হাদীসে পাওয়া যায়। নুমান প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কুরআন হাদীস শিখতে শুরু করলেন। মাত্র কয়েক বছর বয়স তাঁর। পুরো কুরআন মুখস্থ করলেন তিনি। ফলে কুরআনে হাফিজ উপাধি লাভ করলেন।
অল্প দিনের মধ্যেই তিনি হাদীস শিক্ষায় মনোযোগ দিলেন। তাঁর মনে অনেক আনন্দ। তিনি ফিকাহশাস্ত্রের উপর লেখাপড়া করবেন।
ফিকাহ কি?
ফিকাহ মানে আইনশাস্ত্র। জীবনের নান ক্ষেত্রে যেসব আইন-কানুন মেনে চলা উচিত সেগুলোই হলো ফিকাহর বিষয়।
নুমান ভাবলেন। এজন্য তাঁকে নামকরা জ্ঞানীদের কাছে যেতে হবে। যেমন চিন্তা তেমনি কাজ। তিনি বসে রইলেন না। আইন-কানুন শিক্ষার জন্য কূফার বড়ো জ্ঞানী হাম্মাদ বিন সুলাইমানের নিকট যাওয়া আসা শুরু করলেন। শুধু কি তাই? তিনি সাধ্যমতো তখনকার সকল জ্ঞানীদের নিকট পড়লেন এবং ভালোভাবে আইন-কানুন শিখে নিলেন।
তাঁর উস্তাদ বললেন: আমার কাছে যা কিছু শিখবার, তা সবই শিখে ফেলেছে নুমান। তাঁর এখন চিন্তা ও গবেষণা করা দরকার।
চিন্তা ও গবেষণা করলে কি হয়?
এতে জ্ঞানের সীমা বাড়ে। সত্যকে জানা যায়। ভালো মন্দ বোঝা যায়। মানুষের উপকারে জ্ঞানের ব্যবহার করা যায়। ফলে জীবন হয় সুন্দর। জ্ঞান ছাড়া আল্লাহকে ঠিকমতো চেনা যায় না। ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না।
উস্তাদের ভবিষ্যত বাণী একদিন সত্যি হয়েছিল। নুমান (রঃ) জ্ঞান সাধনার দ্বারা পরবর্তী কালে একজন বড়ো ইমাম হলেন। সারা মুসলিম জাহানের লোকেরা এখন তাঁকে চেনে। তাঁকে সম্মান দেখায়। বড়ো ইমাম হিসেবে স্বীকার করে।
মুসলমানদের চারজন ইমাম। ইমাম আবু হানিফা (রঃ), ইমাম ইবনে হাম্বল (রঃ), ইমাম শাফেয়ী (রঃ) ও ইমাম মালিক (রা)। এঁরা সবাই কুরআন অনুসারে শরীয়তের নানা রকম আইন কানুন তৈরী করেছেন।
প্রত্যেক ইমামই যখন কুরআন হাদীস অনুসারে আইন কানুন তৈরী করলেন তখন ইমাম চারজন হলেন কেন?
মুসলমানদের সব কিছুর মূল হচ্ছে কুরআন ও হাদীস। এ ব্যাপারে কেউ দু’রকম কথা বলেন নি। শরীয়তের প্রধান প্রধান নিয়ম কানুনের ব্যাপারে চারজন ইমামই একমত ছিলেন। নামায, রোযা, হজ্জ্ব, যাকাত –এগুলো সবাই মেনে নিয়েছেন। তবে শরীয়তের ছোটখাটো নিয়ম সম্পর্কে চারজন ইমামই কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। কিন্তু এ কথা সত্যি যে, কেউ কুরআন ও হাদীসের বাইরে কোন কথা বলেন নি। আর যাঁরা যেই ইমামকে মানবেন তাঁদেরকে সেই মাযহাবের লোক বলা হয়।
মাযহাব কি?
মাযহাব মানে দল বা অনুসারী।
নুমান (রঃ)-এর মতের অনুসারীদের বল হয় হানাফী।
মুসলমানদের কাছে তিনি বড়ো ইমাম বা ইমাম-ই-আযম।
মুসলমানদের কাছে তিনি বড়ো ইমাম বা ইমাম-ই-আযম নমেই পরিচিত –নুমান হিসেবে নয়। বাপ-মায়ের দেয়া আদরের নাম নুমান হচ্ছেন আমাদের ইমাম আবূ হানিফা (রঃ)।
ইমাম আবূ হানিফা (রঃ)-র জ্ঞান সাধনা আর চরিত্রের জন্যই সবাই তাঁকে ইজ্জত করে। সম্মান করে। এমন কি তাঁর উস্তাদগণও তাঁকে সম্মান করতেন। শুধু কি তাই? ছাত্র জীবনে ইমাম আবুহানিফা (রঃ) তাঁর উস্তাদের মন জয় করে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। ফলে ক্লাশে উস্তাদেরা তাঁর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিনে।
আবু হানিফা (রঃ) সব সময় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতেন, দামী কাপড়চোপড় পরতেন। তবে তা লোক দেখানোর জন্য নয়। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ঈমানের অংগ, তাই।
তিনি কাউকে দুশমন ভাবতেন না। কারো প্রতি তাঁর হিংসা ছিলো না। কাউকে গালমন্দ দিতেন না। কারো উপর জুলুম করতেন না। তাঁর কাছে কেউ আশ্রয় চাইলে আশ্রয় পেতো। ক্ষতি করলে তিনি তার বদলা নিতেন না –ক্ষমা করে দিতেন। মনে কোন অহংকার ছিলো না। কাউকে কোন মন্দ কথা বলতেন না। তিনি কেবলমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করতেন, অন্য কারো উপর নয়।
সংসারে অনেক মানুষ আছে, তারা কেবল নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তারা নিজেরাই কেবল বড়ো হতে চায়। সুখে থাকতে চায়। প্রতিবেশী বা অন্যের কথা তারা ভাবে না। খোঁজ খবর নেয় না। তারা নিজেরাই পেট বোঝাই করে খায়। দামী দামী কাপড় পরে। খাদ্য বস্ত্রহীন মানুষগুলোর খোঁজ-খবর তারা রাখে না। কিন্তু আবু হানিফা (রঃ) এরকম নন। নিজের কথা তত ভাবেন না। কেবল অন্যের কথাই ভাবতেন বেশী। অন্যের দুঃখ-কষ্ট দূর করে তিনি আনন্দ পেতেন। নিজের খাবার গরীবদুঃখী মানুষের মুখে তুলে দিয়ে সুখী হতেন। সব সময় পাড়াপ্রতিবেশীর খোঁজখবর নিতেন। দুঃখ-কষ্ট দেখলে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতেন। প্রতিবেশীর জন্য তাঁর দরদ ছিলো অনেক বেশী।
আবু হানিফা (রঃ) খুবই বিশ্বাসী ছিলেন। তখনকার লোকেরা তাঁকে খুব বিশ্বাস করতো। তাদের টাকা-কড়ি-সোনা-রূপা ইত্যাদি অনেক কিছু তাঁর কাছে আমানত রাখতো। জীবন গেলেও আবু হানিফা (রঃ) লোকদের আমানত নষ্ট করতেন না। খরচ করতেন না অন্যের টাকা-কড়ি। তিনি বলতেনঃ আমানত রক্ষা করা জিহাদের চাইতেও বড়ো কাজ। আল্লাহ আমানত রক্ষাকারীকে ভালোবাসেন।
আবু হানিফা (রঃ)-র ব্যবসা বাণিজ্য ছিলো অনেক বেশী। বিভিন্ন শহরে তাঁর অনেক চাকর ছিলো। বড়ো বড়ো ধনী সওদাগরের সাথে তাঁর কাজ কারবার চলতো। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন হতো। ব্যবসা-বাণিজ্যেও তিনি ছিলেন খুবই সাবধান। একটা পয়সাও অবৈধভাবে ব্যবসাতে ঢোকাতেন না।
তিনি যে খুবই সৎ ব্যবসা করতেন সে ব্যাপারে একটি ঘটনা বলছি।
একদিন তিনি হাফস বিন আবদুর রহমানের নামে এক লোকের নিকট এক থান কাপড় পাঠিয়েছেন এবং বলে দিয়েছেনঃ থানের কাপড়ে কিছুটা দোষ আছে। কাপড়গুলো বিক্রয়ের সময়ে ক্রেতাকে তা বলে দেবে। কিন্তু লোকটির সে কথা মনে থাকলো না। সে দরদাম ঠিক করে ক্রেতাকে কাপড় দিয়ে দিলো। পরে হিসেবের সময় তিনি হাফসকে জিজ্ঞেস করলেন: খারাপ কাপড়ের কথা ক্রেতাকে বলেছ কি? লোকটি বললো: না আমি ভুলে গিয়েছিলাম। লোকটির কথা শুনে তিনি দুঃখ পেলেন। তখনি তিনি দেরী না করে সব কয়টি কাপড়ের মূল্য গরীব দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন। এ সততার জন্য ব্যবসায়ে তাঁর লোকসান হয় নি। আরও অনেক অনেক উন্নতি হয়েছে তাঁর ব্যবসায়।
সমাজে যাদের অনেক টাকা পয়সা, তারা আরো অনেক টাকা পয়সা বাড়ানো চেষ্টা করে, গর্ব করে বেশী। গরীব লোকদের ধনীরা দেখতে পারে না। আল্লাহর শোকরও আদায় করে না। ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-র অনেক টাকা পয়সা ছিলো; কিন্তু টাকা পয়সার গর্ব তাঁর ছিলো না। সরল, ভদ্র, নম্র, বিনয়ী ও ধৈর্যশীল ছিলেন তিনি। তিনি সারা জীবনে কারো মনে কষ্ট দেননি এবং কারো প্রতি খারাপ ব্যবহার করেন নি।
একদিন তিনি মসজিদে তাঁর ছাত্রদেরকে নিয়ে বসে আছেন। এমনি সময়ে এক লোক এসে তাঁকে উদ্দেশ্য করে খারাপ কথা-বার্তা বলতে লাগলো। তিনি লোকটির কথায় রাগান্বিত হলেন না। পরে তিনি পাঠ দান শেষ করে বাড়ীর দিকে যাচ্ছিলেন। লোকটিও তাঁর সাথে সাথে চললো আর তাঁকে বকাবকি করছিলো। বাড়ীর কাছে এসে তিনি তাকে বললেনঃ ভাই! তোমার গালমন্দ করা আরও কিছু যদি থাকে তবে দিয়ে দাও। এটা আমার বাড়ী। বাড়ীর মধ্যে গেলে তখন আর তুমি সুযোগ পাবে না।
প্রতিবেশীদের প্রতি তাঁর ব্যবহার ছিলো খুবই সুন্দর। প্রতিবেশীদের সাথে তিনি যে উদার ব্যবহার করতেন তার উদাহরণ খুবই কম মেলে।
মনীষীরা বলে থাকেন যে, যুদ্ধের মাঠে যাকে ভয়ে কিছু করতে না পারো, ভালোবাসা দিয়ে তাকে জয় করো। লোহার শিকর দিয়ে যাকে বাধতে না পারো, ভালোবাসার শিকর দিয়ে তাকে বাধো। পরকে আপন করতে হলে তার মনের রাজ্যে সিংহাসন স্থাপন করতে হয়। শাসন করতে হলে সোহাগ করতে হয়। ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-কে এসব কথা কারোও বলে দিতে হয় নি। ছোটবেলা থেকেই তিনি এসব গুণের অধিকারী ছিলেন। একদিনের একটি ঘটনা।
তাঁর মহল্লায় বাস করতো এক মুচি। মুচির বাড়ী তাঁর বাড়ীর পাশেই। খুবই মেজাজী ও বদস্বভাবের ছিলো মুচি। বখাটে ছেলেদের সাথে আড্ডা দেওয়া, হৈ চৈ করা, মদ খাওয়া, গান-বাজনা করা –এসব ছিলো তার অভ্যাস। প্রতিবেশীরা তার অত্যাচারে খুবই কষ্ট পেতো। তারা ঘুমুতে পারতো না এবং কিছু বললেও মুচি বেটা মানতো না।
ইমাম আবু হানিফা খুব কম সময় ঘুমোতেন। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে তিনি নামায পড়তেন। কুরআন তিলাওয়াত করতেন। মুচি বেটার হৈ হট্টগোলে আবু হানিফা (রঃ)-র কষ্ট হতো খুবই বেশী। কিন্তু তিনি তাকে কিছুই বলতেন না।
একদিন মুচি বাজার থেকে গোশত ও মদ নিয়ে এলো। একটু রাত হতেই তার আড্ডাবাজ বন্ধুরা এসে হাজির হলো। মুচি নিজ হাতে বড়ো বড়ো কাবাব তৈরী করে তাদেরকে খাওয়ালো এবং সে নিজেও খেলো। সকলে মিলে মদ পান করে হৈ হট্টগোল করতে লাগলো। তাদের হৈ হট্টগোল চললো। রাত গভীর হলো। রাতের পাহারাদাররা পাহারার কাজে বের হলো। একদল পাহারাদার ঘুরতে ঘুরতে মুচির বাড়ীর নিকটে এসে পড়লো। রাস্তার উপর থেকে তারা শুনলো বাড়ীতে খুবই হট্টগোল হচ্ছে। ঘরের ভিতর ঢুকে পাহারাদাররা মুচিকে গ্রেফতার করে জেলখানায় নিয়ে গেলো। ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তখনও জেগেই ছিলেন। তাঁর দরদী মন মুচির খবর নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। সকাল বেলায় বন্ধু-বান্ধবদেরকে তিনি ব্যাপারটি জিজ্ঞেস করলেন। তারা বললোঃ মুচিকে পাহারাদাররা ধরে নিয়ে গেচে। সে এখন জেলখানায়। এ কথা শুনেই তিনি রাজদরবারে যাওয়ার উপযুক্ত পোষাক পরিধান করলেন এবং রাজ দরবারের দিকে রওয়ানা হলেন।
তাঁকে দেখে বাদশাহ খুবই খুশী হলেন। বাদশাহ জানতেন তিনি সত্যবাদী –তিনি মিথ্যা কথা বলেন না। অন্যায় পথে চলেন না। বাদশাহ তাঁকে নিজের পাশে বসালেন এবং দরবারে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেনঃ আমার মহল্লায় এক মুচিকে আপনার পাহারাদাররা গ্রেফতার করে জেলে রেখেছে। অনুগ্রহ করে তাকে যদি মুক্তি দেন তাহলে আমি খুশি হবো।
বাদশাহ একথা শুনে আর বিলম্ব করলেন না। তখনই মুচিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য জেল দারোগাকে আদেশ করলেন। জেল দারোগা মুচিকে ছেড়ে দিলো। তিনি দরবার থেকে বিদায় নিয়ে মুচিকে সাথে করে যাত্রা করলেন। সবাই তো দেখে অবাক যে, তিনি মুচিকে নিজের পাশে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। চলার পথে তিনি মুচিকে বললেনঃ কি ভাই! তুমি কি আর মদ খাবে? মুচি বললোঃ না। আপনি সত্যি প্রতিবেশীর হক আদায় করেছেন।
সেই দিনের এই ঘটনার পর হতে মুচি তওবা করলেন সে আর মদ পান করবে না। বাজে আড্ডা দেবে না। রঙ তামাসা করে টাকা খরচ করবে না।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-র মন ছিলো খুবই কোমল। কারও কষ্ট দেখলে তিনি নিজে কষ্ট পেতেন। কারও কষ্ট দেখলে তিনি দুঃখিত হতেন। কারও বিপদে তিনি বসে থাকতে পারতেন না। অন্যের কষ্টে তাঁর মন কেঁদে উঠতো।
একদিন তিনি মসজিদে বসে আছেন। তখন এক লোক এসে খবর দিলো দালানের ছাদ হতে একজন লোক পড়ে গেছে। খবরটা শোনামাত্রই তিনি খুব জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। সমস্ত মসজিদ কেঁপে উঠলো। তিনি মসজিদ থেকে খালি পায়ে দৌড়ে বের হলেন, হাঁপাতে হাঁপাতে আহত লোকটির কাছে আসলেন। লোকটিকে তিনি সান্তনা দিলেন, সেবা করলেন, সমবেদনা প্রকাশ করলেন। যতদিন না লোকটি ভাল হয়ে উঠলো ততদিন তিনি রোজ ভোরে গিয়ে লোকটিকে দেখে আসতেন।
বড়ো হয়ে তিনি সত্যের জন্য সংগ্রাম করেছেন অনেক। সত্যের জন্য এই সংগ্রাম করা অনেকের সহ্য হলো না। তাই তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। তিনি সত্যের জন্য সংগ্রাম করে শাহাদাত লাভ করলেন।
বড়ো হয়ে জ্ঞান সাধনার দ্বারা তিনি হলেন মুসলমানদের বড়ো ইমাম বা ইমাম-ই-আজম।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।