কাঁচপোকা

কি এক সময় ছিল! কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত, পাগল করা সময়। সেই সময় খালি মনে হত কেউ আমাকে পাত্তা দেয় না। কেউ আমার কথা শোনে না। রাস্তায় বের হলে মনে হত আমার দিকেই যেন সবাই বিদ্রূপ সহকারে তাকিয়ে আছে। একলা দুপুরে গলার কাছে কান্না এসে আটকে থাকত গুটলি পাকিয়ে। কি যেন করতে ইচ্ছে হত! কোথায় যেন ছুটে যেতে ইচ্ছে হত। চিৎকার করে সব্বাইকে বলতে ইচ্ছে হত “আমি কিন্তু ভালো নেই, আমি পালিয়ে যাব কিন্তু!” বড়রা যখন কথা বলত ইচ্ছে হত বলি-“আপনি এটা ভুল বলছেন, আমি জানি কি করতে হবে”। মাঝে মাঝে বলেও ফেলতাম।
তখন বেয়াদব, অভদ্র, দুষ্টের শিরোমণি ইত্যাদি নানারকম অভিধা মিলত। সবার সামনে অপমানিত হয়ে অক্ষম ক্রোধে ফুঁসতে থাকতাম ভিতরে ভিতরে। মাঝে মাঝে বাথরুমে গিয়ে কাঁদতাম লুকিয়ে লুকিয়ে। কেন জানি খুব রাগ হত! কিসের উপর রাগ, কার উপর রাগ বুঝে উঠতে পারতাম না। আমার অগোছালো পড়ার টেবিল, আমার বিছানা কেউ গোছাতে এলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতাম। সারাদিন বড়দের নানারকম খবরদারি অসহ্য লাগত। “স্নান কর, স্নান কর, স্নান কর”। একদিন স্নান না করলে কি হয়! “পড়, পড়, পড়”। একদিন না পড়লে কি হয়! “সারাদিন শুধু গল্পের বই, গল্পের বই আর গল্পের বই। ওইসব আউট বই পড়ে পড়ে গোল্লায় যাচ্ছিস”। ইচ্ছে হত বলি-“আমি গোল্লায় যাই আর যেখানেই যাই তাতে তোমার কি? তোমার চেয়ে ঢের ভালো রেজাল্ট আমার”। বাসায় বেড়াতে আসা অতিথি আমাকে দেখে বলতেন-“এমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছ কেন? কেমন ঢ্যাঙা দেখাচ্ছে। আহারে সব কখানা হাড় গোনা যাচ্ছে!” রাগে আমার পিত্তি জ্বলে যেত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখতাম, কেমন ঢ্যাঙা, কেমন দুবলা পাতলা দেখাচ্ছে আমাকে। একসময় মনে হত আমার মত কিম্ভুত বস্তু আর দুইটা নেই! ততদিনে হাঞ্চব্যাক অফ নটরডেম পড়া হয়ে গেছে।
ভাবতাম আমি কি কোয়াসিমোদোর মত কুৎসিত! ঈশ্বরের কাছে অভিযোগ করতাম-“ কেন আমাকে এমন অসুন্দর বানালে ঈশ্বর?”। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কেমন এক নিষিদ্ধ আকর্ষণের শুরু ওই সময়। দূর থেকে ওদের দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। ইচ্ছে হত ওদের সাথে বন্ধুতা হোক আমার, ইচ্ছে হত ওদের সাথে গিয়ে কথা বলি। কিন্তু আমার সব অপূর্ণতা, আমার সব সংকোচ দ্বিধা ভয় আমাকে অক্টোপাসের মত আঁকড়ে ধরত। তবু দূর থেকে ওদের দেখে ভালোবেসে ফেলতাম! প্রেমের কবিতা লিখতাম একটা লাল নোটবুকে। একেকটা কবিতা লেখার পর বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতাম। “ওরকম প্যাঁচার মত মুখ গোমড়া করে আছিস কেন সারাদিন? পড়াশুনা কিছু নেই? ”, এই কথাটা শুনতে শুনতে কান পচে যেত। কিন্তু কেউ জানতে চাইত না কি হয়ে যাচ্ছে আমার ছোট্ট বুকখানার ভেতর। তবু মাঝে মাঝে যখন মা রাতের বেলা পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করতেন-“ তোর কি হয়েছে বাবু সোনা? এতো মন খারাপ করে থাকিস কেন?”। তখন মনে হত মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি-“মা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, মা”।
কিন্তু আমি জড়িয়ে ধরতাম না কখনই। তবে মায়েরা মনে হয় সব বুঝতে পারে। মা আমার মাথাটা জড়িয়ে ধরে আমার কপালে, আমার নাকে, মুখে, চোখে আদর করে দিতেন। আমি বিরক্তির ভান করে বলতাম-“কেন বিরক্ত করছ মা, একটু ঘুমাতে দাও না”। মা আমার মাথায়, আমার পিঠে আরও খানিক হাত বুলিয়ে উঠে যেতেন। মা চলে যাবার পর কেমন যেন শূন্য হয়ে যেত আমার চারপাশ। আমি আমার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠতাম। এখন আমি বড় হয়ে গেছি। আমার আর কারণে অকারণে কান্না পায় না, শুধু শুধু রাগ লাগেনা, আমার অগোছালো টেবিল কেউ গুছিয়ে দিলে কৃতার্থ হয়ে যাই। আসলেই আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।
তবু আজ থেকে অনেক বছর আগের সেই আমাকে যখন দেখতে পাই কোন বিষণ্ণ বালকের অবয়বে তখন আমি অসহায় বোধ করি। আমার সেই ভুলে যাওয়া কষ্ট গুলো ফিরে আসে যখন দেখতে পাই কোন দিশেহারা বালক ছাদের এককোণে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে বসে কাঁদে। ওই বালকের মাথায় হাত রেখে খুব বলতে ইচ্ছে করে-“ সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে…”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *