দরোজার করাঘাত শুনতে পেল। হৃদয় আশার দোলায় উঠলো দুলে। প্রতীক্ষিত আনন্দের শান্ত-শিহরণ বয়ে গেল মন-মস্তিস্কে। তাহলে অবশেষে, অবশেষে কি তার ডাকে কেউ সাড়া দিল? দরোজা খোলা, ও-নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারবে, এরপর আস্তে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকবে, ওর মুখে দেখব একরাশ ছড়ানো হাসি। দেখো, পূর্ণিমা চাঁদের মত স্বপ্নীল-স্নিগ্ধতা নিয়ে ও-এখনি ঢুকবে৷ মনে হয, বনী হামদানের কোন অশ্বারোহী যুবক হবে-ও।
গায়ের রঙ হবে নীল নদের পানির মত। আমালিকদের কোন সভ্রান্ত যুবকও হতে পারে। কিংবা হতে পারে বাবেলের কোন কাহিনী-পুরুষ৷ না, না, ওর হাতে ছুরি, বন্দুক কিচ্ছু থাকবে না। ওর সাথে শুধু মুখ-ভরা হাসি থাকবে-আজকে যার প্রয়োজন বডডো বেশী।
বিশটা বছর এই অসহ্য প্রতীক্ষায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছে সে।
দিন যাপনের ক্লান্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষিত করে তুলছে তাকে। বাদামী রঙের আশ্বারোহী এ-ডাক্তারকে কতদিন ধরে খুঁজছে! কত ছবি তার হৃদয় পর্দায় এঁকেছে! ওর অসুখ যখন বেড়ে যায়, এভাবে ছবি আঁকতে থাকলে বেদনার কিছুটা উপশম হয় যেন।
আগন্তুক আবারো করাঘাত করলো মনে হয়। ও চঞ্চল হয়ে উঠলো।
সারা শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শক্তিগুলো একত্রিত করতে চাইছে।
ডাইনে মাথা কাত করতেই চোখাচোখি হলো দেয়াল-ঘড়িটার সাথে। চোখের ভ্রু দু’হাতে কুচকালো একবার।
যেন ক্ষীয়মান দৃষ্টির সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হলো আলো-আঁধারির। ঘড়ির কাটায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দেখলো লম্বাটা খাটোটাকে ছুঁই ছুঁই করছে। ওরা দু’টোই এখনো প্রথম তিন ঘরে বন্দী।
তাহলে একটু আগেই ফজরের আযান হলো? অশ্বারোহী ঠিক সময়ে এসেছে। আসলে আশ্বারোহিদের জন্ম হয় ফজরের সাথে সাথে। শেষতক এলো বটে। আল্লাহর যে-মাখলুকের প্রত্যাশায় এতদিন-সে-ই তাহলে কপাটের কাছে?
হঠাৎ জেগে ওঠা ওর চাঞ্চল্য ধরে রাখার অপ্রাণ চেষ্টা করছে, আগন্তককে নিয়ে আসার জন্যে উঠে দাঁড়াবার দুর্বার প্রয়াস চালাচ্ছে সে। কম্পমান হাত দু’টো করলো মুষ্টিবদ্ধ।
বিছানা হাতড়িয়ে জোরে চাপ দিলো তার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে। দেহটা খানিক উঁচু হলো। ভালোভাবে বসার আগেই শুরু হলো দু’হাতে প্রচণ্ড কাঁপুনি।
ঘামে ভিজে গেল সারা শরীর। প্রাণান্ত চেষ্টা করতে লাগলো একটু বসার জন্যে। দ্রুত নিঃশ্বাসের সাথে আরম্ভ হলো গোঙানীর শব্দের দাপাদাপি। অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
গলায় কিসের ফাঁস এঁটে গেছে। অমনি ধপাস করে পড়ে গেল… এবং শরীর কাঁপতে লাগলো ঝাঁকুনি দিয়েই।
শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে রোগাক্রান্ত হবার পর থেকে ও বড় একা। চার দেয়ালের মাঝে কিছু তিক্ত স্মৃতি ও সব হারাবার গ্লানি নিয়ে বন্দী সে। দিন যায় আসে, আরোগ্যের বালাইও নেই।
মুক্ত দরোজা, অথচ কেউ আসেনা। আসলেও পেছন পথে পালিয়ে যায়। সোনালী ভবিষ্যতেরা পালিয়ে যায় সামনে বাঁকে। তাকে আর কোন দিন ছুঁতে পারবে না –এ যেন ধ্রুব সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
….মমী ঢাকা পুরু আবরণের মত বর্তমান তাকে যেন ঢেকে রেখেছে। সে পুরু আবরণ আরো প্রশস্ত হয়ে তাকে পেঁচিয়ে ফেলতে চাইছে যেন৷ হাত-পা অসাড়-অবশ৷ র্নিজনতার গহবরে সে আজ নিক্ষিপ্ত৷ নিষ্ঠুর বর্তমান তার বাকশক্তি ভবিষ্যতের রাস্তা মাড়াতে দিচ্ছেনা।
নিশ্চল যামানার অভিশাপ ওর মাথায়। কালব্যধির তাণ্ডবনৃত্য ওর প্রতি শিরা-উপশিরায়৷ খানিক চোখ বুজে আরাম করার চেষ্টা করল। চারিদিকে তাকালো৷
চওড়া দেয়াল, হলদেটে ক’খান বই আর ওষুধের কিছু বোতল ছাড়া আর কিছু নেই। কান খাড়া করল বাইরের প্রতি।… স্পন্দন- চারপাশের পৃথিবী চলছে অবিরাম৷ কালের গতি প্রবাহমান।
গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।