গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
সকাল সোয়া নটা।
মোহিত সরকার সবেমাত্র টাইয়ে ফাঁসটা পরিয়েছেন, এমন সময় তাঁর স্ত্রী অরুণা ঘরে ঢুকে বললেন, ‘তোমার ফোন।’
‘এই সময় আবার কে?’
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে নটায় অফিসে পৌঁছানোর অভ্যাস মোহিত সরকারের; ঠিক বেরোনোর মুখে ফোন এসেছে শুনে স্বভাবতই তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল।
অরুণাদেবী বললেন, ‘বলছে তোমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত।’
‘ইস্কুলে? বোঝ!—নাম বলেছে?’
‘বলল, জয় বললেই বুঝবে!’
ত্রিশ বছর আগে ইস্কুল ছেড়েছেন মোহিত সরকার। ক্লাসে ছিল জনাচল্লিশেক ছেলে। খুব মন দিয়ে ভাবলে হয়তো তাদের মধ্যে জনাবিশেকের নাম মনে পড়বে, আর সেই সঙ্গে চেহারাও।
জয় বা জয়দেবের নাম ও চেহারা দুটোই ভাগ্যক্রমে মনে আছে।
কারণ সে ছিল ক্লাসে সেরা ছেলেদের মধ্যে একজন। পরিষ্কার ফুটফুটে চেহারা, পড়াশোনায় ভালো, ভালো হাইজাম্প দিত, ভালো তাসের ম্যাজিক দেখাত, ক্যাসাবিয়াঙ্কা আবৃত্তি করে একবার মেডেল পেয়েছিল। স্কুল ছাড়ার পর তার আর কোনো খবর রাখেননি মোহিত সরকার।
তিনি এখন বুঝতে পারলেন যে এককালে বন্ধুত্ব থাকলেও এতকাল ছাড়াছাড়ির পর তিনি আর কোনো টান অনুভব করছেন না তাঁর ইস্কুলের সহপাঠীর প্রতি।
মোহিত অগত্যা টেলিফোনটা ধরলেন।
‘হ্যালো!’
‘কে, মোহিত? চিনতে পারছ ভাই? আমি সেই জয়—জয়দেবস বোস। বালিগঞ্জ স্কুল।’
‘গলা চেনা যায় না, তবে চেহারাটা মনে পড়ছে। কী ব্যাপার?’
‘তুমি তো এখন বড় অফিসার ভাই; নামটা যে মনে রেখেছ এটাই খুব!’
‘ওসব থাক—এখন কী ব্যাপার বল।’
‘ইয়ে, একটু দরকার ছিল। একবার দেখা হয়?’
‘কবে?’
‘তুমি যখন বলবে। তবে যদি তাড়াতাড়ি হয় তাহলে…’
‘তাহলে আজই করো। আমার ফিরতে ফিরতে ছয়টা হয়। সাতটা নাগাদ আসতে পারবে?’
‘নিশ্চয়ই পারব। থ্যাঙ্ক ইউ ভাই। তখন কথা হবে।’
হালে কেনা হালকা নীল স্ট্যান্ডার্ড গাড়িতে আপিস যাবার পথে মোহিত সরকার ইস্কুলের ঘটনা কিছু মনে আনার চেষ্টা করলেন। হেডমাস্টার গিরীন সুরের ঘোলাটে চাহনি আর গুরুগম্ভীর মেজাজ সত্ত্বেও স্কুলের দিনগুলি ভারি আনন্দের ছিল।
মোহিত নিজেও ভালো ছাত্র ছিলেন। শঙ্কর, মোহিত আর জয়দেব—এই তিনজনের মধ্যেই রেষারেষি ছিল।
ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড তিনজনে যেন পালা করে হতো। ক্লাস সিঙ্ থেকে মোহিত সরকার আর জয়দেব বোস একসঙ্গে পড়েছেন। অনেক সময় এক বেঞ্চিতেই পাশাপাশি বসতেন দুজন।
ফুটবলেও পাশাপাশি স্থান ছিল দুজনের; মোহিত খেলতেন রাইট-ইন, জয়দেব রাইট-আউট; তখন মোহিতের মনে হতো এই বন্ধুত্ব বুঝি চিরকালের। কিন্তু ইস্কুল ছাড়ার পরেই দুজনের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল।
মোহিতের বাবা ছিলেন অবস্থাপন্ন লোক, কলকাতার নামকরা ব্যারিস্টার।
ইস্কুল শেষ করে মোহিত ভালো কলেজে ঢুকে ভালো পাস করে দু’বছরের মধ্যেই ভালো সদাগরী আপিসে চাকরি পেয়ে যায়। জয়দেব চলে যায় অন্য শহরের অন্য কলেজে, কারণ তার বাবার ছিল বদলির চাকরি।
তারপর আশ্চর্য ব্যাপার, মোহিত দেখেন যে তিনি আর জয়দেবের অভাব বোধ করছেন না; তার জায়গায় নতুন বন্ধু জুটেছে কলেজে।