প্রেম ভালবাসা চিরন্তন

হযরত আহমদ সাঈদ নিজের পিতা থেকে বর্ণনা করেন, দীর্ঘ দিন যাবত এক সুদর্শন যুবক আমাদের মসজিদে অবস্থান করছিল। সে মসজিদ থেকে খুব একটা বের হয় না। দিন রাত মসজিদের ভেতরেই এবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকত। এদিকে মহল্লা এক সুন্দরী যুবতী কেমন করে ঐ যুবকের প্রেমে পড়ে গেল। কিন্তু দীর্ঘ দিন যাবত সে তার অন্তরেই প্রেম লালন করছিল। যুবকের নিকট টা প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি।

একদি যুবক মসজিদ থেকে বের হয়ে তার বাড়ির দিকে রওয়ানা হল। কিছুদূর যাবার পর সে মেয়েটি যুবকের সামনে এসে বলল, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। কিন্তু মেয়েটির কথায় কিছুমাত্র কর্ণপাত না করে যুবক নীরবে পথ চলতে লাগল।

এবার মেয়েটি যুবকের পথ রোধ করে বলল, দোহাই তোমার আজ তোমাকে আমার প্রাণের নিবেদন শুনতেই হবে। যুবক কিন্তু মেয়েটির দিকে ফিরেও তাকাল না। কিছুক্ষণ মাথা নিচের দিকে ঝুকিয়ে রাখার পর শুধু বলল, তোমার এই আচারণে আমি দুর্ণামের আশঙ্কা করছি। মেয়েটি জবাব দিল, তোমার আশঙ্কা অমূলক নয়, তুমি একজন চরিত্রবান পরহেজগার যুবক। তোমার গায়ে তিল ফুটলেও তালে তাল করে দেখানো হবে, কিন্তু আমি যে কতটা নিরুপায় হয়ে আজ এ নির্জন পথে তোমাকে বিব্রত করতে বাধ্য হয়েছি টা তোমাকে বুঝাতে পারব না। দিবা-নিশি কি কঠিন কি কঠিন যন্ত্রণার অনলে আমি জ্বলে-পুড়ে ভস্ম হচ্ছি। তা তোমাকে কেমন করে বুঝাবো বল? সেই দিন তোমাকে প্রথম দেখেছি সেদিন থেকেই আমার জিবন-যৌবন সকল কিছুই তোমাকে সপে দিয়েছি। এখন দু’চোখে তোমাকে ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই না।

বর্ণনাকারী বলেন, যুবক মেয়েটির প্রেম নিবেদনের জবাবে কিছুই না বলে বাড়িতে গেল। অতঃপর অযু করে নামাযে দাঁড়াল, কিন্তু নামাযে দাঁড়াবার পরে সে দোয়া কালাম ও সূরা কিরাত কিছুই সে স্মরণ করতে পারল না। পরে কাগজ কলম নিয়ে সেই মেয়েটির উদ্দেশ্যে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখে বাড়ি হতে বের হয়ে আসল এবং এসে দেখল, মেয়েটি এখনো সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। যুবক মেয়েটির অদূরে এসে সেই চিঠিটি তার দিকে নিক্ষেপ করে ফিরে আসল। চিঠিতে লেখা ছিল

হে আল্লাহর বান্দী! মনে রেখো, মানুষ যখন প্রথমবার পাপ করে তখন আল্লাহ পাক টা সহ্য করে নেন। দ্বিতীয় বারও তা মার্জনার চোখে দেখেন। কিন্তু ক্রমে যখন তার পাপ স্বভাবে পরিণত হয় তখন তার উপর আল্লাহ তায়ালার এমন গজব নাযিল হয়- যা আস্মান-জমিন ও পাহাড় পর্বত কেউই সহ্য করতে পারে না। সুতরাং সেই কঠিন আযাব কোন মানুষের পক্ষে সহ্য করার কোন প্রশ্নই আসে না। তোমার প্রেম নিবেদন যদি সত্যি হয় তবে স্মরণ কর সেই দিনের কথা, যে দিন গোটা আকাশ-পাতাল চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পাহাড়গুলো তুলার মত উড়তে থাকবে। সেই ভয়াবহ কিয়ামতের পর মানুষের যাবতীয় অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর আমার নিজের অবস্থা হল, এখনো আমার নফসের এসলাহের কোন ব্যবস্থা হয়নি। সুতরাং এ ক্ষেত্রে অপরের বোঝা বহনের চিন্তা করা আমার পক্ষে অবান্তরই নয় বরং অসম্ভব বটে। আর তোমার প্রেম ও প্রেমের মর্মজ্বালা যদি সত্য হয়, তবে তোমাকে আমি এমন এক চিকিৎসকের সন্ধান দিচ্ছি, যিনি মানুষের অন্তরের সকল জ্বালা যন্ত্রণা দূরীভূত করে চিরস্থায়ী সুখ দান করে থাকেন। সেই মহান চিকিৎসক হলেন মহান আল্লাহপাক। পবিত্র অন্তকরণ নিয়ে সেই মহান জাতের দিকে অগ্রসর হতে থাক।

আমার কথায় মনে কোন দুঃখ নিও না। তোমাকে উপেক্ষা করে কিংবা তোমার মনে আঘাত দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং মনে করতে পার, তোমার একজন পরম হিতৈষী হিসেবে তোমাকে আমি এ কথাগুলো বললাম আর তোমার পবিত্র ভালোবাসার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন পূর্বক এর বিনিময়ে তোমাকে নিম্নের আয়াতটি উপহার দিলাম-

وَأَنذِرْهُمْ يَوْمَ الْآزِفَةِ إِذِ الْقُلُوبُ لَدَى الْحَنَاجِرِ كَاظِمِينَ ۚ مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ

অনুবাদঃ আর আপনি তাদেরকে এক আসন্ন বিপদ দিবস হতে ভয় প্রদর্শন করুন। যখন দুঃখে কষ্টে ওদের প্রাণ কণ্ঠগত হবে। সেদিন অনাচারীদের কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু ও থাকবে না এবং কোন সুপারিশকারীও থাকবে না। যার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হয়। তিনি চক্ষুসমূহের গোপন চাহনিকেও জানেন, এবং এও জানেন যা অন্তরসমূহে লুকায়িত আছে। (সূরা গাফিরঃ ১৮-১৯)

উপরোক্ত আয়াতের পাকড়াও হতে কেউই রক্ষা পাবে না।

উপরোক্ত ঘটনার কয়েকদিন পর মেয়েটি সেই আগের স্থানে এসে যুবকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। যুবক বাড়ি থেকে বের হওয়া মাত্র মেয়েটিকে দূর থেকে ফিরে যতে উদ্যত হল, মেয়েটি যুবককে ডেকে বলল, প্রিয়! আজ আর ফিরে যেও না। সম্ভবতঃ আজই আমাদের শেষ সাক্ষাৎ। ইনশাল্লাহ পুনরায় আমরা আল্লাহর দরবারে এক সাথে মিলিত হব। এ কথা বলেই অজস্র ধারায় কাঁদতে লাগল মেয়েটি। অতঃপর সে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলল, আমি ঐ আল্লাহর নিকট দোয়া করছি, যার কুদরতি হাতে আমার প্রাণ, আমার পবিত্র প্রেম যেন ব্যর্থ না হয়। পরকালে যেন সহজেই আমি তোমাকে লাভ করতে পারি। এখন আমি বিদায় নিচ্ছি। শেষবারের মত আমাকে কিছু নসীহত কর, যেন সারা জীবন আমি একে অবলম্বন করে তোমার অনুসৃত পথের স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারি। যুবক সংক্ষেপে বলল, নিজেকে নফসের খাহেশাত হতে বাঁচিয়ে রেখো আর নিম্নের আয়াতটি স্মরণ রেখো-

وَهُوَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُم بِاللَّيْلِ وَيَعْلَمُ مَا جَرَحْتُم بِالنَّهَارِ

অনুবাদঃ আর তিনি রাত্রিকালে তোমাদের রূহকে কবয করে দেন এবং তোমরা দিবসে যা কিছু কর তাও তিনি জানেন, অতঃপর দিবাভাগে তোমাদেরকে জাগ্রত করেন, যেন নির্দিষ্ট সীমাকাল পূর্ণ হয়ে যায়।

মেয়েটি এবার আরো অধিক মাত্রায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কিছুক্ষণ পর কান্নার বেগ কিছুটা কমলে বাড়িতে ফিরে গেল। পরবর্তীতে সে দুনিয়ার যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে বাড়ির একটি কোণে বসে আল্লাহ পাকের এবাদতে মশগুল হল, কিন্তু তার এই ব্যবস্থা বেশী দিন স্থায়ী হল না। মশুকের বিরহ বেদনায় ক্রমে সে মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে একদিন মৃত্যুমুখে পতিত হল। তার ইন্তেকালের পর যুবক মানষিক ভাবে প্রচণ্ড আঘাত পেল। সারাক্ষণ সে তার প্রিয়ার স্মরণে কেঁদে কেঁদে ফিরতে লাগল। লোকেরা যুবককে জিজ্ঞেস করল, তুমি নিজেই তো ঐ ভালবাসা প্রত্যাখ্যান করেছিলে এখন আবার তার স্মরণে কাঁদছ কেন? সে জবাব দিল, তার পবিত্র প্রেম যেন স্থায়ী হয় এ কারণেই আমি তাকে দমন করে চিরস্থায়ী পরকালের জন্য গচ্ছিত রেখেছি। এখন আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আমার বদ আমলের কারণে আমি যেন পরকালের তার প্রেম থেকে বঞ্চিত না হই।

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।