টোপ–নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-শেষ পর্ব

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

—একটু পরে বুঝবেন। এখন চুপ করুন। এবারে স্পষ্ট ধমক দিলেন আমাকে। মুখ দিয়ে ভক ভক করে হুইস্কির তীব্র গন্ধ বেরুচ্ছে। রাজাবাহাদুর প্রকৃতস্থ নেই। আর কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। আমার ভেতর সব যেন গণ্ডগোল হয়ে গেছে। একটা দুর্বোধ্য নাটকের নির্বাক দ্রষ্টার মতো রাজাবাহাদুরের পাশের চেয়ারটিতে আসন নিলাম আমি।

ওদিকে ঘন কালো বনান্তের ওপরে ভাঙ্গা চাঁদ দেখা দিল। তার খানিকটা ম্লান আলো এসে পড়ল চারশো দুট নিচের জলে, তার ছড়ানো মণিখণ্ডের মতো নুড়িপাথরের ওপরে।

আবছাভাবে যেন দেখতে পাচ্ছি—কপকলের দড়ির সঙ্গে বাঁধা সাদা পুটুলিটা অল্প অল্প নড়ছে বালির ওপরে। এক হাতে রাজাবাহাদুর রাইফেলটা বাগিয়ে ধরে আছেন।

আর এক হাতে মাঝে মাঝে আলো ফেলছেন নিচের পুটুলিটায়। চকিত আলোয় যেটুকু মনে হচ্ছে—পুঁটুলিটা যেন জীবন্ত অথচ কী জিনিস কিছু বুঝতে পারছি না। এ নাকি মাছের টোপ। কিন্তু কী এ মাছ—এ কীসের টোপ?

আবার সেই স্তব্ধতার প্রতীক্ষা। মুহূর্ত কাটছে, মিনিট কাটছে, ঘণ্টা কাটছে। রাজাবাহাদুরের টর্চের আলো বারে বারে পিছলে পড়েছে নিচের দিকে। দিগন্ত প্রসার হিংস্র অরণ্য ভাঙা-ভাঙা জ্যোৎস্নায় দেখাচ্ছে তরঙ্গিত একটা সমুদ্রের মতো। নিচের নদীটা ঝকঝক করছে, যেন একখানা খাপ-খোলা তলোয়ার। অবাক বিস্ময়ে আমি বসে আছি। মিনিট কাটছে, ঘণ্টা কাটছে। টোপ ফেলে মাছ ধরছেন রাজাবাহাদুর।

অথচ সব ধোঁয়াটে লাগছে আমার; কান পেতে শুনছি ঝিঁঝির ডাক, দূরে হাতির গর্জন, শালপাতার মর্মর।

এ প্রতীক্ষার তত্ত্ব আমার কাছে দুর্বোধ্য। শুধু হুইস্কি আর ম্যানিলা চুড়ুটের গন্ধ নাকে এসে লাগছে আমার। মিনিট কাটছে, ঘণ্টা কাটছে, রেডিয়াম ডায়াল কাঁটা চলছে ঘুরে। ক্রমশ যেন সম্মোহিত হয়ে গেলাম, ক্রমশ যেন ঘুম এল আমার।

তারপরেই হঠাৎ কানের কাছে বিকট শব্দে রাইফেল সাড়া দিয়ে উঠল—চারশো ফুট নিচ থেকে ওপরের দিকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠল প্রচণ্ড বাঘের গর্জন। চেয়ারটা শুধু আমি কেঁপে উঠলাম টর্চের আলো সোজা পড়ছে নুড়ি-ছড়ানো বালির ডাঙাটার ওপরে।

পরিষ্কার দেখতে পেলাম ডোরাকাটা অতিকায় একটা বিশাল জানোয়ার সাদা পুটুলির ওপরে একখানা থাবা চাপিয়ে দিয়ে পড়ে আছে, সাপের মতো ল্যাজ আছড়াচ্ছে অন্তিম আক্ষেপে।

ওপর থেকে ইন্দ্রের মতো অব্যর্থ গুলি গিয়ে লেগেছে তার মাথায়। এত ওপর থেকে দুর্নিবার মৃত্যু নামবে আশঙ্কা করতে পারেনি। রাজাবাহাদুর সোৎসাহে বললেন—ফতে।

এতক্ষণে মাছ ধরবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। সোল্লাসে বললাম, মাছ তো ধরলেন, ডাঙায় তুলবেন কেমন করে?

—ওই কপিকল দিয়ে। এই জন্যই ওগুলোর ব্যবস্থা।

ব্যাপারটা যেমন বিচিত্র, তেমনি উপভোগ্য। আমি রাজাবাহাদুরকে অভিনন্দিত করতে যাব, এমন সময়—এমন সময়—পরিষ্কার শুনতে পেলাম শিশুর গোঙানি। ক্ষীণ অথচ নির্ভুল। ও কিসের শব্দ।

চারশো দুট নিচে থেকে ওই শব্দটা আসছে। হ্যাঁ—কোনো ভুল নেই। মুখের বাঁধন খুলে গেছে, কিন্তু বড় দেরিতে। আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল, আমার চুল খাড়া হয়ে উঠল। আমি পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলাম, রাজাবাহাদুর, কিসের টোপ আপনার!কী দিয়ে মাছ ধরলেন?

—চুপ—একটা কালো রাইফেলের নল আমার বুকে ঠেকালেন রাজাবাহাদুর। তারপরেই আমার চারিদিকে পৃথিবীটা পাক খেতে খেতে হাওয়ায় গড়া একটা বুদবুদের মতো শূন্যে মিলিয়ে গেল। রাজাবাহাদুর জাপ্টে না ধরলে চারশো নিচেই পড়ে যেতাম হয়তো।

কীপারের একটা বেওয়ারিশ ছেলে যদি জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তা অস্বাভাবিক নয়, তাতে কারো ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রকাণ্ড রয়াল-বেঙ্গল মেরেছিলেন রাজাবাহাদুর, লোককে ডেকে দেখানোর মতো।

তার আট মাস পরে এই চমৎকার চটিজোড়া উপহার এসেছে। আট মাস আগেকার সে রাত্রি এখন স্বপ্ন হয়ে যাওয়াই ভালো, কিন্তু এই চটিজোড়া অতি মনোহর বাস্তব। পায়ে দিয়ে একবার হেঁটে দেখলাম, যেমন নরম, তেমনি আরাম।

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

দুঃখিত!