টোপ–নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-ষষ্ঠ পর্ব

গল্পের সপ্তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

কিন্তু জঙ্গলের সেই আশ্চর্য স্তব্ধতা। অরণ্য যেন আজ রাত্রে বিশ্রাম করছে, একটি রাত্রের জন্যে ক্লান্ত হয়ে জানোয়ারগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে খাদের ভেতরে, ঝোপের আড়ালে। কেটে চলেছে মন্থর সময়। রাজাবাহাদুরের হাতের রেডিয়াম ডায়াল ঘড়িটা একটা সবুজ চোখের মতো জ্বলছে, রাত দেড়টা পেরিয়ে গেছে। ক্রমশ উসখুস করছেন উৎকীর্ণ রাজাবাহাদুর।

—নাঃ হোপলেস। আজ আর পাওয়া যাবে না। বহুদূর থেকে একটা তীক্ষ্ণ গম্ভীর শব্দ, হাতীর ডাক! ময়ূরের পাখা ঝাপ্টানি চলছে মাঝে মাঝে। এক ফাঁকে একটা প্যাঁচা চেঁচিয়ে উঠল, রাত্রি ঘোষণা করে গেল শেয়ালের দল। কিন্তু কোথায় বাঘ, কোথায় বা ভালুক/ অন্ধকার বনের মধ্যে দ্রুত কতকগুলো ছুটন্ত খুরের আওয়াজ—পাকিয়ে গেল হরিণের পাল। কিন্তু কোনো ছায়া পড়ছে না আলোকবৃত্তের ভেতরে। মশার কামড় যেন অসহ্য হয়ে উঠেছে।

—বৃথাই গেল রাতটা।–রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বরে পৃথিবীর সমস্ত বিরক্তি ভেঙ্গে পড়ল : ডেভিল লাক। সীটের পাশ থেকে একটা ফ্লাসক তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে ঢাললেন গলাতে, ছড়িয়ে পড়ল হুইস্কির উগ্র উত্তপ্ত গন্ধ।

—থ্যাঙ্ক হেভেনস। —রাজাবাহাদুর হঠাৎ নড়ে বসলেন চকিত হয়ে। নক্ষত্রবেগে হাতটা চলে গেল রাইফেলের ট্রিগারে। শিকার এসে পড়েছে।

আমিও দেখলাম। বহুদূরে আলোর রেখাটার ভেতরে কী একটা জানোয়ার দাঁড়িয়ে পড়েছে স্থির হয়ে। এমন একটা জোরালো আলো চোখে পড়াতে কেমন দিশেহারা হয়ে গেছে, তাকিয়ে আছে এই দিকেই। দুটো প্রদীপের আলোর মতো ঝিক ঝিক করছে তার চোখ।

ড্রাইভার বললে—হায়না।

—ড্যাম।–রাইফেল থেকে হাত সরিয়ে নিলেন রাজাবাহাদুর, কিন্তু পরমুহূর্তেই চাপা উত্তেজিত গলায় বললেন—থাক, আজ ছুঁচোই মারব।

দুম করে রাইফেল গর্জন করে উঠল। কানে তালা ধরে গেল আমার, বারুদের গন্ধে বিস্বাদ হয়ে উঠল নাসারন্ধ্র। অব্যর্থ লক্ষ্য রাজাবাহাদুরের—পড়েছে জানোয়ারটা।

ড্রাইভার বললে—তুলে আনব হুজুর?

বিকৃত মুখে রাজাবাহাদুর বললেন—কী হবে? গাড়ি ঘোরাও।

রেডিয়ামের ডায়ালের সবুজ আলোয় রাত তিনটে। গাড়ি ফিরে চলল হান্টিং বাংলোর দিকে। একটা ম্যানিলা চুরুট ধরিয়ে রাজাবাহাদুর আবার বললেন—ড্যাম।

কিন্তু কী আশ্চর্য—জঙ্গল যেন রসিকতা শুরু করেছে আমাদের সঙ্গে। দিনের বেলা অনেক চেষ্টা করেও দুটো-একটা বনমুরগী ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না—এমনকি একটা হরিণ পর্যন্ত নয়।

নাইট শুটিংয়ের সেই অবস্থা। পরপর তিন রাত্রি জঙ্গলের নানা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চেষ্টা করা হল, কিন্তু নগদ লাভ যা ঘটল, তা অমানুষিক মশার কামড়। জঙ্গলের হিংস্র জন্তুর সাক্ষাৎ মিলল না বটে, কিন্তু মশাগুলো চিনতে পারা গেল। এমন সাংঘাতিক মশা যে, পৃথিবীর কোথাও থাকতে পারে এতদিন এ-ধারণা ছিল না আমার।

তবে মশার কামড়ের ক্ষতিপূরণ চলতে লাগল গন্ধমাদন উজাড় করে। সত্যি বলতে কী, শিকার করতে না পারলেও মনের দিক থেকে বিন্দুমাত্র মাত্র ক্ষোভ ছিল না আমার।

জঙ্গলের ভেতর এমন রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন কল্পনারও বাইরে। জীবনে এমন দামি খাবার কোনো দিন মুখে তুলিনি, এমন চমৎকার বাথরুমে স্নান করিনি কখনো, এত পুরু জাজিমের বিছানায় শুয়ে অস্বস্তিতে প্রথম দিন তো ঘুমুতেই পারিনি আমি।

নিবিড় জঙ্গলের নেপথ্যে গ্র্যান্ড হোটেলের স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাচ্ছি—শিকার না হলেও কণামাত্র ক্ষতি নেই কোথাও।

প্রত্যেক দিনই লাউঞ্জে চা খেতে খেতে চারশো ফুট নিচের ঘন জঙ্গলটার দিকে চোখ পড়ে। সকালের আলোয় উদ্ভাসিত শ্যামলতা দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ হয়ে আছে অপরূপ প্রসন্নতায়।

ওয়ান অব দি ফিয়ারেস্ট ফরেস্টস! বিশ্বাস হয় না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি বাতাসে আকার-অবয়বহীন পত্রাবরণ সবুজ সমুদ্রের মতো দুলছে, চক্র দিচ্ছে পাখির দল—এখান থেকে মৌমাছির মতো দেখায় পাখিগুলোকে; জানালার ঠিক নিচেই ইস্পাতের ফলার মতো পাহাড়ি নদীটির নীলিমোজ্জ্বল রেখা—দুটো-একটা নুড়ি ঝকমক করে মণিখণ্ডের মতো।

বেশ লাগে।

গল্পের সপ্তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!