টোপ–নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-৩য় পর্ব

গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

আশ্চর্য এই জঙ্গলের ভেতরেও এত নিখুঁত আয়োজন। এমন একটা বাথরুমে জীবনে আমি স্নান করি নি। ব্রাকেটে তিন চারখানা সদ্য পাট ভাঙ্গা নতুন তোয়ালে, তিনটে দামি সোপ কেসে তিন রকমের নতুন সাবান, র্যাকে দামি দামি তেল, লাইমজুস। অতিকায় বাথটাব—ওপরের ঝাঁজরির। নিচে টিউবোয়েল থেকে পাম্প করে এখানে ধারাস্নানের ব্যবস্থা। একেবারে রাজকীয় কারবার—কে বলবে এটা কলকাতার গ্রান্ড হোটেল নয়। ব্রাকেটে ধোপদুরস্ত ফরাসডাঙার ধূতি, সিল্কের লুঙ্গি, আদ্দির পাজামা। দামের দিক থেকে পাজামাটাই সস্তা মনে হল, তাই পরে নিলাম।

বয় বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। নিয়ে গেল ড্রেসিং রুমে। ঘরজোড়া আয়না, পৃথিবীর যা কিছু প্রসাধনের জিনিস কিছু আর বাকি নেই এখানে।

ড্রেসিং রুম থেকে বেরুতে সোজা ডাক পড়ল রাজাবাহাদুরের লাউঞ্জে। রাজাবাহাদুর একখানা চেয়ারে চিত হয়ে ম্যানিলা চুরুট খাচ্ছিলেন। বললেন, আসুন চা তৈরি।

চায়ের বর্ণনানা করাই ভালো। চা, কদি, কোকো, অভালটিন, রুটি, মাখন, পনির, চর্বিতে জমাট ঠান্ডা মাংস, কলা থেকে আরম্ভ করে পিচ পর্যন্ত প্রায় দশ রকমের ফল।

সেই গন্ধমাদন থেকে যা পাই গোগ্রাসে গিলে চললাম আমি। রাজাবাহাদুর কখনো এক টুকরো রুটি খেলেন, কখনো একটা ফল অর্থাৎ কিছুই খেলেন না। শুধু পরপর কাপ তিনেক চা ছাড়া। তারপর আর একটা চুরুট ধরিয়ে বললেন,—একবার জানালা দিয়ে চেয়ে দেখুন।

দেখলাম। প্রকৃতির এমন অপূর্ব রূপ জীবনে আর দেখিনি। ঠিক জানালার নিচেই মাটিটা খাড়া তিন চারশো ফুট নেমে গেছে, বাড়িটা যেন ঝুলে আছে সেই রাক্ষুসে শূণ্যতার ওপর। তলায় দেখা যায় জঙ্গল, তার মাঝ দিয়ে পাহাড়ি নদীর একটা সঙ্কীর্ণ নীলোজ্জ্বল রেখা। যতদূর দেখা যায়, বিস্তীর্ণ অরণ্য চলেছে প্রসারিত হয়ে; তার সীমান্তে নীল পাহাড়ের প্রহরা।

আমার মুখ দিয়ে বেরুল—চমৎকার। রাজাবাহাদুর বললেন—রাইট। আপনারা কবি মানুষ, আপনাদের তো ভালো লাগবেই। আমরাই মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে মশাই। কিন্তু নিচের ওই জঙ্গলটা দেখতে পাচ্ছেন ওটি বড় সুবিধের জায়গা নয়। টেরাইয়ের ওয়ান অব দি ফিয়ারেস্ট ফরেস্ট। একেবারে প্রাগৈতিহাসিক হিংস্রতার রাজত্ব।

আমি সভয়ে জঙ্গলটার দিকে তাকালাম। ওয়ান অব দি ফিয়ারেস্ট। কিন্তু ভয় পাওয়ার মতো কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না। চারশো ফুট নিচে ওই অতিকায় জঙ্গলটাকে একটা নিরবিচ্ছিন্ন বেঁটে গাছের ঝোঁপ বলে মনে হচ্ছে, নদীর রেখাটাকে দেখাচ্ছে উজ্জ্বল একখানা পাতার মতো। আশ্চর্য সবুজ, আশ্চর্য সুন্দর।

অফুরন্ত রোদে ঝলমল করছে অফুরন্ত প্রকৃতি—পাহাড়টা যেন গাঢ় নীল রঙ দিয়ে আঁকা। মনে হয়, ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়লে ওই স্তব্ধ গম্ভীর অরণ্য যেন আদর করে বুকে টেনে নেবে রাশি রাশি পাতার একটা নরম বিছানার ওপরে। অথচ—

আমি বললাম—ওখানেই শিকার করবেন নাকি?

—ক্ষেপেছেন, নামব কী করে। দেখছেন তো, পেছনে চারশ ফুট খাড়া পাহাড়। আজ পর্যন্ত ওখানে কোনো শিকারীর বন্দুক গিয়ে পৌঁছায় নি। তবে হ্যাঁ, ঠিক শিকার করি না বটে, আমি মাঝে মাঝে মাছ ধরি ওখান থেকে।

—মাছ ধরেন। আমি হাঁ করলাম : মাছ ধরেন কি রকম?ওই নদী থেকে নাকি?

সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। দরকার হলে পরে দেখতে পাবেন—রাজাবাহাদুর রহস্যময়ভাবে মুখ টিপে হাসলেন : আপাতত শিকারের আয়োজন করা যাক, কিছু না জুটলে মাছের চেষ্টাই করা যাবে। তবে ভালো টোপ ছাড়া আমার পছন্দ হয় না, আর তাতে আমার অনেক হাঙ্গামা।

—কিছু বুঝতে পারছি না।

রাজাবাহাদুর জবাব দিলেন না, শুধু হাসলেন। তারপর ম্যানিলা চুরুটের খানিকটা সুগন্ধি ধোঁয়া ছড়িয়ে বললেন—আপনি রাইফেল ছুঁড়তে জানেন?

বুঝলাম কথাটাকে চাপা দিতে চাইছেন। সঙ্গে সঙ্গে জিহবাকে দমন করে ফেললাম আমি, এর পরে আর কিছু জিজ্ঞাসা করাটা সঙ্গত হবে না। শোভনও নয়। সেটা কোর্ট-ম্যানারের বিরোধী।

রাজাবাহাদুর আবার বললেন—রাইফেল ছুঁড়তে পারেন?

 

গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

 

দুঃখিত!