টোপ–নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-১ম পর্ব

গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সকালে একটা পার্সেল এসে পৌঁছেছে। খুলে দেখি একজোড়া জুতো।

না, শত্রুপক্ষের কাজ নয়। একজোড়া জুতো পাঠিয়ে আমার সঙ্গে রসিকতার চেষ্টাও করেনি কেউ। চমৎকার ঝকঝকে বাঘের চামড়ার নতুন চটি। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, পায়ে দিতে লজ্জা বোধ হয় দস্তুরমতো। ইচ্ছে করে বিছানাইয় শুইয়ে রাখি।

কিন্তু জুতোজোড়া পাঠালো কে? কোথাও অর্ডার দিয়েছিলাম বলেও তো মনে পড়ছে না। আর বন্ধুদের সব কটাকেই চিনি, বিনামূল্যে এমন একজোড়া জুতো পাঠাবার মতো দরাজ মেজাজ এবং ট্যাঁক কারও আছে বলেও জানি না। তাহলে ব্যাপারটা কী?

খুব আশ্চর্য হব কিনা ভাবছি, এমন সময়ে একখানা সবুজ রঙের কার্ড চোখে পড়ল। উইথ বেস্ট কমপ্লিমেন্টস অব রাজাবাহাদুর এন আর চৌধুরী, রামগঙ্গা এস্টেট।

আর তখুনি মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল আটমাস আগেকার এই আরণ্যক ইতিহাস, একটি বিচিত্র শিকার-কাহিনী।

রাজাবাহদুরের সঙ্গে আলাপের ইতিহাসটা ঘোলাটে, সূত্রগুলো এলোমেলো। যতদূর মনে হয় আমার এক সহপাঠী তাঁর এস্টেটে চাকরি করত। তারই যোগাযোগে রাজাবাহাদুরের এক জন্মবাসরে আমি একটি কাব্য সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেছিলাম। ঈশ্বর গুপ্তের অনুপ্রাস চুরি করে যে প্রশস্তি রচনা করেছিলাম তার দুটো লাইন এই রকম :

ত্রিভুবন প্রভাকর ওহে প্রভাকর
গোনবান মহীয়ান হে রাজেন্দ্রবর।
ভূতলে অতুল কীর্তি রামচন্দ্র সম—
অরাতিদমন ওহে তুমি নিরুপম।

কাব্যচর্চার ফলাফল হল একেবারের নগদ নগদ। পড়েছি-আকবরের সভাসদ আবদুর রহিম খানখানাম হিন্দি-কবি গঙ্গের চার লাইন কবিতা শুনে চার লক্ষ টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন। দেখলাম সে নবাবী মেজাজের ঐতিহ্যটা গুণবান অরাতিদমন মহারাজ এখনও বজায় রেখেছেন।

আমার মতো দীনাতিদীনের ওপরও রাজদৃষ্টি পড়ল, তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন, প্রায়ই চা খাওয়াতে লাগলেন, তারপর সামান্য একটা উপলক্ষ্য করে দামী একটা সোনার ঘড়ি উপহার দিয়ে বসলেন একসময়ে।

সেই থেকে রাজাবাহাদুর সম্পর্কে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হয়ে আছি আমি। নিছক কবিতা মেলাবার জন্যে যে বিশেষণগুলো ব্যবহার করেছিলাম, এখন সেগুলোকেই মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।

রাজাবাহাদুরকে আমি শ্রদ্ধা করি। আর গুণগ্রাহী লোককে শ্রদ্ধা করাই তো স্বাভাবিক। বন্ধুরা বলে, মোসাহেব। কিন্তু আমি জানি ওটা নিছক গায়ের জ্বালা, আমার সৌভাগ্যে ওদের ঈর্ষা। তা আমি পরোয়া করি না। নৌকা বাঁধতে হলে বড় গাছ দেখেই বাঁধা ভালো, অন্তত ছোটোখাটো ঝড় ঝাপটার আঘাতে সম্পূর্ণ নিরাপদ।

তাই মাস আষ্টেক আগে রাজাবাহাদুর যখন শিকারে তাঁর সহযাত্রী হওয়ার জন্যে আমাকে নিমন্ত্রণ জানালেন তখন আমি ঠেলতে পারলাম না। কলকাতার সমস্ত কাজকর্ম ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে পড়া গেল। তাছাড়া গোরা সৈন্যদের মাঝে-মাঝে রাইফেল উঁচিয়ে শকুন মারতে দেখা ছাড়া শিকার সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ধারণাই নেই আমার।

সেদিক থেকেও মনের ভেতরে গভীর এবং নিবিড় একটা প্রলোভন ছিল। জঙ্গলের ভেতর ছোট একটা রেল লাইনের আরও ছোট একটা স্টেশনে গাড়ি থামল। নামবার সঙ্গে সঙ্গে সোনালী তকমা আঁটা ঝকঝকে পোশাক পরা আর্দালি এসে সেলাম দিল আমাকে। বললে,—হুঁজুর চলেন।

স্টেশনের বাইরে মেটে রাস্তায় দেখি মস্ত একখানা গাড়ি—যার পুরো নাম রোলস রয়েস, সংক্ষেপে যাকে বলে ‘রোজ’। তা রোজই বটে। মাটিতে চলল না রাজহাঁসের মতো হাওয়ায় ভেসে গেল সেটা ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারলাম না। চামড়ার খটখটে গদি নয়, লাল মখমলের কুশন। হেলান দিতে সংকোচ হয় পাছে মাথার সস্তা নারকেলের তেলের দাগ ধরে যায়। আর বসবার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়—সমস্ত পৃথিবীটা চাকার নিচে মাটির ঢেলার মতো গুঁড়িয়ে যাক—আমি এখানে সুখে এবং নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে পারি।

হাঁসের মতো ভেসে চলল ‘রোজ’। মেটে রাস্তায় চলেছে অথচ এতটুকু ঝাঁকুনি নেই। ইচ্ছে হল একবার ঘাড় বার করে দেখি গাড়ি ঠিক মাটি দিয়েই চলছে, না দুহাত ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে ওর চাকাগুলো।

 

গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!