গোপাল আর তার প্রাণের বন্ধু নেপাল নৌকায় করে একবার চাঁদপুর যাচ্ছিল। নৌকায় ছয়জন মাঝি ছাড়া আরও দুজন ভদ্রলোক ছিলেন। একজনের হাতে আবার বর্ধমানের নামকরা এক হাঁড়ি, যাতে সুগন্ধ ছড়ানো সীতাভোগ ছিল। তিনি সঙ্গী ভদ্রলোককে বললেন,
“আজ বিয়ের লগ্ন, তাই সীতাভোগের দাম বেড়ে দ্বিগুণ, মশায়।
শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি বলে চড়া দাম দিয়েই দই আর সীতাভোগ নিয়ে এলাম। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আবার সীতাভোগ খেতে খুব ভালোবাসেন। যেবারই যাই, নিয়ে যেতেই হয় — বাজারদর যাই হোক না কেন। না হলে চলে না।”
হাঁড়িটা ছাইয়ের ভেতর রেখে তিনি বললেন,
“চলুন বাইরে গিয়ে বসি, ভেতরে ভীষণ গরম; বাইরে জলের হাওয়া বেশ আরাম লাগবে। ছাইয়ের ভেতর আর গরমে বসা যাচ্ছে না। আপনার সঙ্গেও অনেকদিন পর দেখা, প্রাণ ভরে গল্প করা যাক।”
অতএব হাঁড়িটা ছাইয়ের ভেতরে রেখে ভদ্রলোক দুজন নদীর হাওয়া খেতে পাটাতনের উপর গিয়ে বসলেন।
গোপাল আর নেপালও পাটাতনে বসেছিল, আর ভেতরের দুজনের সীতাভোগ বিষয়ক কথোপকথন শুনছিল।
সীতাভোগের নাম শুনেই গোপালের জিভে জল এলো। আহা! কী ভুরভুরে গন্ধ!
সীতাভোগ তো নয়, যেন অমৃত! এমন সুগন্ধ ছড়াচ্ছে, বলার নয়।
গোপাল মনে মনে ভাবল — “কী করে সীতাভোগের হাঁড়িটা ফাঁকা করা যায়?”
যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। ভদ্রলোক দুজন কথায় ব্যস্ত, গোপালও ছক কাটল — কীভাবে খাওয়া যায়।
কিছুক্ষণ পর গোপাল কাঁপতে কাঁপতে নেপালকে বলল,
“নেপাল, আমার যে আবার জ্বর এল রে! প্রচণ্ড শীত করছে। গায়ের চাদরও আনিনি। বেলাও বেশি নেই — এখন কী করি বল?”
গোপালের কথা শুনে নেপাল বলল,
“তুই এমন কাণ্ড বাধাবি জানলে তোকে সঙ্গে আনতুম না! চাঁদপুর তো এখনও অনেক দূর। এখন তোর কী করব, কোথায় বা শুইয়ে রাখব?”
ভদ্রলোক তখন জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনারা চাঁদপুর যাচ্ছেন বুঝি? এখন থেকে চাঁদপুর অনেক দূর, প্রায় বেলা পড়ে যাবে।”
নেপাল বলল,
“হ্যাঁ, আমরা চাঁদপুরের পরের ঘাটে নামব — লছিমপুরে। ওখানেই আমাদের আত্মীয়।”
এদিকে গোপাল ততক্ষণে হু-হু করে কাঁপছে, চেঁচাচ্ছে —
“মরে গেলাম শীতে! একেবারে মরে গেলাম!”
ভদ্রলোক দয়া করে বললেন,
“আপনি জ্বরে গায়ে ঠান্ডা লাগাচ্ছেন কেন, মশায়? নৌকার ছইয়ের ভেতর গিয়ে কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ুন। ঠান্ডা একদম লাগাবেন না। আজকালকার এই জ্বর ভালো নয় — হিতে বিপরীত হতে পারে। যান, নিচে গিয়ে বিশ্রাম নিন।”
গোপাল তো এটাই চাইছিল! সে ছইয়ের ভেতর গিয়ে কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।
দু’ঘণ্টা পরে নৌকা চাঁদপুর ঘাটে ভিড়ল। নেপাল গোপালকে ধরে ধরে যেন কোলে করে নামাল। ঘাটে গোপাল বলতে লাগল,
“বাবা রে, মরে গেলাম রে, কাঁপছি রে!”
ডাঙায় কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলল,
“যাক বাবা, এতক্ষণে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল! এখন আর ভয় নেই — তুই আমাকে ছেড়ে দে, আমি এখন একা যেতে পারব।”
নেপাল মুচকি হেসে বলল,
“ছাড়ার আগে আমার ভাগটা দে। নিশ্চয়ই তুই আমার জন্য কিছু এনেছিস — না সব নিজেই সেঁটে এসেছিস?
যখন তোর নৌকায় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল, তখনই বুঝেছি — এটা ‘সীতাভোগ খাওয়ার জ্বর’ ছাড়া আর কিছু নয়! ঠিক বলছি না?”
গোপাল মুচকি হেসে বলল,
“হাঁড়িভরা সীতাভোগ দেখেই তো আমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল! তবে তোকে একেবারে বঞ্চিত করব না, নেপাল — তুই আমার প্রাণের বন্ধু। তোর জন্য কোঁচড়ে লুকিয়ে কিছু সীতাভোগ এনেছি।”
ভদ্রলোক যখন লছিমপুরে হাঁড়ি নিয়ে নামবেন, দেখবেন হাঁড়িটা একেবারেই ফাঁকা।
সীতাভোগের শোকে তখন হয়তো ভদ্রলোকেরই জ্বর আসবে। শ্বশুরবাড়িতে এবার মুখ দেখানো দায়!
“যাক বাবা,” গোপাল বলল,
“বহুদিন পর বর্ধমানের সীতাভোগ মন ভরে খেলাম। বাড়িতেও কিছু নিয়ে যাচ্ছি!”
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।