গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঝাউ-গাছের উপর থেকে খোঁড়া হাঁস ঠোঁটে করে রিদয়কে বাগদী-চরের থেকে একটু দূরে নালমুড়ির চরে নামিয়ে দিয়ে সারাদিন বুনো-হাঁসের দলের সঙ্গে শেয়ালকে নিয়ে ঝপ্পটি আর দাঁতকপাটি খেলে বেড়াচ্ছে। ক্রমে সন্ধ্যে হয়ে এল দেখে রিদয় ভাবছে, নিশ্চয়ই হাঁসেরা রাগ করে তাকে ফেলে গেছে, এখন কেমন করে সে বাড়ি যায়? আর কেমন করেই বা ঐ বুড়ো-আংলা চেহারা নিয়ে বাপ-মায়ের সঙ্গে দেখা করে? ঠিক এই সময় মাথার উপর ডাক দিয়ে হাঁসের দল উড়ে এসে নালমুড়িতে ঝুপঝাপ পড়েই জলে নেমে গেল। চরে মেলাই কাছিমের ডিম, রিদয় তারি একটা ওবেলা, একটা এবেলা খেয়ে পেট ভরিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। এমনি সে রাত কাটল। ভোর না হতে হাঁসের দল রিদয়কে নিয়ে আবার চলল। রিদয় দেখলে হাঁসেরা তাকে বাড়ি যাবার কথা বললে না। সেও সে কথা চেপে গিয়ে চুপচাপ খোঁড়া-হাঁসের পিঠে চুপটি করে উঠে বসল।
লুসাই-হাঁসের ডানাটা শেয়ালের কামড়ে একটু জখম হয়েছে, কাজেই বুনো-হাঁসের দল আজ বেশি দূরে উড়ে গেল না। গোবরা-তলির মাটির কেল্লা ‘নুড়িয়া ক্যাসেলের’ উপরটায় এসে দেখতে লাগল, সেখানে মানুষ আছে কিনা। সেখানে শিকে-গাঁথা ফাটা-চটা কতকগুলো মাটির সঙ, পরী, সেপাই – এমনি সব। বাগানে মালি নেই, মালিকও নেই, কেবল একটা ভাঙা ফটকের মার্বেল-পাথরে কালি দিয়ে দাগা সাইন বোর্ডে লেখা রয়েছে – “পালদিং অফ্ নুড়িয়া।” ঠিক তারি নিচে একটা ভাঙা পিপের মধ্যে বসে একটা রোগা, কানা দেশী কুকুর পোড়ো কেল্লায় পাহারা দিচ্ছে।
বুনো-হাঁসেরা আকাশ থেকে শুধোলে – “ছপ্পড়টা কার? ছপ্পড়টা কার?”
কুকুরটা অমনি আকাশে নাক তুলে চেঁচিয়ে উঠল ভেউ-ভেউ করে বললে – “ছপ্পড় কি? দেখছ না এটা নুড়িয়ার কেল্লা – পাথরে গাঁথা! দেখছ না কেল্লার বুরুজ, তার উপরে ওই গোল ঘর – সেখানে কামান-বসাবার ঘুলঘুলি, নিশেন ওড়াবার ডাণ্ডা। গবাক্ষ, বাতায়ন, দরশন-দরওয়াজা। এ-সব দেখছ না!”
হাঁসেরা কিছুই দেখতে পেলে না – না কামান, না ঘুলঘুলি না গবাক্ষ, না বাতায়ন। কেবল একটা চিলের ছাদে একটা আকাশ-পিদিম দেবার বাঁশ দেখা গেল, তাতে এক-টুকরো গামছা লটপট করছে। হাঁসেরা হো-হো করে হেসে বলল – “কই? কই?”
কুকুরটা আরও রেগে বললে – “দেখছ না, কেল্লার ময়দান যেন গড়ের মাঠ! দেখছ না, কেলিকুঞ্জ – সেখানে রানী থাকেন। দেখ ওই হাম্মাম, দেখানে গোলাপজলের ফোয়ারা। দেখতে পাচ্ছ না বাগ-বাগিচা, আম-খান, দেওয়ান-খান?” হাঁসেরা দেখলে, পানা-পুকুর, লাউ-কুমড়োর মাচা – এমনি সব, আর কিছু নেই।
কুকুর আবার চেঁচিয়ে বললে – “ঐ দেখ ওদিকে গাছঘর, মালির ঘর, আর এই সব সুরকি পাতা রাস্তার ধারে-ধারে পাথরের পরী, গ্যাস লাইটের থাম, বাঁধা ঘাট, বারো দোয়ারি নাটমন্দির। এসবকি চোখে পড়ছে না যে বলছ ছপ্পড় কার? ছপ্পড়ে কখনো কেলিকানন, পুষ্পকানন, কামিনীকুঞ্জ থাকে? না, পাথরের পরী-ঘাটের সিঁড়ি থাকে? ঐ দেখ রাজার কাচারি, ঐ হাতিশাল, ঘোড়াশাল, তোষাখানা। এসব কই ছপ্পড়ে থাকে? না ছপ্পড় কখনো দেখেছ? ছপ্পড় দেখতে হয় তো ওপাড়ার ওই জমিদারগুলোর বাড়ি দেখে এস। আমার মনিব কই জমিদার? এরা মূর্ধাভিষিক্ত। লেখাপড়ার ধার দিয়েও যায় না। ঘোড়া রোগে এদের সবাই মরেছে। সেকালে এরা চীনের রাজা ছিল। এখনো দেখছ না ফটকে লেখা – ‘পালদিং অফ নুড়িয়া!’ এই ছপ্পড়ের নহবতখানার চুড়ো দশক্রোশ থেকে দেখা যায় – এমনি ছপ্পড় এটা!”
কানা কুকুরটা ঘেউ-ঘেউ করে থামলে হাঁসেরা হাসতে হাসতে বললে – “আরে মুখ্যু, আমরা কই তোর রাজার কথা, না রাজবাড়ির কথা শুধোচ্ছি? ওই ভাঙা ফটকের ধারে পোড়াবাগানে মদের পিপেটা কার, তাই বল না।” এমনি রঙ তামাশা করতে করতে হাঁসেরা নুড়িয়া ছাড়িয়ে সুরেশ্বরে – যেখানে প্রকাণ্ড ঠাকুরবাড়ির ধারে সত্যিকার বাগ বাগিচা, দীঘি পুষ্করিণী, ঘাট মাঠ রয়েছে, সেইখানে কুশ-ঘাসের গোড়া খেতে নামল।