ধৈর্যের পাহাড় আইয়ুব (আঃ)

“আর আইয়ুবের কথা চিন্তা করে দেখো। সে যখন ফরিয়াদ করলো –“ওগো আমার প্রভু, আমি কঠিন রোগে বড় কষ্টের মধ্যে আছি আর তুমি তো সবচেয়ে বড় করুনাময়। অতপর আমি তাঁর ফরিয়াদ কবুল করলাম আর দূর করে দিলাম তাঁর সব কষ্ট।”?(সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৩-৮৪)

 

হযরত আইয়ুবের পরিচয়

আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত আইয়ুব (আঃ) এর কথা পবিত্র কুরআন শরীফের চারটি স্থানে উল্লেখ হয়েছে। সেগুলো হলো সূরা আন নিসার ১৬৩ নম্বর আয়াত, সূরা আল আনয়ামের ৮৪ নম্বর আয়াত, সূরা আল আম্বিয়ার ৬৩-৬৪ নম্বর আয়াত এবং সূরা সোয়াদের ৪১-৪৪ নম্বর আয়াত। হযরত আইয়ুবের বংশ পরিচয় পরিস্কারভাবে জানা যায়নি। এ ব্যাপারে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি ছিলেন বনী ইসরাইলের একজন নবী। কেউ বলেছেন, তিনি ছিলেন মিশরীয়। তবে ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাকের মতকে অনেকে সঠিক বলেছেন। তাঁর মতে, হযরত আইয়ুবের বংশ পরিচয় হলো হযরত ইব্রাহীমের পুত্র ইসহাক, হযরত ইসহাকের পুত্র ঈশু, ঈশুর পুত্র আমুশ, আমুশের পুত্র আইয়ুব। হযরত আইয়ুব (আঃ) খ্রিষ্টপূর্ব নবম বা দশম শতকের লোক ছিলেন।

 

ধনী হযরত আইয়ুব

হযরত আইয়ুব (আঃ) ছিলেন এক বিরাট ধনী ব্যাক্তি। তাঁর ধন সম্পদ ছিলো অগাধ। তিনি ছিলেন অনেক অনেক ভূমি ও বাগ বাগিচার মালিক। তাঁর ছিলো অগাধ অর্থকড়ি। ছিলো অনেক সন্তান সন্তুতি। ছিলো সুস্বাস্থ্য। কিন্তু এতো বড় ধনী হলে কি হবে, এ জন্যে তাঁর ছিলনা কোন গর্ব, ছিলনা কোনো অহংকার। তিনি এগুলোকে আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ মনে করতেন। আল্লাহ তাঁকে এতো ধনসম্পদ দিয়েছেন বলে তিনি সব সময় আল্লাহর শোকর আদায় করতেন, আল্লাহর কৃতজ্ঞ হয়ে থাকতেন।

 

কঠিন পরীক্ষা

কিন্তু আল্লাহর নিয়ম হলো, তিনি মানুষকে দিয়েও পরীক্ষা করেন, নিয়েও পরীক্ষা করেন। আর যেসব মানুষ আল্লাহর বেশী প্রিয়, তিনি তাঁদের অনেক বড় পরীক্ষা নেন। হযরত আইয়ুব (আঃ) ছিলেন আল্লাহর একজন অতিপ্রিয় দাস ও নবী। তিনি যেমন তাকে ভালবাসতেন, তেমন কঠিন পরীক্ষাও তাঁর উপর চাপিয়ে দেন। হযরত আইয়ুব (আঃ) চারটি বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন –

১. তাঁর সমস্ত ধন সম্পদ জমাজমি নষ্ট হয়ে যায়।

২. তাঁর সারা শরীরে কঠিন যন্ত্রনাদায়ক এক রোগ দেখা দেয়। বছরের পর বছর কাটে কিন্তু তাঁর রোগ ভালো হয়না।

৩. তাঁর স্ত্রী ছাড়া সকল আপনজন তাঁকে ছেড়ে দূরে চলে যান। তিনি সম্পূর্ণ নিঃসহায় হয়ে পড়েন।

৪. এ অবস্থায় আল্লাহর প্রতি বিমুখ হওয়ার জন্যে শয়তান তাঁকে অনবরত প্ররোচনা দিতে থাকে।

এতো বড় পরীক্ষায় পড়েও হযরত আইয়ুব (আঃ) সবর অবলম্বন করেন, ধৈর্য ধারন করেন। প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করেন। তিনি সুসময়ে যেমন তাঁর প্রভুর কৃতজ্ঞ ছিলেন, দুঃসময়েও ঠিক তেমনি কৃতজ্ঞ ছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত দুঃখ কষ্টের জন্যে কেবল মহান আল্লাহর কাছেই ফরিয়াদ করতেন। কেবল তাঁরই কাছে সাহায্য চাইতেন। তিনি বলতেন-

“প্রভু, আমি বড় কষ্টে আছি। আর তুমি তো সব দয়ালুর বড় দয়ালু। প্রভু, শয়তান আমাকে বড় কষ্ট ও যন্ত্রনা দিচ্ছে, তুমিতো আমার অবস্থা দেখছো।”

হযরত প্রায় সতের আঠারো বছর এই কঠিন রোগ ও অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকেন। অবশেষে আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন। তিনি তাঁকে পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে বলেন। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪২)। হযরত আইয়ুব তাই করলেন। কী আশ্চর্য, পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করার সাথে সাথেই সেখান থেকে সচ্ছ পানির একটা ঝর্নাধারা প্রবাহিত হলো। আল্লাহ তাঁকে এ পানি পান করতে এবং এ পানি দিয়ে গোসল করতে বলেন। তিনি তাই করলেন। এর ফলে আল্লাহর দয়ায় তাঁর রোগ ভালো হয়ে গেলো।

বিবি রাহমা

রাহমা নামে হযরত আইয়ুবের একজন স্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আল্লাহভীরু, সতী এবং স্বামী পরায়না। দীর্ঘ রোগের কারনে আপনজন সবাই হযরত আইয়ুবকে ছেড়ে চলে যান। কিন্তু রাহমা। তাঁর স্ত্রী রাহমা তাঁকে ছেড়ে যাননি। বছরের পর বছর ধরে তিনি স্বামীর সেবা যত্ন করেন। অসাধারন ধৈর্যগুণ থাকলেই কোন নারী এতো বছর ধরে কঠিন রোগেও স্বামীর সেবা করে যেতে পারেন। শয়তান হযরত আইয়ুবকে সরাসরি কোন ধোঁকা দিতে না পেরে রাহমার কাছে এলো। সে রাহমাকে এই বলে প্ররোচনা দিতে থাকে, তুমি আর কতকাল সহ্য করবে? দিনের পর দিন শয়তান তাঁকে এভাবে অসঅসা দিতে থাকে। তাঁকে প্ররোচিত করতে থাকে। অবশেষে একদিন এসে তিনি স্বামীকে বললেন – এভাবে আর কতকাল পরীক্ষা চলবে? আর কতকাল বিপদ মুসিবত সইয়ে যাবো?

একথায় হযরত আইয়ুব অত্যন্ত মনোক্ষুণ্ণ হলেন। তিনি স্ত্রীকে বললেন – যতদিন দুঃখ কষ্টের মধ্যে আছো, তাঁর চেয়ে বেশী দিন কি সুখের মধ্যে কাটাওনি? যতোদিন আমি সুখে ছিলাম ততোদিন দুঃখ ভোগের আগে এ অবস্থা দূর করে দেয়ার জন্যে আল্লাহর কাছে আবদার করতে আমার লজ্জা হয়। হযরত আইয়ুব স্ত্রী রাহমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। কিন্তু তাঁর মুখে যখন অধৈর্যের কথা শুনলেন এটাকে তিনি আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা মনে করলেন এবং অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। রাগের মাথায় তিনি কসম খেয়ে বললেন, এ অধৈর্যের জন্যে আমি তোমাকে একশত বেত্রাঘাত করবো। রাগ স্তিমিত হলে তিনি পেরেশান হয়ে উঠলেন, যদি কসম বাস্তবায়ন করি তাহলে তো একজন নিরপরাধকে শাস্তি দেয়া হয়। আর যদি কসম বাস্তবায়ন না করি তাহলে তো গুনাহগার হতে হয়। এর সমাধান চেয়ে তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন। তিনি যতগুলো বেত্রাঘাত করার অংগীকার করেছেন, আল্লাহ তাঁকে ততগুলো শলা দিয়ে একটি আটি বানাতে বললেন। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৪)

আর সেই আটি দিয়ে বিবি রাহমাকে একটি মৃদু আঘাত করতে বললেন। ব্যাস, তিনি তাই করলেন। তাঁর অংগীকার পূর্ণ হয়ে গেলো। মহান আল্লাহ তাঁদের দুজনের চিন্তা দূর করে দিলেন এবং তাঁদেরকে নিজের রহমত দ্বারা সিক্ত করলেন।

 

ফিরে এলো সুখের দিন

এবার হযরত আইয়ুব (আঃ) এর সুখের দিন ফিরে এলো। আল্লাহ তাঁকে রোগ ভালো করে দিলেন। আবার প্রচুর ধন সম্পদ দান করলেন। তাঁর সন্তান ও আত্মীয় স্বজনরা ফিরে এলো তাঁর কাছে। তিনি সুস্থ শরীরে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে লাগলেন। বহু দুঃখ কষ্টের পর বিবি রাহমার জীবনে আবার সুখের দিন ফিরে এলো। কোথায় বলে ‘সবুরে মেওয়া ফলে’। হযরত আইয়ুব সবর করেছিলেন, বিবি রাহমা সবর করেছিলেন। তাই সুখের দিন ফিরিয়ে দিয়ে আল্লাহ তাঁদের সবরের প্রতিদান দিলেন।

 

আল কুরআনে তাঁর প্রশংসা

মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদে হযরত আইয়ুব (আঃ) এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন-

১. আমি আইয়ুবকে পেয়েছি পরম ধৈর্যশীল। সে ছিলো আমার এক উত্তম গোলাম, ছিলো আল্লাহমুখী। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৪)

২. আইয়ুবের ব্যাপারটি ছিলো বুদ্ধিমান লোকদের জন্যে শিক্ষণীয়। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৪)

৩. আইয়ুবের ঘটনা ইবাদাতকারীদের জন্যে শিক্ষণীয়। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৮৪)

৪. হে মুহাম্মাদ, আমি তোমার কাছে অহী পাঠাচ্ছি ঠিক সেভাবে, যেভাবে পাঠিয়েছিলাম নুহ এবং তাঁর পরবর্তী নবীদের কাছে——- ঈসা, আইয়ুব, ইউনুস, হারুন এবং সুলাইমানের কাছে। (সূরা আন নিসা, আয়াত ১৬৩)

 

শিক্ষণীয় বিষয়

বুদ্ধিমান লোকদের জন্যে যে হযরত আইয়ুবের জীবন চরিত থেকে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে, তাতো মহান আল্লাহ পাকই পবিত্র কুরআনে বলেছেন। সত্যি তাই। আসুন দেখি, আমরা তাঁর জীবন চরিত থেকে আমরা কি কি শিক্ষা পাই।

১. প্রাচুর্যের সময় আত্মহারা হয়ে আল্লাহকে ভুলে যেতে নেই।

২. ধন সম্পদ, সন্তান সন্ততি, মান ইজ্জত এই সবকে আল্লাহর দান মনে করা উচিত এবং এগুলোর জন্যে আল্লাহর শোকর আদায় করা উচিত।

৩, রোগ শোক, দুঃখ কষ্ট ও বিপদে মুসিবতে ধৈর্যহারা হতে নেই। বরং ধৈর্যের সাথে আল্লাহর উপর আশা ভরসা করে থাকা উচিত।

৪, বিপদ মুসিবত, দুঃখ কষ্ট রোগ শোক ও অসহায় অবস্থায় শয়তান মুমিনদের সাথে প্রতারনা করার সুযোগ নেয়। তাই এসব অবস্থায় শয়তানের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এবং শয়তানের প্ররোচনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে থাকতে হবে।

৫, সুখের সময় আল্লাহর শোকর আদায় করা এবং দুঃখের সময় সবর অবলম্বন করা নবীদের আদর্শ।

৬, রাগ বশত কোন ভুল করে ফেললে সেজন্যে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।

৭, রোগ শোক, দুঃখ কষ্ট, বিপদ মুসিবতে একজন মুমিন স্ত্রীর কোনো অবস্থাতেই স্বামীর কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত নয়। বরং পরম ধৈর্য ও সবরের সাথে স্বামীর সেবা করা উচিত।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!