রক্ত–২য় পর্ব- জুবায়ের হুসাইন

গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সলিম আলীর স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল। এই তো মাত্র সেদিনের কথা, চওড়া বুকের ছাতি ছিল তার। হাত ও পায়ের পেশিগুলো ছিল তেমনি ফোলা ফোলা। আর চলার মধ্যেও ছিল একটা রাজকীয় স্টাইল। কিন্তু আজ আর চেহারার সেই জৌলুস নেই তার। শ্যামলা গায়ের বর্ণ কেমন কালচে হয়ে গেছে। কতদিন সেখানে সাবানের ছোঁয়া পড়েনি তা তিনি বলতে পারবেন না। বুকটা এখন অনেকটাই পিঠের দিকে চেপে গেছে।

পেশিতে আগের মতো জোর অনুভব করেন না। একটু যেন কুঁজোও হয়ে গেছেন। অথচ বয়স কত হবে তার, সামনের মাসে পঁয়ত্রিশে পড়বে বোধহয়।
দারিদ্র্যের কষাঘাতে সলিম আলী আজ ধুকছেন। কিন্তু তার এই অবস্থা ছিল না। স্কুল শিক্ষক কলিম আলীর একমাত্র সন্তান তিনি।

কলিম আলী এলাকায় ‘মাস্টার মশায়’ বলেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন তিনি। আশপাশের দু’পাঁচটা গ্রাম পর্যন্ত তার সুনাম ছিল। তিনি একজন আদর্শ শিক্ষকও ছিলেন। অনেককে তিনি মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন, অন্যভাবে বলতে গেলে মানুষ হিসেবে গড়তে সহযোগিতা করেছেন। অথচ নিজের একমাত্র পুত্রকে তিনি পারেননি সঠিকভাবে গড়ে তুলতে। তাহলে চেষ্টা কি তিনি করেননি? না, চেষ্টা তিনি যথেষ্টই করেছেন। কিন্তু সফল হননি। তাই দুনিয়া ছেড়ে চির বিদায় নেয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্তও তিনি চরম আফসোস করে গেছেন।

আসলে কলিম আলী চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। কিন্তু তার স্ত্রী, সলিম আলীর মা, মৌরি বানুর জন্যেই তার চেষ্টা সফলতার মুখ দেখেনি। একথা শুধু তিনি কেন, গ্রামের সবাই একবাক্যে স্বীকার করে। কলিম আলী ছেলেকে যতবার শাসন করতে গেছেন, ততবারই মৌরি বানু তাতে বাঁধ সেধেছেন। ছেলেকে প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি সকল কাজে।

ক্লাস ভাইভে পড়ার সময় যখন প্রথম রইস মুন্সির বাগান থেকে পেঁপে চুরি করে ধরা পড়ল, তখনই তিনি ছেলেকে শাসন করতে চেয়েছেন। কিন্তু কিছুই করতে দেননি মৌরি বানু। এর সপ্তাহখানেক পর যখন স্কুলের কাঁচের গেলাস ও জগ বিক্রি করে সিনেমা দেখতে গেল, তখনও ছেলেকে শাসন করতে পারেননি কলিম আলী।

ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন সময়ে তার যে অপরাধের শুরু, সেটা মহিরুহু ধারণ করল বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। সিক্সে উঠে স্কুলে অনিয়মিত হলো। দু’বছর থাকল ওই একই ক্লাসে। সেভেনটা টেনেটুনে পার হলেও এইটে ভর্তি হলো না আর। শুরু হলো তার ছন্নছাড়া জীবন।

কলিম আলী ছেলের আশা ছেড়েই দিলেন। অন্যদিকে মায়ের প্রশ্রয় পেয়ে ছেলে উচ্ছন্নে যেতে বসল। এই সময় এক চুরির ঘটনায় জেলেও যেতে হলো তাকে। মৌরি বানুর জোরাজুরিতে ছেলেকে জামিনে ছাড়িয়েও আনলেন কলিম আলী।

মা তাকে বোঝানোর ফলে আবার স্কুলে ভর্তি হলো সলিম আলী। বাকি কয়টা বছর পড়াশোনা করে সেকেন্ড ডিভিশনে মেট্রিক পাশ করল ছেলে। মফস্বল শহরের কলেজে ভর্তিও হলো। মূলত সেখান থেকেই তার অধঃপতনের চূড়ান্ত হলো।

বাবা-ছেলের সম্পর্কে আবারও ফাটল ধরল। এই সময় মা-ই আবার এগিয়ে এলেন। ছেলেকে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা চালিয়ে যেতে থাকলেন। তার আশা ছিল ছেলে একদিন না একদিন ঠিকই বুঝবে এবং বাপের মান রাখবে।

কলিম আলীও যে ছেলেকে ভালবাসতেন না তা নয়। ভালবাসতেন বলেই তো স্ত্রীর প্রশ্রয়কে মেনে নিয়েছিলেন। তিনিই তো ছেলের জন্য পকেটে টাকা রেখে দিতেন আর মৌরি বানু তা নিয়ে ছেলেকে দিতেন।

মনে যে তারও একটা ক্ষীণ আশা ছিল ছেলে একদিন ঠিকই ওপথ ছেড়ে সুপথে চলে আসবে। কিন্তু তা আর হয়নি। একরকম ছেলের চিন্তাতেই মৃত্যুমুখে ঢলে পড়লেন কলিম আলী।

 

গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!