গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে সলিম আলীর। বুকের মধ্য হতে হৃৎপিণ্ডটা ঠেলে বের হয়ে আসতে চাইছে। অনেক কষ্টে এতক্ষণ কাশির বেগটা সামাল দিয়েছেন। এখন আর পারছেন না। হাত দু’টো চরম বিরোধিতা করতে চাইছে। হাতের মধ্যে রিকসার হ্যান্ডেল দু’টো পিছলে যাওয়ার আগে রিকসাটা রাস্তার বাঁ-পাশ ঘেষে দাঁড় করালেন। তারপর সিট থেকে নিমে বসে পড়লেন মাটিতে। বুকে গলার কাছটায় এক হাত আর মাথার উপর এক হাত নিয়ে গেলেন। কাশতে লাগলেন ‘খক খক’ করে। সে কী কাশির দমক!
কাশি এখন থেমে গেছে। কিন্তু সলিম আলী একইভাবে বসে রইলেন। দু’চোখে বিস্ময়। বরং একটু আতঙ্কও ফুটে উঠল সেখানে। তাকিয়ে আছেন সামনে, মাটিতে। একটু আগে কাশির কফ তিনি ওখানেই ফেলেছেন। সাদা গ্যাঁজলা ধরনের কফের মাঝে লালের আভা ফুটে উঠেছে। গতকালও কাশির সাথে ওটা ছিল। তবে তখন ওটার পরিমাণ সীমাবদ্ধ ছিল ফোটা ফোটার মধ্যেই। কিন্তু এখন তিনি যা দেখতে পাচ্ছেন তাতে চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে যাওয়ারই কথা।
একদলা লাল রক্ত সলিম আলীর দৃষ্টির সকল শক্তিকে যেন শুষে নিয়েছে।
রিকসায় চ্যাংড়া ধরনের এক প্যাসেঞ্জার ছিল। এতক্ষণ রিকসাওয়ালার কাণ্ডকারখানা দেখে মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিল। যদিও তার কোনো তাড়া নেই, তবুও দেরি করার কারণে ভীষণ রাগ হচ্ছিল তার। চেহারাটা কেমন খিটমিটে ধরনের। যে কেউ তাকে একনজর দেখেই বলে দিতে পারবে কিছুতেই ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা তার নেই। বরং সবসময় কেমন একটা ভাবের মধ্যে থাকে। কেমন যেন রুক্ষ রুক্ষ, একটা উড়–উড়– স্বভাব তার সমস্ত দেহে স্পষ্ট।
মাথার ইয়া লম্বা চুলে ডান হাতের আঙুলগুলো চালিয়ে দিচ্ছে বারবার। ওই হাতেরই কব্জিতে শোভা পাচ্ছে পিতলের একটা বালা। সাথে পুঁথির একটা মালাও জড়ানো আছে। লোকটার বাঁ হাতটা দেখে মনে হবে ওটা অকেজো। বাঁ-উরুর উপর ওটা নিশ্চল পড়ে আছে। আসলে তা না, দেখা যাবে সে যখন কথা বলছে তখন ওই হাতটাই বারবার নড়ছে, কথার সাথে তাল মিলিয়ে, মুখের ভাষা প্রকাশে সহযোগিতা করছে।
রিকসা থেকে নেমে এলো প্যাসেঞ্জার ছোকড়া। গিয়ে দাঁড়াল সলিম আলীর পেছনে। সলিম আলী সকল বিস্ময় মাটিতে ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। ঘুরলেন প্যাসেঞ্জারের দিকে। চোখে তার নির্বাক আকুতি, ক্ষমা প্রার্থনার বেদনা।
প্যাসেঞ্জার ছোকড়া লম্বায় হয়তো সলিম আলীর চেয়ে একটু খাটোই হবে, কিন্তু সলিম আলী কিছুটা ঝুঁকে থাকায় তাকেই লম্বা মনে হচ্ছে। শার্টের উপরের দু’টো বোতাম খোলা থাকায় ওখান থেকে গলায় ঝোলানো তাবিজের বাণ্ডিলগুলো দেখা যাচ্ছে। বাণ্ডিল বলার কারণ হচ্ছে একসাথে তিন-চারটা তাবিজ সে ব্যবহার করছে। সাথে ব্রাহ্মণের পলতের মতো লাল-সাদায় মিশ্রিত একটা সুতোও দেখা যাচ্ছে। অনেকটা ভারতীয় ক্রিকেটার শ্রীশান্ত’র মতো। তবে এই ছোকড়াটার স্বাস্থ্য একটু ভালো, এই যা।
প্যান্টের পেছনের মানিব্যাগ হাতে নিয়ে টাকা বের করলো ছোকড়া। দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে ধরল সলিম আলীর দিকে। বলল, অনেকটা ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে, ‘এই ন্যাও ভাড়া। রোগ নিয়ে রিকসা চালাও ক্যান্? চিকিৎসে কত্তি পারো না? দেখে তো মনে হয় যক্ষ্মা হয়েছে।’ তারপর চলে গেল এলোমেলো পা ফেলতে ফেলতে।
যতক্ষণ দেখা যায় সেদিকে তাকিয়ে রইলেন সলিম আলী। তারপর হাতে ধরা দশ টাকার নোটটার দিকে একবার তাকিয়ে লুঙ্গির খুট খুলে পলিথিনের ঠোঙাটা বের করে তাতে গুঁজে আবার যথাস্থানে রাখলেন।
সলিম আলী গায়ে খুব জোর পাচ্ছেন না। সব যেন কফের সাথে বের হওয়া ওই রক্তের মাঝেই থেকে গেছে। তার সমস্ত শক্তি কেড়ে নিয়েছে ওই রক্ত। ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখলেন সাদার মাঝে লাল জারক রসটুকু। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রিকসায় চড়ে বসলেন। আজ আর রিকসা চালাবেন না।
ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে চললেন তিনি।