হরিপুরের হরেক কান্ড–সপ্তম পর্ব- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

গল্পের অষ্টম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

ওরে না না, এ সেইসব কাণ্ড নয়। এ হল অশৈলী ব্যাপার। শূলপাণিকে যে নিয়েছে তোর পিসেমশাইকে সে-ই নিয়েছে। তাকে চিরকাল দেখে এসেছি, কোনও কালে আমাকে না বলে এক পাও কোথাও যায় না। তেমন মানুষই নয়। বাক্স, বিছানা, বন্দুক এত সব জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়া কি একজন মানুষের কাজ, বল তো !

সেই কথাই তো বলছি, পিসেমশাই ঝাড়া হাতপায়েই গেছেন, বাকি জিনিসগুলো চোরে নিয়েছে। দাঁড়াও থানায় একটা খবর পাঠাচ্ছি।

থানায় খবর গেল, পুলিশও এল। তার আগে এল গাঁ-শুদ্ধ লোক। নগেন দারোগা বলল, পরঞ্জয়বাবু রাশভারি সিরিয়াস মানুষ, এমন হঠকারিতা করবেন না, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কোনও কাজ করে বসার মানুষ নন। সুতরাং তাঁর নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে অন্য পক্ষের হাত থাকা বিচিত্র নয়।

হরিপুরের নদীর ধারে সকালে বাজার বসেছে। হরিপুরের বাজারের বেশ নামডাক। তার ওপর আজ হাটবার হওয়ায় লোকে একেবারে লোকারণ্য।

গজানন হালুইকরের দোকানে বিখ্যাত সাড়ে সাত প্যাচের জিলিপি ভাজা হয়েছে। গন্ধে চারদিক ম ম, মানুষ ভেঙে পড়েছে দোকানের সামনে। আড়াই প্যাঁচের ফিনফিনে জিলিপি এ নয়। গজানন হাতের কায়দায় সাড়ে সাত প্যাঁচ এমন সুন্দর মিলিয়ে করে যে ছোট-বড় হওয়ার উপায় নেই।

জিলিপির লাইনে একটু পেছনের দিকে জগা আর পাগলু দাঁড়িয়ে পাছে লোকে চিনতে পারে সেই ভয়ে দুজনেরই মুখ বাঁদুরে টুপিতে প্রায় ঢাকা। তার ওপর গামছা জড়িয়ে মুখ এমন আবড়াল করেছে, যে চেনা লোকও চিনতে পারবে না।

জগা চারদিকে ভাটার মতো চোখে তাকাচ্ছিল, হঠাৎ চাপা গলায় বলল “ওই যে ”

পাগলু জগার মতো নয়, তার চোখ ভাটার মতো ঘোরে না, বরং সবসময়ে একটা ঘুসঘুস ভাব। বলল, “কোথায় ?”

পেছনে বাঁ দিকে, পানের দোকানের আয়নায় গোঁফ চোমরাচ্ছে। গায়ে সবুজ জামা আর কালো পাতলুন।

পাগলু গম্ভীর গলায় বলল, “হুম ”

“দেখেছ ?”

“দেখে নিয়েছি।”

“এখন কী করবে ?”

“চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। আমরা যে দেখেছি তা বুঝতে দিসনি।”

“ঠিক আছে। কিন্তু তোমাকে আগেভাগেই বলে রাখছি, আমার কিন্তু গজাননের সাড়ে সাত প্যাঁচের জিলিপি খাওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই। সকালে এককড়ি পান্তাভাত খেয়ে তার ওপর এক হাড়ি দই আর আঠারোটা সন্দেশ খেয়ে তবে এসেছি।”

পাগলু বলল, “পান্তাভাত খেয়েছিস সে বুঝলাম, কিন্তু দই আর সন্দেশটা সকালে কোথায় পেলি? লটারি মেরেছিস নাকি ?”

জগা মাথা চুলকে বলে, “আর বলো কেন, কাল সুধীর ঘোষের মেয়ের বিয়ে ছিল, জোগান সেজে ঢুকে পড়েছিলুম, যদি কিছু সরানো যায়। তা গয়নাগাটি পয়সাকড়ি কিছু তেমন জুটল না। শেষ অবধি দু হাড়ি দই আর দু বাক্স সন্দেশ নিয়ে পালিয়ে এসেছি।”

ঘন ঘন মাথা নেড়ে পাগলু চলল “না না, তোর নজর নিচু হয়ে গেছে রে জগা। তোকে দিয়ে আর বড় কাজ হবে না।”

জগা মুখখানা বড্ড কাচুমাচু করে বলল, “ওরকম করে বোলো না গো পাগলুদাদা, বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে, ভাগ্যের চাকা একদিন ঘুরবে এই আশা নিয়েই তো বেঁচে আছি, তাই তো চিরকুটটা পেয়েই তোমাকে খবর দিয়ে এনেছি এখানে, এবার যদি দাও মারা যায় একখানা।”

“এই সেরেছে। বিশে তো জেনে গেল তা হলে ; কথাটা যে পাঁচকান হয়ে যাবে।”

“তোমার কী মনে হয় বলে তো পাগলুদাদা? এতদিনে কি ভগবান মুখ তুলে চাইবেন?”

“ভগবানের তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই, এত লোক থাকতে তোর-আমার মতো অখদ্দে লোকের দিকে মুখ তুলে চাইবে, চিরকুটটা তো পেয়েছিস তোর ঘরের মেঝেয়। তা সেটা বাতাসে উড়ে জানালা দিয়ে এসেও তো পড়তে পারে। কে কাকে কী উদ্দেশ্যে লিখেছে কে জানে ৷”

“না গো পাগলুদাদা, তা নয়, যত্ন করে ভাঁজ করা কাগজ, জানালার নীচেই পড়ে ছিল, কেউ জানালা দিয়ে টুক করে ভেতরে ফেলে গেছে। দেখছ না পানের দোকানের সামনে সবুজ জামা গায়ে লোকটা দাঁড়িয়ে আড়ে আড়ে এদিকে দেখছে!”

“তুই তো একটা সবুজ জামা দেখেই কাত হয়ে পড়লি, আমি যে বিস্তর সবুজ জামা দেখছি। ওই তো হরুর সেলুনে খেউরি হচ্ছে এক সবুজ জামা, ওই দ্যাখ গোপালের দোকানে আর এক সবুজ জামা চটি সারাচ্ছে।”

“তাই তো পাগলুদাদা, এ যে দেখছি হাটভর্তি সবুজ জামা! আজ কি সবাই আমাদের সঙ্গে শত্ৰুতা করতেই সবুজ জামা পরে এল নাকি ?

গল্পের অষ্টম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!