জানোয়ারের ঘুম –শেষ পর্ব-সুকুমার রায়

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

পাখিরা কেমন করিয়া ঘুম যায় দেখিয়াছ ত? কাকাতুয়া যেমন দাঁড়ে বসিয়া ঘুমায়, সেইরকম অনেক পাখিই গাছের উপর খাড়া হইয়া ঘুমায়। কেহ কেহ বা পা মুড়িয়া মাটির উপর চাপিয়া বসে। বক যে এক ঠ্যাঙে দাঁড়াইয়া চমৎকার ঘুমাইতে পারে তাহা সকলেই জান। প্যাঁচা প্রভৃতি কোন কোন পাখি ঘুমাইবার সময়ে গায়ের পালক ফুলাইয়া আপনাদের শরীরটা প্রায় দ্বিগুণ বড় করিয়া তোলে। একরকম চন্দনা আছে তাহারা ঠিক বাদুড়ের মতো গাছের ডালে ঝুলিয়া ঝুলিয়া ঘুমায়। বাদুড় কেমন করিয়া ঘুমায় তাহা তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ—তাহারা মাথা নীচের দিকে রাখিয়া ডানা মুড়িয়া ঝাঁকে ঝাঁকে গাছের ডাল হইতে ঝুলিয়া থাকে। সে এক চমৎকার দৃশ্য। শীতের সময়ে কলিকাতার ইডেন গার্ডেন্‌সে মাঝে মাঝে বাদুড়ের ঝাঁক দেখিয়াছি। বাদুড়েরা নাকি দিনের বেলায় ঘুমায়, কিন্তু এগুলি যেরকম ক্যাট্‌ ক্যাট্‌ শব্দ আর ছট্‌ফট্‌ করিতেছিল তাহাই যদি ঘুমের নমুনা হয়, তবে না জানি সে কিরকমের ঘুম।

ঘুমাইবার পূর্বে বাদুড়েরা যেরকম ঘটা করিয়া ঘুমের আয়োজন করে তাহা দেখিলে বাস্তবিকই হাসি পায়। লম্বকর্ণ বাদুড় ঘুমাইবার সময় প্রথমেই গাছের ডাল আঁকড়াইয়া ঝুলিয়া পড়েন তারপর ডানা দুইটি দু-চারবার ঝাড়িয়া খুব সাবধানে ভাঁজ করিয়া বন্ধ করেন। তারপর ফট্‌ করিয়া একটি প্রকাণ্ড কান মুড়িয়া যায়; খানিক বাদে সে আর একটি কানও ঠিক ঐরকম হঠাৎ গুটাইয়া লয়—তখন আর তাহাকে চিনিবার যো থাকে না।

বাদুড়ের কথা বলিতে গিয়া আরেকটা জন্তুর কথা মনে হয়, সে আপনাকে রীতিমত ‘বেনের পুঁটুলি’ পাকাইয়া ঘুমায়। তখন তাহাকে দেখিলে হঠাৎ জানোয়ার বলিয়া চিনিতে পারাই অসম্ভব। মনে হয়, যেন একটা প্রকাণ্ড ফল বা মৌচাক ঝুলিয়া আছে। এই জন্তুর নাম কোবেগো। দেখিতে কতকটা বাদুড়ের মতো হইলেও এটি বাদুড় নয় এবং ইহার ডানাটাও বাদুড়ের ডানার মতো ছড়ান নয়। বাদুড়ের মতো উড়িতে না পারিলেও ইহারা এই ডানায় ভর করিয়া স্বচ্ছন্দে লাফ দিয়া ১০০/১৫০ হাত পার হইয়া যায়। ইহাদের ছানাগুলি বাঁদরের ছানার মতো সবসময়ে মায়ের বুক আঁকড়াইয়া থাকে। এইরকম পুঁটুলি পাকাইবার অভ্যাসটা ‘বর্মধারী’ বা আর্মাডিলো প্রভৃতি আরও কোন কোন জন্তুরও দেখা যায়।

মাথা ঝুলাইয়া ঘুমান যাহাদের অভ্যাস, তাহাদের মধ্যে আর একজনের কথা বলিয়া শেষ করি। ইহার ইংরাজি নাম ‘স্লথ’ অর্থাৎ অলস। বাস্তবিক এমন ঢিলা স্বভাবের অলস জন্তু আর বড় দেখা যায় না। গাছের ডালে ঝুলিয়া ঝুলিয়া আর অকাতরে ঘুমাইয়া ইহারা সারাবছর কাটাইয়া দেয়।
চিৎ হইয়া মাঝে মাঝে নীচের দিকে তাকান, মাঝে মাঝে হাত বাড়াইয়া গাছের পাতা খাওয়া, আর যখন তখন ঘাড় গুঁজিয়া ঘুমান—ইহাই যেন ইহাদের জীবনের কাজ। যখন এক ডালের পাতা ফুরাইয়া গেল, তখন আর এক ডালে যাওয়াটা যেন ইহাদের পক্ষে প্রাণান্তকর। ধীরে ধীরে একটু একটু করিয়া ভুঁড়ি দুলাইয়া, আস্তে আস্তে হাত পা বাড়াইয়া আধ মিনিটের কাজ আধ ঘণ্টায় সারিতে না সারিতে ইহারা আবার পরিশ্রান্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়ে। বাস্তবিক ইহারা এমন অলস যে অনেক সময়ে ইহাদের মাথায় একরকমের শেওলা গজাইয়া সবুজ রঙের স্যাঁৎলা পড়িয়া যায়। পুরাণে বলে, বাল্মীকি, চ্যাবন প্রভৃতি ঋষিরা ধ্যানে বসিলে তাঁহাদের গায়ে উইয়ের ঢিপি গজাইয়াছিল। ইনি সারাদিন চিৎপাত হইয়া যে কিসের ধ্যান করেন তাহা জানি না—কিন্তু মাথায় শেওলা গজাইয়া আরেকটু বুদ্ধি গজাইলে বোধহয় কতকটা সুবিধা হইত।

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

দুঃখিত!