পাইন-পাতার রূপকথা–২য় পর্ব-সাত্যকি হালদার

গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

মেরিকা বুড়ি থাকত রাস্তা যেদিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে সেই দিকটায়। গ্রামের একমাত্র যে-ছোট্ট মনাস্ট্রি, তার কাছাকাছি। গাছপালার ভেতর কাঠের মনাস্ট্রি। ভেতরটা আধো-অন্ধকার। বড় শহরের যে বড় মনাস্ট্রি তার চাইতে অনেক অনেক ছোট।  মনাস্ট্রি-লাগোয়া যে ছোট ঘর, সেখানে বুড়ির তত্ত্বাবধানে সেই রাতে রেখে দেওয়া হয় তাকে।
গ্রামে ট্র্যাকাররা এলে এই ঘরে থাকে, ভবঘুরে মিসকিনদের জন্যও এই ঘর। গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিল যারা তাদের দুজন এসে দুটো কম্বল রেখে যায়। বুড়ি বড় একবাটি থুকপা ফুটিয়ে সন্ধের পর ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল।

সকালবেলা ফুলবা আসে। ফুলবা দোরজে। কালিম্পংয়ের হোটেলে কাজ করে ও। সপ্তাহে একদিন বাড়ি আসে। গ্রাম থেকে একমাত্র শহরে কাজ করতে যাওয়া ছেলে ওই ফুলবা। ও এসে আগের দিনের সেই মানুষটাকে দেখে বলে, ওর নাম মনে হয় নারিয়া। কালিম্পং বাজারে গত কমাস ধরে দেখেছি। ওখানে সবাই চিনে গিয়েছিল ওকে। দুপুরের পর থেকে যন্ত্রটা বাজিয়ে গান গেয়ে যেত ডম্বারচকের সিঁড়ির ধাপে বসে।

পরদিন ও চলে যেত ঠিকই কিন্তু কেউ ওকে যাওয়ার কথা বলল না। কখন যাবে, কোথায় যাবে – সেসব কিছু নয়। ও-ও বলল না কিছু। বরং দুপুরের পর মনাস্ট্রির ওখান থেকে বেরিয়ে ছোট গ্রামটার এদিক-ওদিক ঘুরল। ভাঙা নেপালি, ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলল দু-একজনের সঙ্গে। নিচে নদীর দিকে প্রতিদিন গরু চরাতে নিয়ে যাওয়া নরবু লেপচার ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখল দরজায় পর্দা ধরে নরবুর সাত-আট বছরের মেয়েটা দাঁড়িয়ে। ও ওর সেই পরিচিত হাসিটা হাসল। তারপর নেপালিতে বলল, বিকেলে বৃষ্টি না হলে সামনের মোড়ে যেও। পাহাড়ি রাজকুমারীদের পুরনো গান হবে।

নরবুর মেয়ে রম্মিত নতুন লোককে দেখে লজ্জা পেল। আরো লজ্জা পেল রাজকুমারীর গানের কথা শুনে। কিন্তু লোকটার হাসিমুখ দেখে পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে টানা চোখের নিচে রম্মিত হাসল একটু।

বিকেলে গান হলো না। ওই বৃষ্টির জন্যই হলো না। পাহাড়ের এদিকের বৃষ্টি তো আশ্চর্য ধরনের। দিন নেই, রাত নেই। শীতকাল নেই, বর্ষাকাল নেই। শুরু হলেই হলো। যতক্ষণ বৃষ্টি ততক্ষণ বাইরে কেউ নয়। মোড়ের মাথার মোটা লেজের কুকুরগুলোও নয়, এমনকি এখানে-ওখানে ঘোরা জুলে শেরপাও নয়। চারদিকের পাইন আর সরু পাতার লম্বা গাছেরা বাধ্য ছেলের মতো পাতা নামিয়ে ভিজবে। অনেক দূরের পাহাড়গুলো ধোঁয়া-ধোঁয়া হয়ে থাকবে। আর গ্রামের পথে লাফিয়ে নামা ঝরনার শব্দটা বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। উমাশংকরের দোকানের পাশে তার মধ্যে এসে বসেছিল লোকটা। টিংটিং করে ম্যান্ডোলিন বাজিয়ে নিচু সুরে কী একটা গান গাইছিল। ফুলবা এসে নামধাম বাড়িঘর নিয়ে দু-চারটে কথা জিজ্ঞাসা করায় ও একবার বলল আলগরার কথা, একবার বলল গ্রামহোমসের হোস্টেলের কথা।

আর বাপ-মা?

ও গান থামিয়ে ঠোঁটে হেসে বলল, ছিল, আপাতত কেউ নয়।

কিন্তু এই লোকটাকেই কদিনের মধ্যে ভালোবেসে ফেলল গোটা গ্রাম। তা শুধু ওর গানের জন্য নয়। ও-ও কেমন মিশে গেল সবার সঙ্গে। মনাস্ট্রি ওর থাকার জায়গা ঠিকই কিন্তু ওর খাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট ঠেক নেই। যে যেদিন পারে ডেকে নেয় ওকে। উমাশংকরের বউ ডাকে। ফুলবা কালিম্পংয়ে থাকলেও ফুলবার মা ডাকে। গরু চরানো নরবু ডাকে যেদিন গরু নিয়ে নিচে নদীর ঢালে না-যাওয়া হয়। আর নরবুর মেয়ে ওকে দেখলে পর্দার আড়ালে একটু-একটু হাসে।

বারমিক বলে শুধু নয়, এরকম সব পাহাড়ি গ্রামেই বেশিরভাগ দিন ঠিক আগের দিনটার মতো। সকালের দিকে যার যেটুকু কাজ সে সেটুকু করে। যে-মেয়েরা ওপরের পাহাড়ে ঘাস আনতে যায় তারা দুপুর না গড়াতে ফিরে আসে। বাচ্চাদের ইশ্কুল শেষ হয়ে যায় বেলা এগারোটার মধ্যে। উমাশংকরের দোকানের কেনাবেচাও সকাল শেষ হলেই একেবারে ঢিলেঢালা হয়ে আসে।

 

গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!