পাইন-পাতার রূপকথা– ১ম পর্ব-সাত্যকি হালদার

গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
মানুষটা কবে থেকে এলো তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল অনেক। এক-একজন একেক রকম কথা বলত। কেউ বলত, পাশেই আলগরায় ওর জন্ম। পরে এদিকে চলে আসে। বুড়ো জুলে শেরপা বলত, আদতে ও এদিকের লোকই নয়। বাপ-মার সঙ্গে কখনো পাহাড়ে এসেছিল। কোনো একটা বোর্ডিং ইশ্কুলে নাকি ভর্তি করে দিয়ে গিয়েছিল বাবা-মা। পরে যে-কোনো কারণে হোক খোঁজ নিতে পারেনি। তারপর থেকেই নাকি ও এদিকে।

কিন্তু হঠাৎ বারমিকের মতো একটা জায়গায় কেন চলে এলো ও! আশেপাশে তো আরো কত জায়গা। ছোট-বড় শহর। মানুষ তো শহরে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। বারমিক তো গ্রাম। পাহাড়ের ঢালে একটা গ্রাম। ছড়ানো-ছিটানো কিছু বাড়ি।

কালিম্পং থেকে রংপো যাওয়ার যে পাকা রাস্তা গ্রাম চিরে চলে গেছে তার ধারে গোটা চার-পাঁচ দোকান। নিচে, অনেকটা নিচে খানিকটা সমানমতো জায়গায় একটা খেলার মাঠ। আরেকটা ঝরনা আছে গ্রামের গা-ঘেঁষে। অনেকখানি পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে একটা চওড়া পাথরের ওপর পড়ছে। সেখান থেকে প্লাস্টিকের বোতলে বা জারিকেনে ভরে জল আনে গ্রামের লোকেরা। সেটাই বলতে গেলে বারমিকের খাওয়ার জল। পথচলতি ড্রাইভাররা অনেক সময় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ঝরনা থেকে তাদের বোতলে জল ভরে নেয়।

এসব নিয়েই একটা গ্রাম, ছোট গ্রাম পাহাড়ের গায়ে।

উমাশংকর নামে একটা লোক অনেকদিন আগে বিহার-মুলুক থেকে এসে প্রথম মুদিদোকানটা করেছিল বারমিকে। সে-দোকানটা এখনো চলছে। উমাশংকরের ছোট দোকানটা আসলে এখানকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। চাল-ডাল-আদা থেকে দড়ি-সাবান-হাওয়াই চটি, এমনকি জ্বর, মাথাব্যথা, পেটের গোলমালের ওষুধটুকুও মেলে। এক-দুদিন আগে অর্ডার দিলে উমাশংকর কালিম্পং বাজার থেকে ছোট বাচ্চাদের জামাকাপড় বা টিফিন ক্যারিয়ার এনে দেয়। ছোট দোকান। উমাশংকরের খানিকটা বয়স হয়ে গেছে। ও আর ওর বউ মিলে দোকানটা চালায়।

এছাড়া বারমিকের নিচে ওই খেলার মাঠের কাছাকাছি একটা প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। দুজন দিদিমণি। ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর। সকালবেলা পিঠে ব্যাগ নিয়ে বাচ্চারা গুটিগুটি পায়ে স্কুলের পথে নেমে যায়। ফিরে আসে এগারোটা নাগাদ। ডিসেম্বর-জানুয়ারির খুব ঠান্ডা আর জুলাই-আগস্টের বৃষ্টিতে স্কুল বন্ধ থাকে কিছুদিন। সেই সময় পুরো পাহাড়ি গ্রামটাই বলতে গেলে অচল হয়ে যায়। ঘরে আটকে থাকে সবাই।

তারপর রোদ উঠলে আলো ফুটলে আবার বাইরে আসা। আবার স্কুল চালু। উমাশংকরের দোকানের পাশে গুমটি মতো জায়গায় বিকেলের দিকে কিছু লোকজন জড়ো হয় আবার। নিচে খেলার মাঠ থেকে খানিক পরপর ছেলেদের গলা শোনা যায়।

এরকম একটা শীতের শেষেই এসে হাজির হয়েছিল ও। তখন কত বয়স হবে, হয়তো চল্লিশ। গুটিগুটি পায়ে এক দুপুরে এসে বসেছিল পাকা রাস্তার ধারে দোকানের পাশে গুমটিমতো জায়গাটায়। একটা টাইট জামা, সোয়েটার, ঢোলা প্যান্ট, গলা থেকে ঝোলানো একটা ছোট যন্ত্র, তারের। ও বলেছিল, ম্যান্ডোলিন। কোথা থেকে এসেছে তা জানার আগে বিকেলে হাজির হওয়া আমুদে লোকজন বলেছিল, হলো তো ম্যান্ডোলিন, তা বাজাও তো শুনি।

সেই বিকেলেই কাঁধ থেকে ঝোলানো যন্ত্রটা বাজিয়ে শুনিয়েছিল ও। সঙ্গে নিচু সুরে গান। দুটো নেপালি, একটা লেপচা, ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি। প্রথম বিকেলেই লোকজন মুগ্ধ। কোত্থেকে এলে ভাই?

ও হেসেছিল। বলেছিল, এই হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম।

যাবে কোথায়?

এখনো ঠিক করিনি। আবার ঠোঁটে-চোখে হাসি। যেদিকে দুচোখ যায়।

আজ রাতে?

তোমাদের এখানে কোথাও থাকি।

এরকম পাহাড়ি গ্রাম কখনো কাউকে ফেরায়নি। পাহাড়ের পথে মাঝে মাঝেই নানা রকম লোক চলে আসে। কাঁধে বড় রুকস্যাক ফেলা ট্র্যাকিংয়ে চলা মানুষ, বেশিরভাগ ছোট দলে, কখনো একা। এক রাত থেকে যায়। বছরে এক-দুজন ভবঘুরে। দেশি বা বিদেশি। এলোমেলো ঘুরে-বেড়ানো লোক। এই লোকটাও সেরকমই কেউ। সঙ্গে গান জানে। ফলে বারমিক তাকে যত্ন করেই সে-রাতে রেখে দেয়।

গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

দুঃখিত!