জলদি ব্যাপারীর কথা মনে আছে তোর, আয়নাল ? আরে সেই যে ফুকুরহাটির সেই রে, মনে করতে পারছিস না?
আয়নাল না চিন্তে পারার বদৌলতে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে ভাবে পরে না’সূচক মাথা নাড়ে, বলে এ জীবনে কতজনকেই তো চিনতাম। সব ভুলে গেছি। কতদিন হল ওপথ ছেড়েছি, তুই বলে যা। নগেন ওকে মনে করাতে না পেরে হতাশ হয়। কিন্তু হাল ছাড়েনা।
নগেন বলে চলে, এক হাতে রাম দা আর পিঠে স্টেন নিয়ে কেউই পাগলা ষাঁড়ের মত ছুটতে পারেনা। অনন্ত সাধারণ কেউ নয়। বুকভরা যার সাহস আর দু’চোখে যার দ্রোহিতার কালচে আগুন জ্বলে কেবল তারাই পারে এমন দুঃসাহস দেখাতে। এ বাংলায় যখন হিন্দুপাড়াগুলো মৃত্যু-নরকে পরিণত হয়েছিল, জলদি তখন একাই লুঙ্গি কাঁছা দিয়ে দৌড়ে গিয়েছিল। সে ছিল সত্যিই এক খাঁটি কমরেড। আমার পরম বন্ধু। তার মত ইস্পাত দৃঢ় মনোভাবের মানুষই আজ আর কোথাও নেই!
নগেন থামেনা অন্যমনস্কভাবে বলে যায়- বর্তমানে এদেশের সাধারণ মানুষকে গালমন্দ করেই বা লাভ কি এদেশের পার্টিতে তো চিরকাল পেটিবুর্জোয়ার পোদ্দারি। কুঁদুলি করেই দল দশ টুকরো। কারো বাপের দেশ নয়তোবা কারো জামাইয়ের দেশ। আমরা যে দেশের লাইগা সব হারাইলাম, আমাগো কি? কিছুই না ! কী বিপ্লব হইবো এদেশে! নটকা হইবো, নটকা !
আয়নাল মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চুপ করে শোনে প্রতিবাদ করেনা। তারপর হঠাৎ একসময় নগেন আবার বলে ওঠে তুই চিনিস! কান্দাপাড়া থেকে তেওতায় প্রায়ই যেত, একবার বিশাল তিন মণের এক রুই উঠিয়েছিল।তো কী হয়েছে বলেই ফেলনা, আয়নাল নগেনের চেনানোর প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দেয়না। নগেন না থেমে অনর্গল বলে যায়, আরে মনে পড়ছেনা কেন তোর, তুই কৃষ্ণপুর ক্যাম্পের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছিলি, জলদি ব্যাপারীর সাথে থেকে দারুণ এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল, জলদি ভাই দারুণ এক কমরেড!
কী জানি, কিছু মনে পড়ছেনা ভুলে গেছি, বলতে বলতে আয়নাল ‘আবুল বিড়ি’ ধরায়। নগেন বিড়ি-টিরি খায়না। ট্যাক থেকে তাঁজা একটা তৈরী পান বের করে মুখ পুড়ে নেয়। কিছুক্ষণ বাদে পিক করে, পানের পিচকি মাটিতে ফেলে। সে আবার ওকে মনে করাতে চেষ্টা করে, তুই একবার ধরা পরেছিলি। জলদি ভাই তোকে উদ্ধার করে এনেছিল তুই জড়িয়ে ধরেছিলি জলদি ভাইকে! হ্যাঁ এবার একটু একটু মনে পড়ছে, আয়নাল ঘাড় নেড়ে নগেনের দিকে তাকায়।আমাদের চিরকালের অভিজ্ঞতা ছিল, যে একবার ধরা পরে তাকে আর ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দীক্ষার চেয়ে এ ব্যাপারে আমাদের ক্যাম্পের আচরণ খুব একটা আলাদা কিছু ছিলনা! কিন্তু, পরিবর্তন করেছিল, জলদি কমরেড !
আমাদের বুদ্ধিজীবী কমরেডরা এই উদ্ধারের ব্যপারে অগ্রণী ছিলেননা। এমনও হয়েছে রসদপত্র শেষ হওয়ার আগেই মাঝপথে যুদ্ধ থামিয়ে দিতে হয়েছে! কিন্তু কাঁচামরিচ ব্যাপারী জলদি ভাই যুদ্ধ থামতে দেয়নি। কখনো হাতে স্টেন ও পিঠে রামদা নিয়ে একাই লড়ে গিয়েছে। শরীর নয় যেন চাপাতির ন্যায় চকচকে ধারালো তলোয়ার। সৈন্য কম হলেও লড়েছেন।থামেন নি কখনো! নগেন আগ্রহী চোখে দেখে আয়নাল হোসেন জোয়ার্দারকে।
‘হ্যা, হ্যা, হ্যা। মনে পড়েছে এবারে, খুব ভাল কমরেড ছিল, খুব ভাল খুব ভাল!
কিন্তু এসব লোককে ধরে রাখার জন্য এদেশে সত্যিকারের কোনো বিপ্লবী পার্টিই তো গড়ে ওঠেনি, দাদা!
এটাই দুঃখের, নিজের গ্রামে সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে কৃষক সংগঠক, পার্টির কঠিন সময়ে পাকিস্তান দাবীর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তেভাগার ঝান্ডা উড্ডীন রাখতে গিয়ে নিজের গ্রামেই খুন হয়ে গেছে। পার্টি এদের যোগ্য সম্মান কখনো দেয়নি, সেদিনও না, আজও না!
দেশের ক্ষমতালোভী নেতৃত্ব কি বিপ্লব চায়? এরা বিপ্লব না করেই লেনিন শিরোপা পেতে চায়, নগেনদা! বলে আয়নাল গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ে। হুঁ, জলদি ভাইয়ের সাথে কাল দেখা হয়েছিল আফাজ চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনের ঐ ব্রীজের গোড়ায়, কাঁচা মরিচের বস্তা মাথায় নিয়ে হাটের দিকে যাচ্ছিল। আমাকে দেখতে পেয়ে ডাকল। ঠিক চিনেছে, কতদিন পরে দেখা। খুব রোগা হয়ে গেছে মানুষটা। হাঁড়গুলো চামড়ার সাথে লেগে গিয়েছে। চোয়ালগুলো ভিতরে ঢুকে গিয়েছে।এই শেষ বয়সে, বড্ড কষ্ট হয় রে তার।
আমাকে কাছে পেয়ে সেই আগের মত কাঁধ ধরে জিজ্ঞেস করলো কী করছি, কাজকর্ম কেমন চলছে!
বর্তমানে নাকি কেউ আর যোগাযোগ রাখেনা ওনার সঙ্গে, নগেন মাথা নিচু করে বলল কিছু বলতে পারলাম না রে ! দেশের পরিস্থিতির কথাও কিছু মুখ ফোঁটে বলতে পারলাম না। দেশটা বুঝি এখন আর স্বাধীন নেই । রাজনৈতিক দলগুলো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আমার দেশের রক্তে ভেজা মাটিগুলো তারা বিক্রি করে অন্য দেশের তাপনাকূল কক্ষে বসে হাওয়া খাচ্ছে।
কী বলবি তুই, কী বলার আছে তোর। হুঁ! এমন কত প্রকৃত শ্রেণী চেতনার নিষ্ঠাবান বিপ্লবী মানুষ হারিয়ে গেছে অন্ধকারে, আয়নাল বিড়ির ছাই ফেলে বিরক্তি প্রকাশ করে !
জলদি ভাই যেতে বলেছে, খুব করে বলেছে যাবি একদিন, আয়নাল? নগেন জিজ্ঞাসা করে।
না, গিয়ে আমাদের কিছু করার নেই!
আয়নাল অস্বস্তি অনুভব করে।
কিছু না করতে পারি কবিতার দোকান তো দিতে পারবো, জলদি ভাই দারুণ কবিতা লিখে। সেই দিনগুলোতে কেমন রক্তে আগুন লাগানো কবিতা লিখতো। চলনা ওই টুকুর মধ্যে নিজেদের স্বপ্নকে ধরে রাখি। নগেন, আয়নালের হাত চেপে ধরে। ওসব আমার দ্বারা আর হবে কিনা ভেবে দেখতে হবে, বলে আয়নাল।
কাল ভোরে একটু বাজারে যেতে হবে। তুই আর কি করবি , ছাত্রগুলোর পিছনে বকতে বকতে বাকি স্মৃতিগুলো অপারেট করে দিস, আমার মত। আমি চায়ের কাপ বিলি করতে করতে ছাঁটি, রোজ ছাঁটি! তুইও রোজ দিবি একটু একটু করে দিবি। এতে তুইও বাঁচবি তোর জলদিদাও বাঁচবে, যা যা বাড়ি যা!
আয়নাল অন্ধকারে ঝোঁপের মাঝে বিড়িটা ছুড়ে দেয়। অন্ধকারে আলোর শেষ বিন্দুটাও একসময় হারিয়ে যায়। দিনগুলো সত্যিই কেমন যেন পালটে যাচ্ছে। দেশ বলতে আদৌ কিছু আছে কিনা সেটাই চিন্তার দায় হয়ে গিয়েছে। চারপাশে শুধুই স্বার্থান্বেষীদের কোলাহল। দেশমাতার বুকে তবুও শহীদরা নিভৃতে ঘুমিয়ে থাকে। নগেন দেখে যায়- দেশের মূর্খরা আজ শহীদদের নাম বিকিয়ে দেশ বেঁচে চলেছে। যাদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা। আজ তাদের শুধু স্বাধীনতা আর বিজয় দিবসের “জয় বাংলা স্লোগান আর রক্তলাল” গানের মাধ্যমেই মূল্যায়ন করা হয়। নগেন তাই ধীরগতিতে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে তার একসময়ের নেতা, একনিষ্ঠ বিপ্লবী জলদি কমরেডের রাতের শেষ আলোয় প্রস্থান পথের দিকে । জয় বাংলা, বাংলার জয় গানটি যেন কানের কাছে এখনও আন্দোলিত হয় শুধু আগের মত গাঁয়ের লোম দাঁড়ায় না……..
(সমাপ্ত)