বাসা থেকে নাস্তা সেরেই দৌড় দিল নিলয়, স্কুলে আজ দেরী হয়ে গেল নতুন ক্লাস, নতুন স্কুল। প্রথম ক্লাসেই দেরী, ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে আরো ১৫মিনিট আগে, ক্লাশ রুমে প্রবশ করতেই ম্যাডামের কড়া ঝাড়ি খেতে হল ওর, মনে মনে মাকে আচ্ছা মত বকল ও, মা যদি নাস্তা তৈরী করতে দেরী না করত তাহলে আজ ক্লাশ ভর্তি ছেলেদের সামনে এত লজ্জা পেতে হত না, এসব ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পরে নীলয় ম্যাডামের ডাক শুনতে পায়না তাই ম্যাডাম বেত দিয়ে একটা বাড়ি দিলেন নীলয়কে আর ওমনি ক্লাশ জুড়ে হারি রোল পড়ে গেল, নীলয় মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইল।
নীলয়ের বাবা বাজারে তরকারী বিক্রী করেন, মা গৃহিনী, ওরা দুই ভাই এক বোন, বোনের বিয়ে হয়ে গেছে এখন দুই ভাই মিলে পড়াশুনা করে। একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেনী পাশ করে বর্তমানে এই স্কুলে ভর্তি হয়েছে কিন্তু প্রথম দিনেই যা ঘটল তাতে ও বেশ লজ্জিত বোধ করছে। স্কুলে নীলয় করো সাথে কথা বলে না, কারো সাথে মিশে না। কিছুদিন পর আরো একটা ছেলে স্কুলে নতুন ভর্তি হল নাম নীরব, নীলয়ের নামের সাথে মিল থাকার কারনে নীরবের সাথে
নীলয়ের বেশ ভাব হয়। তাছাড়াও নীরবও নীলয়ের মত শান্ত স্বভাবের ছেলে সব সময় চুপচাপ থাকে এই কারনেও নীলয়-নীরবের ভাব জমে ওঠে।
নীরবের বাবা ব্যবসায়ী মতিঝিলে অফিস আছে ওরা দুই ভাই নীরব বড়, স্কুলের পাশে পাচঁ তলা বাড়িটা ওদের এবং এর পরেরটা এই স্কুলের সহকারী প্রধান শিকের। নীলয়, নীরবের ব›ধুত্ব বেশ ভালই হয়েছে ওরা একসাথে স্কুলে আসে, একসাথে যায়, সবকিছুই একসাথে, সবাই ওদের মানিক জোর বলে। দুজনই বেশ ভাল ছাত্র তবে নীলয় পড়াশোনায় একটু খারাপ তবে কখোনো ফেল করেনা এই নিয়ে নিয়ে ওর বেশ গর্ব। সেই কাশ ওয়ান থেকে আজ পর্যন্ত কোন কোচিং কিংবা প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়তে হয়নি নীলয়কে কিন্তু নীরব তিনজন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে। এত কিছুর পরেও ওদেও বন্ধুত্ব অনেক গভীর। প্রতিদিন বিকেলে ওরা একসাথে হাটতে বেরহয় এবং স্কুলের সামনে আড্ডা দেয়।
দেখতে দেখতে দুই বছর পার হয়ে গেল,ওরা এখন ক্লাশ এইটে। ওরা এবার বৃত্তি পরীা দেবে, নীরব বেশ ভালই প্রস্তুতি নিচ্ছে কিন্তু নীলয়ের একটু সমস্যা হচ্ছে, ওর কোন গৃহ শিক্ষক নেই সংসারের অভাবের কারণে ওর বাবা কোনদিন ওকে প্রাইভেট পড়াতে পারেনি কিন্তু বৃত্তিপরীক্ষা দেবে সব কিছু ভালভাবে বুঝতে হলেতো প্রাইভেটের বিকল্প নেই। সব কিছু ওর বাবাকে খুলে বলার পরে ওর বাবা ওকে প্রাইভেট পড়াতে সম্মতি দিলেন, তাই এবিষয় নিয়ে নীরবে সাথে কথা বলে নীলয়, নীরব ওকে এসিসটেন্ট হেড স্যারের কাছে গ্রাইভেট পড়ার বুদ্ধি দিল। নীরবের কথা মতো নীলয় ও নীরব স্যারের বাসায় গেল। কলিং বেল টিপতেই ভিতর থেকে চিকন একটি মিষ্টি কন্ঠ বলে ওঠে কে………….
ওরা চমকিত হয়ে ওঠে এই রিনিঝিনি কন্ঠ শুনে, ততনে আবার সেই হাক কে, নীরব বলে আমি নীরব স্যারের কাছে এসেছি, ধরাম করে গেট খুলে দেয় মেয়েটি দ্বিতীয় বারের মত অবাক হয় ওরা অপূর্ব সুন্দর মেয়েটি, ভেতরে এসো, মেয়েটির আহবানে সাড়াদিয়ে ওরা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে।
বসার ঘরে বসে আছেন শফিক সাহেব মেয়েটির বাবা আর নীরব, নীলয়ের স্কুলের সহকারী প্রধার শিক্ষক। নীলয় বলল স্যার আমি আপনার কাছে প্রাইভেট পড়তে চাই। শফিক সাহেব বললেন ঠিক আছে প্রতি সাবজেক্টে পাচঁশত টাকা করে দিতে হবে। নীলয় একটু চুপ হয়ে রইল ওর বাবা ওকে প্রাইভেট পড়ার জন্য পাচঁশ টাকাই দেবে কিন্তু ও দুই সাবজেক্ট পড়তে চেয়েছিল। অনেকক্ষন পরে নীলয় বলল ঠিক আছে স্যার আমি এক সাবজেক্ট পড়ব, আচ্ছা আগামী মাস থেকে এসো জ্বি স্যার আসি, স্লামুলেকুম। স্যারের বাসা থেকে ওরা বের হয়ে স্কুলের সামনে বসল, দুজনই চুপ নীলয় ভাবছে যেভাবেই হোক ভালভাবে পড়াশুনা করতে হবে প্রয়োজনে আগরে চেয়ে বেশী সময় ধরে পড়বে আর নীরব ভাবছে সেই মেয়েটির কথা স্যারের বাসায় যাকে দেখেছে ওরা। পরের মাস থেকে নীলয় স্যারের বাসায় প্রাইভেট পড়া শুরু করল, প্রতিদিন বিকাল পাচঁটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত পড়ে স্কুলের সামনে নীরবের সাখে কিছু সময় কাটিয়ে বাসায় যায়।
কিছুদিন যেতেই নীলয়ের সাথে স্যারের মেয়েটির বেশ ভাব হয়, একদিন নীরব নীলয়কে মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করে অর্না, সংক্ষেপে বলে নীলয়, অর্না? নীরব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানতে চায়, নীলয় বলে হ্যা। বেশ কিছুদিন পর বিকেল বেলা ছুটির দিন তাই স্কুলের সামনে বসে আছে নীলয় ও নীরব, নীরব নতুন গিটার কিনেছে সেটা নিয়ে টুংটাং করছে নীলয় বলল গীটার বাজাতে পারিস না? নীরব বলে না, নীলয় বলল দে আমার কাছে দে আমি বাজাই তুই গান গাইতে থাক, নীরব দেখল অর্না ওদের দিকে আসছে তাই নীরব গাইতে শুরু করে …
একটা গোপন কথা ছিল বলবার
বন্ধু সময় হবে কি তোমার
একবার শুনে ভুলে যেয়ো বার বার
ভুল কাউকে বলোনা আবার
গানটি শেষ করার আগেই অর্না ওদের কাছে চলে আসে, এসেই বলে কিরে তুই এত সুন্দর গীটার বাজাতে পারিস আমাকে বলিসনি কেন? অনেকদিন ধরে বাজাই না তাই হয়ত ভুলে গিয়েছি, স্যরি দোস্ত নীলয়ের উত্তর শেষ করার আগেই নীরব বলেওঠে আমি কিন্তু ভাল গাইতে পারি তাই না? অর্না নীলয়কে বলে তুই বিকেলে আমাদের বাসায় আসিস কথা আছে, আসি। এই বলে অর্না চলে গেল নীরব চুপ করে রইল, নীলয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল আসলেকি জানি? অর্না একটা গাধা কোন কান্ড জ্ঞান নাই, ওর ব্যবহারে মাইন্ড করিস না দোস্ত। না মাইন্ড করার কি আছে, আমি ভাবছি অন্য কথা, কি? নঅলয় জিজ্ঞেস করে। আব্বু বলেছেন পরীক্ষার আগে আর আড্ডা দেয়া চলবে না, বাসায় সারা দিন পড়তে হবে, আচ্ছা নীলয় এটা কি সম্ভব বল ? সারাদিন পড়তে কার ভাল লাগে বাবা কি ওবোঝে না? নীলয় কোন বাব দেয় না চুপকরে মাথা নিচু করে বসে আছে। কিছুক্ষন পর নীলয় বলে নীরব তুই বাসায় যা আমি স্যারের বাসা হয়ে যাচ্ছি। নীলয় ও নীরব নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে হাটছে।
নীলয় হাটছে আর ভাবছে- নীরবের বাবা ওর পড়াশুনার প্রতি কত যত্নশীল কিন্তু আমার বাবা আমার পড়াশুনার কোন খবরই রাখে না, হাইস্কুলে ভর্তি হলাম একা একা বাবা-মা কেউ সাথে আসেনি কিন্ত ক্লাশের সাবাই তার বাবা-মাকে সাথে এনেছিল, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিন নীবরে মা স্কুলে এসেছিলেন কিন্তু আমার বাবা-মা এমন কেন? কেন তারা আমাকে পড়াশুনা করতে দিতে চায়না? নাকি আমি তাদের আপন সন্তান নই?
এসব কথা ভাবতে নীলয় অর্নাদের বাসার সামনে চলে আসে সিড়িবেয়ে উপরে আসতেই দেখে অর্না বাসার গেটে দাড়িয়ে আছে নীলয়কে দেখেই অর্না বলে ওই ছেলেটা কেরে? গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে কেন মানা করবি ওকে, দেখতে একেবারে মিস্টার বিনের মত, গরুর মত বড় বড় চোখ, দেখলেই হাসি পায়। নীলয়কে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই একনাগারে কথাগুলো বলে অর্না।
আগে আমাকে একটু জিরিয়ে নিতে দিবি? পাচঁ তলা বেয়ে উঠতে উঠতে হাপিয়ে গেছি, অর্না বলে স্যরি ঘরে আয়। নে পনি খা, এই বলে এক গ্লাস পানি নীলয়ের দিকে এগিয়ে দেয় অর্না। এবার বল ছেলেটা কে? অর্না প্রশ্ন করে নীলয়কে, অর্না কিছুক্ষন পর আবার বলেঃ আচ্ছা ছেলেটা এত হ্যাংলা কেন? মেয়েদের দেখলেই গায়েপরে ভাব জমাতে আসে, আমার সাথে যেন ভাব জমাবার চেষ্টা না করে, সাবধান করে দিবি ওকে, ঠিক আছে? নীলয় চুপ। নীলয়, কিরে তোর কি হয়েছেরে? চুপ করে বসে আছিস কেন? মন খারাপ? বাসায় বাবা-মা’র সাথে ঝগড়া হয়েছে? নাকি মা বকেছে? কিরে কথা বলছিস না কেন? বল কথা বল, কিরে কথা বলবি না? হ্যা? ওই শালা কথা বল না হলে কানের নীচে থাপ্পর দিয়ে তোর দাতের মাড়ি খুলে ফেলব। নীলয় চুপ শুধু ওর চোখ বেয়ে পানি ঝরছে, আর অর্না যেন পৃথীবির শ্রেষ্ঠ বিষ্ময় দেখছে…………..
: নীলয় কি হয়েছে তোর (শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করে অর্না)
: কিছু হয়নি
: তাহলে কাদঁছিস কেন?
: ভাল নেই
: মন খারাপ কেন?
: জানিনা
: শালা তুই আসলেই একটা গাধা, তারছিড়া, মন খারাপ কেন তাও জানেনা, তাহলে জানিস কি?
: জানি শুধু আমি আর লেখা পড়া করতে পারবনা।
: কেন পারবি না?
: বাবা অসুস্থ সংসারে রোজগার বন্ধ, পড়া লেখা করার খরচ কোথায় পাব?
অর্না চুপ করে রইল কি বলে ওকে সান্তনা দেবে বুঝতে পারছে না, শুধু মাথা নিচু করে নীলয়ের পাশে বসে রইল………
পরদিন নীলয় স্কুলে আসেনি তার পরদিনও আসেনি তাই অর্না আর ওর বান্ধবি সুমি নীলয়দের বাসায় গেল, বাসা বলতে ছোট্র একটা টিনসেড ঘর, একটি খাট আর একটি শোকেস। নীলয়ের মা দুপুরের রান্নার আয়োজনে ব্যাস্ত, নীলয়ের ছোট ভাই ঘরে বসে আছে তাকে অর্না জিজ্ঞেস করল নীলয়ের কথা, উত্তরে নীলয়ে ভাই বলল
: ভাইয়া কাজে গেছে………..
: কখন আসবে?
: সন্ধ্যার সময়
: ঠিক আছে ও আসলে বলবে যে, অর্না আপু এসেছিল, ঠিক আছে?
: আচ্ছা
অর্না ফিরে আসে নীলয়ের বাসা থেকে সারা দিন মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকে, বিকেল বেলায় ছাদেও ওঠেনি, ব্যাপারটা ওর বাবা লক্ষ করলেন, তাই অর্নাকে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন
: অর্না তোমার মন খারপ কেন?
অর্না কিছুক্ষন কি যেন ভাবল তার পর বলল
: আচ্ছা বাবা মানুষের জীবন এমন কেন?
: কেমন?
: এই যে, যাদের আছে তাদের কোন অভাব নেই, বরং তারা বিলাসিতায় জীবন কাটায় আর যাদের নেই তারা অনেক কষ্ট করে দু’বেলা খেয়ে পড়ে বেচেঁ আছে কেউ কেউ সেটাও পায় না, কেন এমন হয় বাবা?
: হঠাৎ এই কথা কেন? কোন সমস্যা?
: বাবা তুমিতো আমাদের স্কুলের সহকারী প্রধানন শিক্ষক তুমি কি পারবে নীলয়কে স্কুলে ফিরিয়ে আনতে?
: কি বলছ তুমি? কি হয়েছে নীলয়ের?
: ওর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে, এখন ও কিসের যেন কাজ করে।
: তুমি ওকে ওর বাবাকে নিয়ে আমার সাথে স্কুলে দেখা করতে বলবে, দেখি কিছু করতে পারি কিনা।
: ওকে বাবা, থ্যাংকস।
ওদিকে নীরব এসবের কিছুই জানেনা, নীলয়কে স্কুলে না দেখে ও ভেবেছে নীলয় হয়ত কোথাও বেড়াতে গেছে। তাই নীরব নীলয়ের কোন খোজ খরব রাখে না। একা স্কুলে আসে আর যায় আর বিকেল বেলায় স্কুলের সামনে একা বসে গীটার বজায়, অগোছালো সুরে গীটারের তার গুলোকে নাড়াচাড়া করে শুধু অর্নাকে দখোর জন্যই ও এভাবে একা একা বসে থাকে রাস্তার মোড়ে। কিন্তু অর্না কখোনই নীরবের সাথে কোন কথা বলেনি।
প্রতিদিনের মত আজও নীরব বসে আছে গীটার হাতে নিয়ে স্কুলের সামনের দোকানটির সিড়িঁতে, অর্না কোচিং শেষ করে বাসায় ফিরছে, দুরথেকে তা নীরব খেয়াল করে আর গেয়ে ওঠে
একটা গোপন কথা ছিল বলবার
বন্ধু সময় হবে কি তোমার?
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।