তিনটি কবরগৃহের কথা
বিখ্যাত একজন বুজুর্গ বর্ণনা করেন- একবার এক গ্রামে আমি তিনটি কবর দেখতে পেলাম। কবর তিনটি একটি উঁচু যমীনে অবস্থিত ছিল। প্রতিটি কবরে দু’টি করে আরবী কবিতা লিখা ছিল-
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি জানে যে, তাকে অবশ্যই একদিন আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে এবং তাকে ভালো-মন্দ সকল কাজের প্রতিদান দেয়া হবে, সে কেমন করে দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে লিপ্ত থাকতে পারে।
দ্বিতীয় কবরে লিখা ছিল-
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি এটা বিশ্বাস করে যে, মৃত্যু একদিন তার সকল পার্থিব অধিকার ও প্রভাব ছিনিয়ে নিয়ে তাকে কবরবাসী করে দেবে, সে কেমন করে দুনিয়ার স্বাদ উপভোগে লিপ্ত থাকতে পারে?
তৃতীয় কবরে লেখা ছিল-
অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি এ কথা জানে যে, একদিন তাকে এমন কবরে গমন করতে হবে, যেখানে তার রূপ, যৌবন ও হাড় মাংস নিঃশেষ হয়ে যাবে। সে কোন ভরসায় দুনিয়ার ভোগ বিলাসে মশগুল থাকতে পারে? বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর এক শায়েখের নিকট ঐ কবর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ঐ তিন কবরের অধিবাসীরা ছিল পরস্পর আপন ভাই। একজন সেনাপতি একজন ব্যবসায়ী এবং আরেকজন ছিলেন আল্লাহ ওয়ালা বুজুর্গ।
বুজুর্গের মৃত্যু নিকটবর্তী হলে তাঁর অপর দু’ ভাই তাঁর নিকট বহু অর্থ-সম্পদ হাজির করে বলল, আপনি এগুলো সদকা করে যান। কিন্তু বুজুর্গ তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন, তোমাদের সম্পদে আমার প্রয়োজন নেই। তবে আমি তোমাদের নিকট হতে একটি প্রতিশ্রুতি নিতে চাই। আশা করি তোমরা তা রক্ষা করবে। অতঃপর তিনি বললেন, আমার মৃত্যুর পর আমাকে কোন উঁচু জায়গায় দাফন করে আমার কবরে এবং এ কবিতা গুলো লিখে দেবে। অতঃপর বুজুর্গ বললেন, তোমরা নিয়মিত অন্ততঃ একবার আমার কবর জেয়ারত করবে এতে তোমাদের ফায়দা হবে।
শায়েখ বললেন, তুমি প্রথম কবরে যে কবিতাগুলো দেখেছিলে বুজুর্গ তাই লিখেছেন।
সেনাপতি তার সহচরদেরসহ প্রতিদিন ভাইয়ের কবর জেয়ারত করত এবং কবরের উপর লেখা কবিতার চরণগুলো পড়তে পড়তে ক্রন্দন করত। এভাবে তৃতীয় দিন জেয়ারত শেষে হঠাৎ কবরের অভ্যন্তরে কিছু পতনের শব্দ পেয়ে সে ভীষণ ভয় পেল। রাতে সে ভাইকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করল, ভাই! আপনার কবরে আমি কিসের শব্দ শুনেছিলাম? বুজুর্গ বললেন, ওটা ছিল লৌহ কোড়া পতনের শব্দ। তখন আমাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল যে, তুমি অমুক অত্যাচারিত ব্যক্তিকে দেখে কেন সহযোগীতার হাত বাড়ালে না?
স্বপ্ন দেখে সেনাপতি বড় প্রেশান হলেন। সকালে তিনি অপর ভাইদেরকে ডেকে বলল, আমার বুজুর্গ ভাই তাঁর কবরে কবিতা লেখার জন্য যে অসিয়ত করেছিলেন তা সম্ভবত আমার শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যেই করেছিলেন। এখন থেকে আমি আর তোমাদের সমাজে থাকব না।
এই বলে তিনি সেনাপতি পদ ত্যাগ করে লোকালয় ছেড়ে জঙ্গলে চলে গেলেন। অতঃপর সেখানেই তিনি আল্লাহ পাকের ইবাদতে মশগুল হলেন।
উল্লেখিত ঘটনার কিছুদিন পর তারও মৃত্যু নিকটবর্তীর সংবাদ আসল। খবর পেয়ে তার ব্যবসায়ী ভাই এসে বলল, ভাই! আপনি আমাকে কিছু অসীয়ত করুন।
জবাবে সে বলল, আমার নিকট অসীয়ত করার মত কোন সম্পদ নেই। তবে তোমাকে একটি অনুরোধ করে যাচ্ছি। মৃত্যুর পর আমাকে সে বুজুর্গের পাশে দাফন করে আমার কবরের উপর এ কবিতার চরণগুলো লিখে দিও।
শায়েখ বললেন- দ্বিতীয় কবরে লিখা চরণগুলোই এ কবিতার অংশ, যা তুমি দেখেছিলে। যাই হোক অতঃপর সে ব্যবসায়ীকে বলল তিন দিন পর্যন্ত নিয়মিত আমার কবর জেয়ারত করবে এবং আল্লাহ তা’য়ালার নিকট আমার জন্য দোয়া করবে। এ কথা বলার কিছুক্ষণ পরই তাঁর প্রাণ বের হয়ে গেল। মৃত্যুর পর তার ব্যবসায়ী ভাই যথাযথভাবে সে অসীয়ত পালন করল।তৃতীয় দিন সে কবরের নিকট এসে জোরে জোরে কান্নাকাটি করে দোয়া করতে লাগল। কিন্তু জেয়ারত শেষে সে কবরের ভেতর হতে এক বিকট শব্দ শুনে ভয় লেয়ে বাড়িতে ফিরে এল। রাতে সে স্বপ্নে দেখল, তার সে মৃত ভাই এসেছে।
তিনি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ভাই! আপনি কি আমাদের সাথে সাক্ষাত করতে এসেছেন? সে জবাব দিল, না ভাই! এখন কি আর সাক্ষাত করা সম্ভব? আমি তো স্থায়ী ঘরে বসবাস করছি। জীবিত ভাই জিজ্ঞেস করল, আপনি এখন কেমন আছেন? সে জবাব দিল- আল্লাহ তায়ালা আমাকে সুখেই রেখেছেন। তওবা দ্বারা মানুষ অপরিসীম কল্যাণ লাভ করতে পারে। সে এবার জিজ্ঞেস করল, আমাদের সেই বুজুর্গ ভাই কোথায়? সে বলল, তিনি নেক্কার ইমামদের মজলিসে আছেন। শেষ বারের মত সে বলল, এখন আপনি আমাকে কি করতে নির্দেশ দিচ্ছেন? সে বলল, দুনিয়াতে থেকে মানুষ আখেরাতের জন্য যা কিছু প্রেরণ করে মৃত্যুর পর আখেরাতে তারা তা প্রাপ্ত হয়। সুতরাং দুনিয়ার জীবনকে গণীমত মনে কর।
সকালে ঘুম থেকে উঠে সে অতীত জীবনের পাপ, পস্কিলতা হতে মুক্ত হওয়ার জন্য তওবাতুন নাছুহ- করে সমস্ত সম্পদ দান করে আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদতে মশগুল হয়ে গেল।
তারপর তাঁর ছেলে পিতার ব্যবসা-বাণিজ্যের হাল ধরল। কিছুদিন পর তাঁর মৃত্যু ঘনিয়ে এলে সে পিতার নিকট কিছু অসীয়ত প্রার্থনা করল। পিতা বলল – বেটা! অসীয়ত করার মত আমার নিকট কোন সম্পদ নেই। আমার মৃত্যুর পর তুমি আমাকে তোমার দুই চাচার কবরের পাশে দাফন কর এবং আমার কবরের উপর এ কবিতাগুলো লিখে দিও। হযরত শায়েখ বলেন তুমি তৃতীয় কবরে যে কবিতাগুলো দেখেছিলে ঐ সময় সে তাই বলেছিল। সে আরো বলেছিল, তুমি নিয়মিত তিনদিন আমার কবরে আশা-যাওয়া কর এবং আমার মাগফেরাতের জন্য দোয়া কর। পিতার উপদেশ যে যথাযথভাবে পালন করেছেন। কিন্তু তৃতীয় দিবসে জেয়ারতের সময় কবরের ভেতর হতে এক ভয়ানক শব্দ শুনতে পেয়ে তার অন্তরাত্মা কেপে উঠল। সে রাতে সে পিতাকে স্বপ্নে দেখল। পিতা তাকে বলছিলেন, বৎস! অচীরেই তুমি আমাদের সঙ্গে মিলিত হবে। দুনিয়ার ধোকায় সময় নষ্ট করো না। আখেরাতের সামান সংগ্রহ কর। এখানেও সামানের প্রয়োজন হবে। কিন্তু মৃত্যুর পর আর সেই সামান সংগ্রহ করার সুযোগ থাকবে না। তোমার পূর্বে অনেকেই দুনিয়ার ধোকায় বিভ্রান্ত হয়ে কবরে আসেছে দুনিয়াতে তারা আখেরাতের কথা ভুলে বড় বড় পরিকল্পনা করছিল। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনা পূরণ হবার পূর্বেই মৃত্যমুখে পতিত হয়েছে। ঐ সময় তাদের অনুশচনা ও আক্ষেপ কোন কাজে আসেনি। তোমারও যেন এরূপ পরিণতি না হয়। সুতরাং হে বৎস! আর অবহেলা কর না।
সকালে ঘুম থেকে জেগে সে পরিবার-পরিজনে ডেকে বলল, আমার মনে হচ্ছে, আমার সময় শেষ হয়ে আসেছে। পড়ে সে যাবতীয় ঋণ পরিশোধ করে অবশিষ্ট্য সম্পদ আল্লাহর পথে দান করে দিল। ঘটনার তৃতীয় দিনে পরিবারের সকলকে ডেকে তাদের নিকট আখেরী সালাম আরজ করে কেবলামুখী হয়ে কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করতে করতে চিরবিদায় গ্রহণ করল।