গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
বীপের শরীরের কোনো এক কোণে হঠাৎ একদল হাসিখুশি বদ্রীপাখি ডেকে উঠল। হুমদো জ্যাকেট, টুপি আর দস্তানায় আপাদমস্তক ঢেকে সবে ডিপার্টমেন্টের কাচের সদর দরজা ঠেলে বাইরের উৎপটাং ঠাণ্ডায় পা রেখেছে দ্বীপ। বিন্দুমাত্র ধারণা নেই সেল ফোনটা তার অজস্র পকেটের ঠিক কোনটায় বাজছে, তাই সেটা খোঁজার কোনো চেষ্টাই করল না সে। যখন পার্কিং লটে রাখা গাড়ির কাছে পৌঁছল, পাখিরা ততক্ষণে ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে চুপ করে গেছে। ডানহাতের দস্তানা খুলে এ পকেট সে পকেট হাতড়ে, জিনসের বাঁ পকেটে সিগারেটের প্যাকেটের তলায় চাপা পড়া ফোনটাকে দু আঙুলে টেনে বের করে দেখল মিস্ড কলে বৈশাখী বৌদির নাম। ততক্ষণে ভয়েস মেলের চিহ্নটা ফুটে উঠেছে।
গাড়ির ভিতরটা বাইরের চেয়ে কিছু কম ঠাণ্ডা নয়, তাই দ্বীপের ইচ্ছে ছিল গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে হিটার চালিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট খাবে। কিন্তু শিকাগোর কুখ্যাত হিমেল হাওয়ার দাপটে সে সাহস হল না। তাড়াতাড়ি গাড়িতে ঢুকে স্টার্ট দিয়ে টুপি দস্তানা পরেই বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ফোন করল বৈশাখী বৌদিকে। বৌদি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ধরেই বললেন :
— এক্ষুনি তোমায় মেসেজ রাখলাম। আসছ তো আজ সন্ধেয় এখানে?
— আজ আমায় বাদ দিন বৌদি। প্রচুর কাজ পড়ে আছে। দ্বীপের গলায় ক্লান্তি।
— আরে দূর! শুক্রবার সন্ধেয় আবার কাজ কী? চলে এসো তো! আরো অনেকে আসছে। সপ্তাহে একটা দিন একটু আড্ডা দেবে, তা না কাজ দেখাচ্ছে! সাতটার মধ্যে পৌঁছে যেও কিন্তু।
দ্বীপ জানে বৌদির সাথে তর্ক করে লাভ নেই। যেতে তাকে হবেই। তাই সম্মতি দিয়ে ফোন ছেড়ে দিল। তারপর বিকেলের বিরক্তিকর শ্লথ ট্রাফিকের মধ্যে ঢুকে বাড়ির পথে রওনা দিল। একঘেয়েমি কাটাতে চন্দ্রবিন্দুর ‘ডাকনাম’ সিডিটা পুরে দিল স্টিরিওতে।
দ্বীপের পুরো নাম স্বপ্নদ্বীপ। স্বপ্নদ্বীপ লাহিড়ি। কলকাতায় ইতিহাসে এম এ করার পর দুটো মার্কিন ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাচীন ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বে এম এ আর পিএইচডি করে সে এখন শিকাগোর এক নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ায়। এম এ পাশ করার পর বছর কয়েক দক্ষিণ কলকাতার একটা ট্যাঁশ স্কুলে পড়িয়েছিল। লিটল ম্যাগাজিনে নানা বিষয়ে দুচারটে প্রবন্ধও লিখেছিল। সত্যি বলতে কি, সে এতে একরকম খুশিই ছিল। তারপর একদিন কলকাতার মিউজিয়ামে খ্যাতিমান মার্কিন প্রত্নতাত্ত্বিক মাইকেল কো-এর লেকচার শুনতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ জমে যায়। কো-ই তাকে প্রস্তাব দেন আমেরিকায় তাঁর কাছে পড়াশুনা করার। গররাজি থেকে নিমরাজি হয়ে, অবশেষে এক সময় সে পাড়ি দেয় বিদেশে। দ্বীপের গবেষণা মধ্য আমেরিকার প্রাচীন সমস্ত সংস্কৃতি নিয়ে, বিশেষত ঐ অঞ্চলের মায়া সভ্যতা। সেই সুবাদে সে মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, হন্দুরাস প্রভৃতি দেশে ঘুরেছে আখছার। প্রখ্যাত মেক্সিকান ও মার্কিন প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে শিক্ষানবীশি করেছে প্রাচীন ভগ্নস্তূপ খোঁড়ার কাজে। স্প্যানিশ আর মায়া ভাষার কয়েকটা শাখায় তার দখল যথেষ্ট। ইদানিং সে মায়া জীবনদর্শন ও রণনীতির সম্পর্ক নিয়ে একটা বই লিখছে।
কলকাতায় সুকিয়া স্ট্রিটে দ্বীপদের পৈতৃক বাড়ি। দ্বীপের বাবা অরণি লাহিড়ি উত্তর কলকাতার নামজাদা ডাক্তার। মা তনুশ্রী স্কুল শিক্ষিকা, সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। সাত বছরের ছোট বোন রিনি বাবার পেশা নিয়েছে, হাজরায় তার শ্বশুরবাড়িতেই তার চেম্বার। রিনিই ওর ভালোনাম, যে কারণে দ্বীপ বরাবরই ওকে হিংসে করে এসেছে, কেন না নিজের নাম নিয়ে দ্বীপের হেনস্থার শুরু সেই ছেলেবেলায়। আর কোনো বাঙালি নামে তিন-তিনটে যুক্তাক্ষর আছে বলে তার জানা নেই। ইংরাজিতে লিখলে দুটো ডবল-ইউ। মার্কিন সহকর্মীদের কাছে প্রথম থেকেই এখানে তার ডাকনাম হয়ে গেছে ‘ড্যুইপ’। দ্বীপ বেশ কয়েকবার সিরিয়াসলি ভেবেছে এফিডেভিট করে নামটা বদলে ফেলবে, নিদেন ‘স্বপ্নদীপ’ করে ফেলবে। একাধিকবার ভেবেছে, কিন্তু পারেনি, কারণ নামটা কাকাই, মানে দ্বীপের একমাত্র কাকা অশনির দেওয়া।
অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দরজার পাশের ছোট টেবিলটায় চিঠিপত্র আর চাবির গোছা নামিয়ে একে একে জ্যাকেট, টুপি, দস্তানা মাফলার, ভারি জুতো খুলে ক্লোসেটে রেখে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের জল চাপাল দ্বীপ। তারপর জুতো জামা খুলে বসার ঘরের সোফায় পা তুলে বসল। বুকসেফের ওপর কিছু পাথরের ছোট মূর্তি ও অন্যান্য প্রাচীন সামগ্রীর আশেপাশে স্ট্যাণ্ডে রাখা কয়েকটা পারিবারিক ফটো। মা, বাবা, রিনারা। তারই মাঝে মলিন হয়ে আসা একটা বড় সাদাকালো ছবি, যা অন্যগুলোর পাশে বেশ বেমানান। পুরীতে সদ্যভাঙা ঢেউয়ে কোমরজলে দাঁড়িয়ে এক হাসিমুখ ঝকঝকে যুবক। পরনে কেবল শর্টস। ছিপছিপে শরীর, একমাথা ভিজে কোঁকড়া চুল, চাপ দাড়ি, দীঘল চোখ। অবিকল দ্বীপ। তার কাঁধে তারস্বরে চিৎকাররত, আতঙ্কিত এক শিশু। দ্বীপ বরাবরই শুনে এসেছে কাকাইয়ের সঙ্গে তার চেহারার মিলের কথা। আর বছর-দুয়েক বয়েসে পুরী গিয়ে কাকাইয়ের কাঁধে চড়ে তোলা এই ছবির গল্পও বহুবার শুনেছে মায়ের কাছে। ঢেউয়ের গর্জনে সে ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করলে অশনি তার ভয় ভাঙানোর জন্য তাকে কাঁধে তুলে জলে নেমে গিয়েছিল। তবে তাতেও যে আদৌ তার আতঙ্ক কাটেনি তা ছবিটা দেখলেই মালুম হয়।