উচ্চ মর্যাদার নবী ইদ্রীস(আঃ)

 

আল কুরআনে যে পঁচিশ জন নবীর নাম উল্লেখ আছে, তাঁদেরই একজন ইদ্রিস (আঃ)। মহান আল্লাহ্‌ তাঁকে অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আল কুরআনে তিনি ইদ্রিস (আঃ) সম্পর্কে বলেনঃ

‘‘এই মহাগ্রন্থে ইদ্রিসের কথা স্মরণ করো। সে ছিল একজন বড় সত্যপন্থী মানুষ ও নবী। আমি তাঁকে অনেক বড় উচ্চস্থানে উঠিয়েছি।’’ (সুরা মরিয়মঃ আয়াত ৫৬-৫৭)

দেখলেন তো, স্বয়ং আল্লাহ্‌ পাকই তাঁকে অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আর মহান আল্লাহ্‌ যাকে উচ্চ মর্যাদা দান করেন, তাঁর চেয়ে বড় ভাগ্যবান ব্যাক্তি আর কে?

তিনি কোন সময়কার নবী?

ইদ্রিস (আঃ) প্রাগৈতিহাসিক যুগের নবী। তাই তিনি কোন সময়কার নবী, সে বিষয়ে মতভেদ আছে। তবে অনেক মুফাসসির বলেছেন, কুরআনের বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, তিনি নূহ (আঃ) এর পূর্বেকার নবী ছিলেন এবং আদম (আঃ) এর সন্তান বা নিকট বংশধরদের একজন ছিলেন। ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক লিখেছেন, আদম (আঃ) এক হাজার বছর বেঁচে ছিলেন। ইদ্রিস (আঃ) তাঁর জীবনের তিন শত আট বছর পেয়েছিলেন।

 

তিনি কোন দেশের নবী ছিলেন?

তিনি কোন সময়কার নবী ছিলেন, কুরআনে যেমন সে কথা বলা হয় নি, ঠিক তেমনি তিনি কোন দেশের নবী ছিলেন সে কথাও কুরআনে বলা হয় নি। তবে কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, তিনি বেবিলনের লোক। আবার কেউ কেউ বলেছেন- তিনি মিশরের লোক। আসলে দুটি কথাই ঠিক। তিনি বেবিলনে জন্ম গ্রহন করেন। এখানে নবুয়ত লাভ করেন, মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকেন। এখানে কিছু লোক ঈমান আনে, আর বাকী লোকেরা ঈমান আনতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, বরং তাঁরা হজরত ইদ্রিস ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা আরম্ভ করে। ফলে ইদ্রিস (আঃ) তাঁর সংগী সাথীদেরকে নিয়ে মিশরের দিকে হিজরত করেন। এখানে এসে তিনি নীল নদের তীরে বসতি স্থাপন করেন এবং এখানকার মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে থাকেন।

 

ইদ্রিস (আঃ) এর নবুয়ত

হজরত আদম ও হজরত শীষ (আঃ) এর পরে আল্লাহ্‌ তায়ালা হজরত ইদ্রিসকে নবুয়ত প্রদান করেন। তিনি বড় জ্ঞানী লোক ছিলেন। তাঁকে প্রাচীনতম বিজ্ঞানী বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় তিনিই সর্বপ্রথম কলম ব্যবহার করেন।

ইসরাইলী বর্ণনায় ইদ্রিস (আঃ) কে ‘হনোক’ বলা হয়েছে। তালমূদে বলা হয়েছে- ‘হনোক’ তিন শত তিপ্পান্ন বছর পর্যন্ত মানব সন্তানদের উপর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাঁর শাসন ছিল ন্যায় ও সুবিচারপূর্ণ শাসন। তাঁর শাশনামলে পৃথিবীতে মহান আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বর্ষিত হতে থাকে। (The Talmud Selections, pp. 18-21)

হজরত ইদ্রিস (আঃ) একসময় খারাপ লোকদের থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগী করছিলেন। এরি মধ্যে তাঁর কাছে আল্লাহর ফেরেশতা এসে তাঁকে ডেকে বললেন, ‘হে ইদ্রিস, ওঠো একাকি থাকার জীবন ত্যাগ করো। মানুষের মাঝে চলা ফেরা করো এবং তাঁদের সঠিক পথ দেখাও।’ এ নির্দেশ পেয়ে হজরত ইদ্রীস বের হয়ে আসেন এবং মানুষকে ডেকে উপদেশ দিতে শুরু করেন।

বেবিলনের লোকেরা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য কিছু লোক হজরত ইদ্রিসের দাওয়াত কবুল করে আল্লাহর পথে চলতে আরম্ভ করেন। কিন্তু অধিকাংশ লোক আল্লাহর পথে আস্তে অস্বীকার করে। তাঁরা হজরত ইদ্রিস ও তাঁর সাথীদের সাথে খুবই খারাপ আচরন করে। তিনি যখন দেখলেন এদের আর সৎ পথে আসার আর কোন সম্ভাবনা নেই, তখন তিনি তাঁর সাথীদেরকে নিয়ে মিশরের দিকে হিজরত করেন এবং নীল নদের তীরে বসতি স্থাপন করেন। হজরত ইদ্রিস এখানকার লোকদেরকে সৎ পথে চলার উপদেশ দিতে আরম্ভ করেন। লোকেরা তাঁর প্রচেষ্টায় ব্যাপকভাবে আল্লাহর পথে আসতে থাকে। তিনি এসব লোকদের উপর আল্লাহর আইন অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ফলে পৃথিবীর বুকে নেমে আসে শান্তি আর সুখের ফোয়ারা। হজরত ইদ্রিস (আঃ) মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার কাজে এবং মানুষকে আল্লাহর আইন অনুযায়ী চালাবার কাজে যত বিরোধিতার এবং দুঃখ মুসিবতেরই সম্মুখীন হয়েছেন, তাতে তিনি চরম ধৈর্য ও সবর অবলম্বন করেন। তাইতো মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁর প্রশংসা

করে পবিত্র কুরআনে বলেনঃ

‘‘আর ইসমাঈল, ইদ্রিস, যুলকিফল এরা প্রত্যেকেই ছিল ধৈর্যশীল। আমি তাঁদের প্রবেশ করিয়েছি আমার রহমতের মাঝে। তাঁরা ছিল সৎ এবং সংশোধনকামী।’’ (সুরা ২১ আল আম্বিয়াঃ আয়াত ৮৫)

 

হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর উপদেশ

ইসরাইলী সূত্র এবং কিংবদন্তী আকারে হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর বেশ কিছু উপদেশ এবং জ্ঞানের কথা প্রচলিত আছে। এখানে বলে দিচ্ছি তাঁর কিছু উপদেশ ও জ্ঞানের কথা-

১। আল্লাহর প্রতি ঈমানের সাথে যদি সংযোগ থাকে ধৈর্য ও সবরের, তবে বিজয় তাঁর সুনিশ্চিত।

২। ভাগ্যবান সে, যে আত্মসমালোচনা করে। আল্লাহ্‌ প্রভূর দরবারে প্রত্যেক ব্যাক্তির সুপারিশ হল তাঁর নেক আমল।

৩। সঠিকভাবে কর্তব্য পালনের মধ্যেই আনন্দ। শরিয়া দ্বীনের পূর্ণতা দান করে। আর যে ব্যাক্তি দ্বীনের দিক থেকে পূর্ণ, সেই ব্যাক্তিত্তশালী।

হজরত ইদ্রিস (আঃ) মানুষকে আল্লাহর হুকুম পালন করতে বলতেন। তাঁরই ইবাদাত ও দাসত্ব করতে বলতেন। তিনি মানুষকে উপদেশ দিতেনঃ পরকালে নিজেকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে, দুনিয়াতে নেক আমল করতে এবং এই ক্ষনস্থায়ী দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে। তিনি নির্দেশ দিতেন সালাত কায়েম করতে, সিয়াম পালন করতে, যাকাত পরিশোধ করতে এবং পবিত্রতা অবলম্বন করতে।

কথিত আছে, হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর সময়কালে বিরাশিটি ভাষা চালু ছিল। তিনি সবগুলি ভাষা জানতেন এবং সবগুলি ভাষাতেই কথা বলতে পারতেন। তিনি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লোকদেরকে তাঁদের নিজেদের ভাষায় উপদেশ দিতেন। আল কুরআনে মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ

‘‘আমি যখনই কোন রাসুল পাঠিয়েছি, সে নিজ কওমের ভাষায় তাঁদের দাওয়াত দিয়েছে।’’ (সুরা ইব্রাহীমঃ আয়াত ৪)

জানা যায় হজরত ইদ্রিস (আঃ)- ই সর্বপ্রথম নগর রাজনীতির চালু করেন এবং নগর সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেন। তাঁর সময় ১৮৮ টি নগর গড়ে উঠেছিলো।

 

তাঁর মৃত্যু ও তাঁর মর্যাদা

আল কুরআনে আল্লাহ্‌ তায়ালা ইদ্রিস (আঃ) সম্পর্কে বলেছেনঃ

‘আমি তাঁকে অনেক উচ্চ স্থানে উঠিয়েছি।’ এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় অনেক তাফসীরকার বলেন- পৃথিবীতে হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর মৃত্যু হয়নি, বরং আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। হতে পারে মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁকে জীবন্ত উঠিয়ে নিয়ে গেছেন এবং অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। তবে আসল কথা আল্লাহই ভালো জানেন।

হ্যাঁ, এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলে দিচ্ছি। তাহলো আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সঃ) যখন মি’রাজে গিয়েছিলেন, তখন চতুর্থ আকাশে হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। হজরত ইদ্রিস তাঁকে দেখে বলে ওঠেনঃ ‘শুভেচ্ছা স্বাগতম, হে আমার মহান ভাই।’

কুরআন মাজীদে হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর নাম দুইবার উল্লেখ হয়েছে। একবার সুরা মরিয়মে আর একবার সুরা আম্বিয়াতে। উভয় স্থানেই আল্লাহ্‌ তায়ালা ইদ্রিস (আঃ) এর উচ্চ গুনাবলীর এবং বড় মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন। এই মহাপুরুষ ও মহান নবীর উপর বর্ষিত হোক চির শান্তি ও করুনাধারা।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!