অতিথি আপ্যায়নে ইলাহী মদদ

মেহমানের সম্মান করা ইসলামে অশেষ ছওয়াবের বিষয়। আর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মেহমানকে গ্রহণ করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে গায়েবী মদদ মেলে। এ সম্পর্কেই নিম্নোক্ত হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।

আবু মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর (রাঃ)-এর বর্ণনা অনুযায়ী, ‘আছহাবে ছুফফাহ’ (মসজিদে নববীর বারান্দায় বসবাসকারী ছাহাবীগণ) গরীব মানুষ ছিলেন। একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,
“যার কাছে দু’জনের আহার আছে, সে যেন (তাদের মধ্যে থেকে) তৃতীয় জনকে সাথে নিয়ে যায়। আর যার নিকট চারজনের আহারের ব্যবস্থা আছে, সে যেন পঞ্চম অথবা ষষ্ঠজনকে সাথে নিয়ে যায়।”

আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ঘরেই রাতের আহার গ্রহণ করেন এবং এশার ছালাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। এশার ছালাতের পর তিনি পুনরায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ঘরে ফিরে আসেন। অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছামত রাতের কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর বাড়ি ফেরেন। তখন তাঁর স্ত্রী তাঁকে প্রশ্ন করলেন, “বাইরে কি আপনাকে আটকে রেখেছিল?”

তিনি বললেন, “তুমি এখনো তাদেরকে খাবার দাওনি?”
স্ত্রী বললেন, “আপনি না আসা পর্যন্ত তারা খেতে রাযী হয়নি। তাদের সামনে খাবার রাখা হয়েছিল, তারা তা খাননি।”

আবদুর রহমান (রাঃ) বলেন, (পিতার তিরস্কারের ভয়ে) আমি লুকিয়ে গেলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাগান্বিত হয়ে বলে উঠলেন,
“ওরে মূর্খ!…”
এবং নাক কাটা ইত্যাদি গালাগালি করলেন এবং মেহমানদের উদ্দেশ্যে বললেন,
“আপনারা স্বাচ্ছন্দ্যে খান, আল্লাহর কসম! আমি মোটেই খাব না।”

আবদুর রহমান (রাঃ) বলেন, “আল্লাহর কসম! আমরা লুকমা (খাদ্যগ্রাস) উঠিয়ে নিতেই নীচ থেকে তা অধিক পরিমাণে বেড়ে যাচ্ছিল।” তিনি বলেন, সকলেই পেট ভরে খেলেন, অথচ পূর্বের চেয়ে আরও বেশি খাবার রয়ে গেল।

আবু বকর (রাঃ) খাবারের দিকে তাকিয়ে স্ত্রীকে বললেন, “হে বনু ফিরাসের বোন! এ কী?”
স্ত্রী বললেন, “আমার চোখের প্রশান্তির কসম! এটি পূর্বের চেয়ে তিনগুণ বেশি।”

সুতরাং আবু বকর (রাঃ)ও তা থেকে আহার করলেন এবং বললেন, “আমার ‘খাব না’ বলা কসম শয়তানের পক্ষ থেকেই ছিল।” এরপর তিনি আরও খেলেন এবং অতিরিক্ত খাবার নবী করীম (ছাঃ)-এর দরবারে নিয়ে গেলেন। ভোর পর্যন্ত সে খাবার তাঁর নিকটেই ছিল।

এদিকে আমাদের এবং অন্য একটি গোত্রের মধ্যে যে চুক্তি ছিল, তার সময়সীমা পূর্ণ হয়ে যায়। তারা মদিনায় আসে এবং আমরা তাদেরকে তাদের বারো জনের নেতৃত্বে ভাগ করে দিই। প্রত্যেকের সাথেই কিছু কিছু লোক ছিল, তবে ঠিক কতজন ছিল তা আল্লাহই ভালো জানেন। তারা সকলেই সেই খাবার আহার করেন।

অন্য বর্ণনায় আছে, আবু বকর (রাঃ) ‘খাবেন না’ বলে কসম করলেন। তা দেখে তাঁর স্ত্রীও ‘খাবেন না’ বলে কসম করলেন। এরপর মেহমানরাও, তাঁর সঙ্গে না খেয়ে, ‘খাবেন না’ বলে কসম করলেন। আবু বকর (রাঃ) বলেন, “এসব কসম শয়তানের পক্ষ থেকে ছিল। তাই আমি খাবার আনতে বললাম, নিজে খেলাম, আর মেহমানরাও খেল।”

তাদের যখনই লুকমা উঠিয়ে খাচ্ছিলেন, তখনই নীচ থেকে তা অধিক পরিমাণে বেড়ে যাচ্ছিল। আবু বকর (রাঃ) স্ত্রীকে বললেন, “হে বনু ফিরাসের বোন! এ কী?”
স্ত্রী বললেন, “আমার চোখের প্রশান্তির কসম! এখন এটি খেতে শুরু করার আগের চেয়ে আরও বেশি।”

সুতরাং সকলেই খেলেন এবং অতিরিক্ত খাবার নবী করীম (ছাঃ)-এর দরবারে পাঠানো হলো। আবদুর রহমান (রাঃ) বলেন, তিনি নিজেও তা থেকে খেলেন।

অন্য এক বর্ণনায় আছে, আবু বকর (রাঃ) আব্দুর রহমানকে বললেন,
“তোমার মেহমান নাও। তুমি তাদের খাতির কর। আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট যাচ্ছি। আমার ফিরে আসার আগে তুমি (খাইয়ে) তাদের আপ্যায়ন সম্পন্ন করো।”

সুতরাং আব্দুর রহমান তাঁর নিকট যে খাবার ছিল, তা নিয়ে মেহমানদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন,
“আপনারা খান।”

কিন্তু মেহমানরা বললেন,
“আমাদের বাড়িওয়ালা কোথায়?”
তিনি বললেন,
“আপনারা খান।”
তারা বললেন,
“আমাদের বাড়িওয়ালা না আসা পর্যন্ত আমরা খাব না।”

আবদুর রহমান বললেন,
“আপনারা আমাদের তরফ থেকে মেহমান নেওয়াযী গ্রহণ করুন। কারণ তিনি এসে যদি দেখেন যে আপনারা খাননি, তাহলে অবশ্যই আমরা তাঁর নিকট থেকে বড় ভর্ত্সনা পাব।”

কিন্তু তারা খেতে অস্বীকার করলেন। আব্দুর রহমান বলেন,
“তখন আমি বুঝে নিলাম যে তিনি আমার উপর রাগান্বিত হবেন। অতঃপর তিনি এলে আমি তাঁর নিকট থেকে সরে গেলাম।”

তিনি বললেন,
“কী করেছ তোমরা?”
তারা তাঁকে ব্যাপারটা খুলে বললেন। অতঃপর তিনি ডাক দিলেন,
“আব্দুর রহমান!”

আব্দুর রহমান নিরুত্তর থাকলেন। তিনি আবার ডাক দিলেন,
“আব্দুর রহমান?”
কিন্তু তখনও তিনি নীরব থাকলেন। তারপর আবার বললেন,
“হে বেওকুফ! আমি তোমাকে কসম দিচ্ছি, যদি তুমি আমার ডাক শুনতে পাও, তাহলে এসে যাও।”

আব্দুর রহমান বলেন, “তখন আমি বাধ্য হয়ে বের হয়ে এলাম। বললাম, ‘আপনি আপনার মেহমানদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, আমি তাদেরকে খেতে দিয়েছিলাম কি না?’ তারা বললেন, ‘সে সত্যই বলেছে। সে আমাদের কাছে খাবার নিয়ে এসেছিল। আমরাই আপনার অপেক্ষায় খাইনি।’”

আবু বকর (রাঃ) বললেন, “তোমরা আমার অপেক্ষা করে বসে আছ। কিন্তু আল্লাহর কসম! আজ রাতে আমি আহার করব না।”
মেহমানরা বললেন, “আল্লাহর কসম! আপনি না খাওয়া পর্যন্ত আমরাও খাব না।”

তিনি বললেন, “ধিক্কার তোমাদের প্রতি! তোমাদের কী হয়েছে যে, আমাদের পক্ষ থেকে মেহমান নেওয়াযী গ্রহণ করবে না?”

অতঃপর আব্দুর রহমানের উদ্দেশ্যে বললেন, “নিয়ে এসে তোমার খাবার।”
তিনি খাবার নিয়ে এলে আবু বকর (রাঃ) তাতে হাত রেখে বললেন, “বিসমিল্লাহ।” প্রথম (রাগের অবস্থায়) কসম ছিল শয়তানের পক্ষ থেকে। সুতরাং তিনি খেলেন এবং মেহমানরাও আহার করলেন।

(সূত্র: বুখারী হাদীস ৬০২, ৩৫৮১, ৬১৪০, ৬১৪১; মুসলিম হাদীস ২০৫৭; আবুদাউদ হাদীস ৩২৭০; আহমাদ হাদীস ১৭০৪)

মহান আল্লাহ আমাদেরকে খালিছ নিয়তে অতিথি আপ্যায়নের মাধ্যমে বরকত লাভের তাওফীক দান করুন—আমীন!

মুসাম্মাৎ শারমীন আখতার
পিঞ্জুরী, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!