অযাত্রা–দিবাকর ভট্টাচার্য ৩য় পর্ব

গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

অসহ্য!’ মনে হবে তাঁর। তখনই হাত বাড়িয়ে নিভিয়ে দেবেন আলোটা। নরম অন্ধকারে ঢেকে যাবে চারিদিক। ‘ওই স্টেশনের ত্রিসীমানায় আর যাব না কোনোদিন। মার্কেটিং এর কাজে যদি যেতেই হয় ওদিকটায় তাহলে দুটো স্টেশন এগিয়ে নামবো। কিংবা …’—ভাবতে ভাবতে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসবে সিদ্ধার্থের। আধোঘুমে তিনি টের পাবেন বিছানায় তাঁর স্ত্রীর কোমল সান্নিধ্য।

ঘুম থেকে ওঠার পর সিদ্ধার্থের মনে হবে যে অনেক ফ্রেশ হয়ে গেছেন তিনি। মুখের বিস্বাদ ভাবটা আর নেই। গলার অস্বস্তিটাও সেভাবে আর বোঝা যাচ্ছে না। সন্ধেয় বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে কষতে থাকবেন পরের দিনের রিপোর্টিং— টার্গেট-অ্যাচিভমেন্টের হিসেব নিকেশ।

অতো সহজে কিন্তু সিদ্ধার্থ রেহাই পাবেন না। গলার অস্বস্তিটা মাঝেমাঝেই ফিরে আসবে। বিশেষত সিদ্ধার্থ যখন একা থাকবেন। হঠাৎ হঠাৎ তাঁর মনে হবে মুখটা যেন বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে। ঢোঁক গিলতে আটকাচ্ছে। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠবে সেই বীভৎস মুখটা। আর সেই লাল থলথলে ‘এপিথেলিওমা’। মুখে চোখে জল দিয়ে আসবেন সিদ্ধার্থ। মুখ কুলকুচিও করবেন বারবার। তারপর খানিকটা ধাতস্থ হবেন।

এইভাবে কেটে যাবে বেশ কয়েক মাস। এর মাঝে সিদ্ধার্থের প্রমোশন হবে। খুশিতে ভরপুর সিদ্ধার্থ স্ত্রীকে নিয়ে ছুটবেন পার্কস্ট্রীটের অভিজাত রেস্টুরেন্টে। হাসি ঠাট্টা গল্পে শুরু হবে পছন্দমতো অর্ডারে সাজানো রাতের ডিনার। খাবারের প্রথম চামচটি নিয়ে হাতে করে স্ত্রীর মুখে তুলে দেবেন সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থের স্ত্রীও হাসতে হাসতে একইভাবে খাইয়ে দিতে যাবেন সিদ্ধার্থকে। ঠিক সেই সময়েই সিদ্ধার্থের কানে কাছে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে উঠবে—’আনন্দে থাকুন পরিবারের সঙ্গে খুব খুশিতে আর ফূর্তিতে’। সিদ্ধার্থের মনে হবে গলাটা যেন টিপে ধরলো কেউ হঠাৎ। প্রচণ্ড বিষম খেয়ে মুখের খাবারটা বেরিয়ে আসবে সিদ্ধার্থের মুখ থেকে। ‘কি হোলো? শরীর খারাপ লাগছে? চলো আজই ডক্টর সেনকে একবার দেখিয়ে আসি’— উদ্বিগ্ন হয়ে বলবেন সিদ্ধার্থের স্ত্রী। একটুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকবেন সিদ্ধার্থ। তারপর আস্তে করে বলবেন—’ও কিছু না। ঠিক আছে।’

কিন্তু সিদ্ধার্থ নিজেই বুঝবেন যে সব ঠিক নেই। কোথাও যেন কি একটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

এর দুদিন বাদেই সিদ্ধার্থ এসে হাজির হবেন একটি বেসরকারী হাসপাতালের আউটডোরে। শরীরের যতরকম পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়ে বিশাল একটা ফাইল হাতে বসে থাকবেন এক বিখ্যাত চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে।

‘কেমন আছেন? আমি রতন। চিনতে পারছেন তো?’—শুনে চমকে উঠবেন সিদ্ধার্থ। তাকিয়ে দেখবেন পাশে বসা রোগা কালো ক্ষয়াটে মার্কা লোকটা তাঁর পুরোনো প্রতিবেশী। লোকটি নিজের মনেই বলে যাবে—’আমার তো শেষ অবস্থা। সবদিক দিয়েই। গতবছর লক্ষ্মীপুজোর দিন সকালে…।’ সিদ্ধার্থের কানে ঢুকবে না কিছুই। দাঁতে দাঁত চেপে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকবেন তিনি।

‘তা আপনি ভালো আছেন তো?’—নিজের দুঃখের কাহিনী বলার পর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শেষে একথাটি বলবেন ওই রতন নামের লোকটি। সিদ্ধার্থ এবার তাঁর মুখের দিকে তাকাবেন এবং লক্ষ্য করে দেখবেন যে এই লোকটির চোখেও যেন ফুটে উঠছে গিলে খাওয়া এক চাউনি।

এক অদ্ভুত অস্থিরতায় সিদ্ধার্থ ঢুকবেন সেই ডাক্তারবাবুর চেম্বারে। তারপর একটি একটি করে রিপোর্টের কাগজ এগিয়ে দেবেন ডাক্তারবাবুর হাতে। ডাক্তারবাবু গম্ভীর মুখে দেখতে থাকবেন সেইসব কাগজপত্তর। তারপর বলে উঠবেন—’নাহ্‌। রিপোর্টে খারাপ কিছুই পাওয়া যায় নি। তবে…।’ বিরাট একটা ভার নেমে যাবে সিদ্ধার্থের মাথা থেকে। ‘টেনশন করবেন না। ফূর্তিতে থাকুন। খুশি মনে থাকুন। সবার সঙ্গে।’—ডাক্তারবাবুর শেষের কথাগুলি আবার বিশ্রীভাবে কানে এসে বিঁধবে সিদ্ধার্থের। কোনোক্রমে চেম্বারের বাইরে এসে শ্বাস নেবেন লম্বা করে। আমার এই অস্বস্তিটা এবার আমি নিজেই সারিয়ে নেবো মনের জোরে—তখনই নিজেই নিজেকে বলবেন সিদ্ধার্থ। আর বাড়ি পৌঁছোনোর আগেই স্থির করে নেবেন যে কাজ কাজ আর কাজের মধ্যে থাকলেই এইসব ভূতুড়ে ব্যাপার সাফ হয়ে যাবে তাঁর মন থেকে।

অতএব শুরু হবে আরো বেশি করে যেচে কাজের দায়িত্ব নেওয়া—অর্থাৎ অনেক বেশি দৌড়ঝাঁপ—বাইরে যাওয়া ক্লায়েন্ট মিট করা—ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেই সূত্রেই তাঁকে হঠাৎই এক শীতের রাতে উঠে বসতে হবে একটি ট্রেনের কামরায়। কারণ পরদিন সকালেই পৌঁছোতে হবে এক দূরবর্তী শহরে। ট্রেনের প্রায় ফাঁকা সেই কামরার সিটে শুয়ে কিভাবে কাজগুলি গোছাবেন তাই ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে যাবে তাঁর চোখে। কিন্তু সেই ঘুম ভেঙে যাবে হঠাৎই। যখন তিনি বুঝতে পারবেন যে ট্রেনটা আর চলছে না।

তারপর উঁকিঝুঁকি মেরে জানতে পারবেন যে যান্ত্রিক গোলযোগে ট্রেনটা রাতে আর নড়বে না। সিদ্ধার্থ দেখতে পাবেন অন্যান্য প্যাসেঞ্জাররাও টুপটাপ নেমে পড়ছে এদিক সেদিক। সিদ্ধার্থ বুঝে উঠতে পারবেন না কি করা উচিত। নেমে পড়বেন না বসেই থাকবেন। লোকের মুখে শুনতে পাবেন যে ট্রেনটা আটকে গেছে একটা ছোটো স্টেশনের খুব কাছেই। হেঁটে যেতে মিনিটখানেক।

গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!