গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
মাঝরাত। একটি অখ্যাত স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্ম লোকজন নেই বললেই চলে। মাঝেমাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে ইঞ্জিনের আওয়াজ। প্ল্যাটফর্মের ভাঙাচোরা রেলিঙের সামনে একটি বেঞ্চ। সামনে টিমটিম করে জ্বলছে একটি আলো। সেই আলোর নীচে ওই বেঞ্চের দুপাশে দুজন লোক। এদের একজন বেশ হৃষ্টপুষ্ট। অল্প আলোতেও তার ধবধবে শার্টের জেল্লা দেখা যাচ্ছে। দেখেই বোঝা যায় যে ইনি সম্পন্ন ও সুখী মানুষ। বাড়ি কোলকাতায়। একটি সিমেন্ট কোম্পানীর মার্কেটিং ম্যানেজার। এনার নাম সিদ্ধার্থ সেন। পাশের লোকটি ক্ষয়াটে চেহারার। পরনের পোষাক আসাকও সেইমতো। এনার চোখের দৃষ্টিটা যেন কেমন ধরনের। চারিদিক গিলে খেতে চাইছে। দেখে মনে হয় শিক্ষিত। কিন্তু ভবঘুরে টাইপের। অথচ স্টেশনের পাশেই এনার বাড়ি। ইনি সিদ্ধার্থের অপরিচিত।
উপরের কথাগুলি নিজের মনে নিজেকেই বলেছিলেন সিদ্ধার্থ। তারপর খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে প্যান্টের পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাহারী পানের কৌটো বের করলেন। খুব যত্ন করে তার থেকে একটা পান বের করে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে অপরিচিত লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন — ‘দুমিনিট। জাস্ট দুমিনিটের জন্য। বুঝলেন।’ অপরিচিত লোকটি দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন – ‘হুঁ:।’ সিদ্ধার্থ বললেন – ‘হুঁ: মানে?’ অপরিচিত লোকটি একভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন — ‘এই রাত্তিরটা বেশ সুন্দর। আর ওই আকাশটা’। ‘দূর মশাই! বলছিএকটুর জন্য ট্রেনটা মিস করলাম’ – বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে উত্তর দিলেন সিদ্ধার্থ। অপরিচিত লোকটি কেমন একটা বিদ্ঘুটে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইলেন সিদ্ধার্থের মুখের দিকে। সিদ্ধার্থ মুখের মধ্যে আধ-চিবোনো পানের ঢেলাটা একদিকে ঠেলে দিয়ে বলে উঠলেন — ‘কি বুঝলেন?’ তখন স্থির দৃষ্টিতে সিদ্ধার্থের মুখের দিকে তাকিয়ে লোকটি উত্তর দিলেন — ‘বিরাট ক্ষতি হয়ে গেলো আপনার ওই দু-মিনিটের জন্য।’ ঠিক তাই চিন্তা করুন। এখন রাত একটা। তার মানে আরো পাক্কা তিনটে ঘন্টা এখানে এইভাবে বসে থাকা। আর এই লটবহর নিয়ে।
এরপর তাঁদের কথাবার্তাগুলো এই মতো হতে থাকলো —
অপরিচিত: তা এতো জিনিসপত্তর নিয়েছেন কেন মশাই?
সিদ্ধার্থ: আর বলবেন না। বাড়ির আবদার। এখানকার হাতে তৈরী কিছু কিছু জিনিস তো অসাধারণ। এসব আমাদের ওখানে তো আকাশছোঁয়া দাম।
অপরিচিত: এসব আপনার পছন্দের?
সিদ্ধার্থ: (একটু গর্বিতভাবে হেসে) আসলে আমার স্ত্রী এইসব জিনিসের দারুণ সমঝদার। ইন্টিরিয়র ডিজাইনিঙের দারুণ সব আইডিয়া সারাক্ষণ ওর মাথায় ঘোরে। তাই একটা ডোকরার দুর্গা আর দুটো মুখোশ আর —
অপরিচিত: বুঝেছি বুঝেছি ঘর সাজানোর জিনিস সব।
সিদ্ধার্থ: (অবাক হয়ে অপিরিচিতের মুখের দিকে তাকিয়ে) ঘর সাজানো কি বলছেন মশাই? ঘরের পরিবেশটা মানে আবহাওয়াটা—মানে মেজাজটা একেবারে বদলে দেওয়া একটা বিরাট আর্ট। আর আমার স্ত্রী এটা বলতেই হবে (খুব কৃতার্থের মতো হেসে) যে এ ব্যাপারে রিয়েলি গ্রেট। (একটু থেমে, ঘাড়টা সামান্য তুলে) সেইজন্য কোনো কার্পণ্য করিনি মশাই। যতটা সম্ভব সংগ্রহ করেছি। নিয়ে যেতে একটু কষ্ট হবে। তা হোক। (আবার একটু থেমে, গর্বিতভাবে হেসে) আফটার অল আমার প্রিয়জনের মুখে হাসি তো ফুটবে। কি বলেন? লাইফ শুড বি লাইক দ্যাট।
অপরিচিত: তাই?
সিদ্ধার্থ: নিশ্চয়ই। নয়তো এতো কষ্ট করে রোজগার করছি কি জন্যে? নিজে খাবো দাবো আর ভোগ করবো? বলুন? (বলতে বলতে কৌটো থেকে আরেকটি পান বার করে মুখে পুরে দেন।)
অপরিচিত: তা বটে।
সিদ্ধার্থ: (পান চিবোতে চিবোতে) জিনিসগুলোকে কেবল সাবধানে নিয়ে যেতে হবে। মনে হয় ওরা ভালোভাবেই বেঁধে দিয়েছে। কি বলেন?
অপরিচিত: নিশ্চয়ই। ওরা খুব ভালোভাবে বেঁধে দেয় সবসময়ই। একটা মোটা কাগজের ঠিক মাঝখানে জিনিসটাকে রেখে চারদিক থেকে সমান করে কাগজের কোনাগুলো তুলে একেবারে নিখুঁত করে মিলিয়ে দেয়। আর তারপর নিমেষের মধ্যে পুরো মাপসই দড়ি কেটে টানটান ক্করে বেঁধে দেয় চারদিক থেকে। এতটুকু ঢিলে হয় না কোথাও। আপনি আমি পারবই না এভাবে মুড়তে।
সিদ্ধার্থ: (একটু অবাক হয়ে অপিরিচিতের মুখের দিকে তাকিয়ে) আপনি তো খুব খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেছেন ব্যাপারটা।
অপরিচিত: (একটু ম্লান হেসে) ওটাই যে আমার কাজ।
সিদ্ধার্থ: তার মানে?
অপরিচিত: ওই খুঁটিয়ে লক্ষ্য করা ওদের এইসব কাজগুলো।
সিদ্ধার্থ: ও। তার মানে আপনার ওইসব দোকান আছে। তাই না?
অপরিচিত: (নির্বিকারভাবে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে।) নাহ্।
সিদ্ধার্থ: (বিস্মিত হয়ে) সেকি? তাহলে কিভাবে এসব করেন? আর কেনই বা করেন?
অপরিচিত: (মুখ নামিয়ে সিদ্ধার্থের দিকে তাকিয়ে, আস্তে করে) আসলে কি জানেন? এটা করতে আমার খুব ভালো লাগে। এই যে আমার চারদিকে যারা আছে যারা আসছে যাচ্ছে—তাদের সব্বাইকে খুব খুঁটিয়ে দেখি আমি কিভাবে কাটাচ্ছে তারা তাদের জীবনের মুহূর্তগুলো।
সিদ্ধার্থ: কেন?
অপরিচিত: বেশ লাগে দেখতে। ওদের জীবনের সঙ্গে, ওদের প্রত্যেক মুহূর্তের বেঁচে থাকার সঙ্গে কল্পনায় নিজেকে জড়িয়ে নিতে বেশ লাগে।
সিদ্ধার্থ: বুঝলাম নাতো।
অপরিচিত: বুঝলেন না? বুঝলেন না তো? বেশ বুঝিয়ে দিচ্ছি। এই যেমন ধরুন আপনি। আপনাকেও আমি এইভাবে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি। এই যে দৌড়তে দৌড়তে স্টেশনে এলেন। তারপর ট্রেন মিস করলেন। তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে এসে এই বেঞ্চিতে বসলেন। তারপর জিনিসপত্তরগুলোকে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে—
সিদ্ধার্থ: (কিছুটা রুষ্ট ও অসন্তুষ্টভাবে) সে কি মশাই! এইভাবে চুপিসাড়ে একজনকে এভাবে ফলো করে যাচ্ছেন? তা এরপরে কি করবেন?
অপরিচিত: কল্পনা—কল্পনা করব।
সিদ্ধার্থ: (অত্যন্ত অবাক হয়ে) অ্যাঁ?
অপরিচিত: হ্যাঁ। কল্পনায় দেখছি—আপনি বাড়ি ফিরলেন—আপনার স্ত্রী হৈ হৈ করে প্যাকেটগুলো খুললেন—তারপর ওই ডোকরার দুর্গাটা আপনাদের বসার ঘরের কোণায় একটা হাল্কা হলুদ আলোর নীচে একটা গোল কাঁচের টেবিলের উপর—
সিদ্ধার্থ: (অপরিচিতের কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে) বাপরে। আপনি পারেন বটে।
অপরিচিত: হ্যাঁ পারি। শুধু এইভাবেই পারি বেঁচে থাকতে। অন্যের বেঁচে থাকার সঙ্গে লেপ্টে থেকে। অবশ্যই কল্পনায়। নয়তো— (হঠাৎ সচকিত হয়ে) ওই শালা! ওই শালা আবার এসেছে। এবার মারবো এই ইঁটটা ছুঁড়ে (বলতে বলতে পায়ের তলা থেকে একটা বড়ো ইঁটের টুকরো কুড়িয়ে ছুঁড়তে যান রেলিঙের পাশের ঝোপটির দিকে।)
সিদ্ধার্থ: (ঘাবড়ে গিয়ে) ওকি? ওকি? কি করছেন? কে ও?
অপরিচিত: (উত্তেজনায় হাঁফাতে হাঁফাতে) দেখলেন না? দেখতে পেলেন না? ওই যে রেলিঙের পাশ দিয়ে উঁকি মেরেই লুকিয়ে গেলেন এক মহিলা।
সিদ্ধার্থ: (আরো বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে) মহিলা? আর তাকে আপনি ইঁট মারতে যাচ্ছেন?
অপরিচিত: হ্যাঁ—আমার স্ত্রী।
সিদ্ধার্থ: (নিজের মাথায় হাত দিয়ে) কি সব্বোনাশ! নিজের স্ত্রীকে মারতে যাচ্ছেন? কেন? কি করেছেন উনি? আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই!
অপরিচিত: কি করেছে? কি করেছে জানেন? পাহারা। পাহারা দিচ্ছে আমায়। সারাক্ষণ এইভাবে পাহারা দেয় আমায়। যদি আমি কিছু করে ফেলি। যদি ঝাঁপিয়ে পড়ি ট্রেনের তলায়। কিংবা—
সিদ্ধার্থ: (হতভম্বের মতো তাকিয়ে) তা বলে তাকে মারতে হবে?
অপরিচিত: (প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে) হ্যাঁ মারতে ইচ্ছে করে। প্রচণ্ড মারতে ইচ্ছে করে ওকে। (একটু হেসে) ও কি চায় জানেন? একটা সুন্দর ঘর। সুন্দর বিছানা। ফিটফাট জামা পরে আমি বসে থাকি ওই ঘরে। ওই বিছানায়। ওর কাছে।
সিদ্ধার্থ: (অত্যন্ত অবাক হয়ে) সেটাই তো স্বাভাবিক। আর তার জন্যে তাকে মারতে যাবেন?
অপরিচিত: হ্যাঁ। শুধু মারতে নয়। খুন করতে। (প্রচণ্ড উত্তেজনায় হাঁফাতে হাঁফাতে) সেদিন মনে হচ্ছিল ওর মাথাটা থেঁতলে দি। কেন জানেন? ও আমায় চুমু খেতে এসেছিল। কোথায় জানেন? (আঙুল দিয়ে উপরের ঠোঁটের দিকে দেখিয়ে) এইখানে-এইখানে। (বলতে বলতে অপরিচিত ব্যক্তিটি তাঁর মুখটি নিয়ে আসেন সিদ্ধার্থের মুখের খুব কাছে, তারপর বলতে থাকেন) তারপর নিজের ঠোঁটটা ব্লেড দিয়ে কাটতে গিয়েছিল যাতে ও চলে যেতে পারে মৃত্যুর দোরগোড়ায়—আমার মতো।
সিদ্ধার্থ: (ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে পেছিয়ে এসে) মানে?
অপরিচিত: মানে? (বলেই সিদ্ধার্থের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে নিজের উপরের ঠোঁটটা উলটে দেখায়—সেখানে একটা চেরী ফলের মতো লাল টুকটুকে মাংসল ঢিবি) লোকটি বলে ওঠে—দেখলেন? দেখলেন ওটাকে? ভারী মিষ্টি নাম—’এপিথেলিওমা’—আমার মৃত্যুর দ্বার —দেখে নিন ভালো করে (সিদ্ধার্থ হতভম্বের মতো অপরিচিতের দিকে তাকিয়ে থাকেন) (অপরিচিত লোকটি আস্তে করে খুব নরম গলায় বলতে থাকেন) মনে হয় ভারী সুন্দর একটা ফুলের নাম। তাই না? তা ফুলই বটে। রোজ একটু একটু করে ফুটে উঠছে। যতক্ষণ না আমি ঝরে যাই। (একটু থেমে ম্লান হেসে) এই দিয়ে আমি আমার বৌকে চুমু খাবো জড়িয়ে ধরবো বিছানায়—কি বলেন?
সিদ্ধার্থ: না মানে—
অপরিচিত: (আস্তে করে ঠাণ্ডা গলায় বলতে থাকেন) ভাবুন তো ওই হিরোসিমার লোকগুলোর কথা। পারতো ওরা? পারতো? পরিষ্কার করে বিছানা পেতে বসে থাকতে? প্লেট ধুয়ে ঝকঝক করে খেতে বসতে? মুখে পাউডার মেখে সুন্দর করে চুল বেঁধে পাশের লোকটির গলা জড়িয়ে ধরতে? যখন তারা জানতে পেরে গেছে আর কয়েক ঘন্টা মাত্র কয়েক ঘন্টা তার আয়ু? বলুন? বলুন?
সিদ্ধার্থ: (আমতা আমতা করে) না তা নয় তবে—
অপরিচিত: তবে কি? (একটু থেমে) তবে কি জানেন? তখন মনে হয় আশেপাশে যারা বেঁচে থাকবে—তাদের প্রত্যেকের মাথা গুলো ভেঙে চুরমার করে দিই—সে আমার প্রিয়জন হোক কিংবা আপনি।
সিদ্ধার্থ: (আঁতকে উঠে) সে কি?
অপরিচিত: (খুব হাল্কাভাবে) আরে না না—অতো ভয় পাবেন না—তা বলে আমি সত্যি সত্যি আপনাকে মারতে যাচ্ছি নাকি? আর আমার বৌয়ের ব্যাপারেও আপনাকে অত উদ্বিগ্ন