এপারে দাঁড়িয়ে খুদকুমার আকুল চোখে চারিদিকে তাকায়। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী কি তা হ’লে ভুল ঠিকানা দিয়েছে? কিন্তু তা তো দস্তুর নয়। রাজপুত্র বলে তাকে না হয় পছন্দই হয়নি, কিন্তু তাই বলে মিথ্যে খবর? ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর তা হলে তো জাত যাবে। রূপকথার রাজ্যে মুখ দেখাতে পারবে না।
ভুল নয়, ঠিক। আকাশের কোলে সাদা মেঘ নয়—দুধ-পাহাড়ের মাঝে চার-দুয়ারে বিশাল পুরী। কিন্তু একি ব্যাপার! বিশাল পুরীর চার-দুয়ারে হৈ-হৈ হট্টগোল, থই-থই ভিড়।
খবর তো আর সে একা পায়নি; পুব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ যেখানে যত রাজপুত্র, কেউ আর আসতে বুঝি বাকি নেই।
কী তাদের চেহারা আর কী সব সাজপোষাক! দুধ-পাহাড়ের গা ঝলমল করছে
তাদের হীরে মুক্তো চুনি পান্নার জেল্লায়।
কিন্তু দুয়ার তো খোলে না। রাজপুত্রদের ঝকঝকে ধারাল সব তলোয়ার ভোতা হয়ে গেল। দরজায় দাগ পড়ে না। দল বেঁধে বড় বড় গাছ পাথর নিয়ে তারা চড়াও হ’ল।
দরজা নড়ে না। খুদকুমার কিছু করবে কি, হোমরাচোমরাদের দলে সে পাত্তাই পায় না। রাজপুত্রদের ভারি মখমলের সাজ ছিড়ল, মাথার ঘাম পায়ে পড়ল। দরজা যেমন তেমনি বন্ধ।
হয়রান হয়ে সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, খুদকুমার ভয়ে ভয়ে গেল এগিয়ে।
চার- দুয়ারের একটি খিল
খুলবে তো তাল করো তিল।
কিন্তু কোথায় তাল আর তিলই বা করবে কি ! অনেক খুঁজে পাথরের মতো নিরেট দরজায় চুলের মতো একটি ফুটাে যদিবা বেরুল, তাও ধুলোয় ঢাকা। কিন্তু ধুলো সরাতে একটি ফু যেমন দেওয়া, অমনি কড়কড় ঝনঝন করে চার-দরজা একসঙ্গে গেল খুলে।
আর তখন রক্ষে আছে! পিল পিল করে রাজপুত্রেরা খুদকুমার আর তার ঘেয়ো কুকুরকে কোথায় ঠেলে সরিয়ে ফেলে মাড়িয়ে চার-দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল পুরীতে।
খাঁ খাঁ পুরী। কেউ কোথায়ও নেই। দেউড়ি থেকে দালান, এ-মহল থেকে সে মহল, রাজপুত্রের দল খুঁজতে খুঁজতে একেবারে পুরীর মাথায় মণিকোঠায় রাজকন্যার দেখা পেল।
কাঁচবরণ কন্যা মেঘবরণ চুল মেলে বিছানার ওপর শুয়ে আছেন। সকলকে দেখে কান্নায় ভেজা চোখ মুছে শুধোলেন, “কে খুললে দরজা ?” হাজার রাজপুত্র একসঙ্গে হাক দিয়ে উঠল, “আমি।”
দুঃখের মধ্যেও রাজকন্যা হাসলেন। বললেন, “শুধু দরজা খুললে তো হবে না, এ পুরীর এমন দশা যে করেছে, সেই কালরাক্ষসকে যে ঘায়েল করবে তার জন্যেই গলার মালা আছে তোলা।”
“কোথায় থাকে কালরাক্ষস ?”—হাজার গলা গর্জে উঠল।
“দুধ-পাহাড়ে দধি-সায়র
তার মধ্যে কালরাক্ষসের গড়।”
কিন্তু দুধ-সায়র তো যেমন তেমন নয়, নৌকা ভাসলে ক্ষারে গলে যায়, সাঁতরে পার হতে গেলে কালরাক্ষসের পোষা কুমিরে খায়, কালরাক্ষসের নাগাল পাওয়াই দায়।
‘আচ্ছা কুছ পরোয়া নেই? হাজার রাজপুত্ত্বর এক দঙ্গলে দুধ-সায়রের পাড়ে গিয়ে হাজির!
কিন্তু জলে যে নামে সে আর ওঠে না।
সকাল থেকে দুপুর গিয়ে সন্ধ্যে হ’ল!—হাজার রাজপুত্রের কেউ তখন কুমিরের ভোজ, কেউ ভয়ে নিখোঁজ।
সন্ধ্যে গিয়ে রাত হ’ল। ঘেয়ো কুকুর নিয়ে খুদকুমার দধি-সায়রের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। থকথক করছে দধি-সায়র, তার মাঝে থমথম করছে চাদের আলোয় কালরাক্ষসের গড়। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর ছড়ার গুণে দরজা খুলেছে বিশাল পুরীর, কিন্তু দধি সায়র পার হবার হদিশ মেলে কোথায় ? হঠাৎ খুদকুমার চেঁচিয়ে উঠল, “আরে থাম থাম!”
আর ‘থাম থাম!—বলা নেই কওয়া নেই ঘেয়ো কুকুর হঠাৎ দুধ-সায়রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওদিকে কুমিরেরও টনক নড়েছে।
হা করে এল তেড়ে, কুকুর বেচারার দশা বুঝি দিল সেরে!
এতদিনের পথের সাথী, এই বিপদে কি ছাড়া যায়? খুদকুমার ফলা-ভাঙা ছুরি হাতেই দুধ-সায়রে পড়লো লাফ দিয়ে।
কিন্তু বাঁচাতে গেছে কাকে! কুকুর নয় যেন জলের মাছ! কুমিরকে চরকিপাক খাইয়ে ঘেয়ো কুকুর যেন মজা দেখে। কুকুরের পেছনে কুমির ছোটে, আর খুদকুমার নিঝঞ্জাটে কালরাক্ষসের গড়ে গিয়ে ওঠে। কুমিরকে কলা দেখিয়ে ঘেয়ো কুকুরও তার পিছল পিছু গা-ঝাড়া দিতে দিতে উঠে আসে।
কালরাক্ষসের গড়। তার কত গম্বুজ কত খিলানে কত সুড়ঙ্গ কত সিঁড়ি। কিন্তু কোথাও কারুর সাড়াশব্দ নেই কেন?—এ-মহল থেকে ও-মহল, একতলা থেকে দোতালা, তা থেকে তেতালার এক ঘর। ঢুকতে গিয়ে খুদকুমার থমকে দাঁড়াল। তারই মতো একটি ছেলে একটা ময়লা বিছানায় বসে হাপুসনয়নে কাঁদছে।
গল্পের শেষ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।