কাল থেকে গরমের ছুটি পড়ে যাবে | স্কুলের গেট দিয়ে বেরোতে বেরোতে মনটা ভারি খারাপ লাগছিল মুন্নির | একমাস ছুটি | একে তো গোটা একটা মাস বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে না ‚ সেজন্য মন খারাপের একটা ব্যাপার আছেই | সব থেকে বাজে হল গোটা মাসটা সারাদিন বাড়িতে থাকতে হবে | গরমের ছুটিতে বন্ধুদের অনেকেই মামারবাড়ি ‚ মাসিরবাড়ি বেড়াতে যাবে | মুন্নিরাও যে যায় না তাও নয় | ক’দিন আগেই মা বাবাকে বলছিল ‚
চল এবার গরমের ছুটিতে ছোট ঠাকুরপোর ওখান থেকে ঘুরে আসি |
ছোট ঠাকুরপো মানে মুন্নির ছোট কাকা | ব্যাঙ্গালোরে থাকে | মুন্নি জানে সেই জায়গাটাকে বলে এয়ারকন্ডিসন সিটি | সারা বছরই সেখানে হালকা ঠান্ডা | রাতের বেলা কম্বল নিয়ে ঘুমোতে হয় | চমৎকার নাকি সাজানো -গোছানো শহর | ব্যাঙ্গালোর থেকে কাছাকাছি আরও দু-একটি জায়গায় ঘুরেও আসা যায় | ছোটকাকা বছর চারেক হল ট্রান্সফার নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেছে | কাকিমা মুন্নিকে বেশ ভালোবাসে | ওদের পাঁচ বছরের ছেলে টুবাইতো দিদিভাইয়ের খুবই ভক্ত | কলকাতায় এলে একেবারে মুন্নির গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকে | কিন্তু তবু মা যখন ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার কথা বলছিল ‚তখন মুন্নি চুপ করে ছিল | কোনও উৎসাহ দেখায়নি | আসলে কোনও আত্নীয়স্বজনের বাড়ি যেতেই মুন্নির একেবারে ভাল লাগে না | একদম অচেনা জায়গায় ‚ অচেনা মানুষজনের মধ্যে বেড়াতে যাওয়া একরকম | তাও যে কখনও-সখনও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি হয় না তা নয় | তবু সেটা কোনোওরকমে মানিয়ে নেওয়া যায় | কিন্তু চেনাশোনা কারুর বাড়িতে গেলেই মুন্নি জানে প্রসঙ্গটা উঠবেই | আর তাহলেই মুন্নির মনে হবে তার চারপাশে দিনের আলো যেন মরে গেল | মুখের ভিতরটা যেন বিস্বাদ | হাসি-আনন্দ এসবের কোনও চিহ্নই আর তার চারপাশে নই |
মুশকিল হচ্ছে নিজের মনের এই অবস্থাটা সে কাউকে বলতেও পারে না| মা-বাবাকে তো নয়ই | বলবে কী করে ‚ তার এই অবস্থাটা তো তৈরি হয় মায়ের জন্যই | গরমের ছুটিতে গোটা একটা মাস মায়ের সঙ্গে বাড়িতে থাকতে হবে ভাবলেই বিরক্ত লাগে মুন্নির | চোখের ভিতরটা কীরকম জ্বালা জ্বালা করে ‚ মেজাজ খিঁচড়ে থাকে |
তাহলে কি মুন্নির মা তার নিজের মা নয় ? নাকি মুন্নিকে কি তার মা মোটেই ভালোবাসে না ? ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই সেরকম নয় | আসলে মুন্নির মা অপরুপ সুন্দরী | মুন্নিদের ‚মানে তার মায়ের শ্বশুরবাড়ি ‚ বাপেরবাড়ি কোনওদিকেই তার মত সুন্দরী কোনও মেয়ে-বউ কেউ নেই | ছিপছিপে দিঘল চেহারা | একমাথা সিল্কের মত নরম ‚হালকা ঢেউ খেলানো চুল | নিখুঁত নাক -চোখের গড়ন | মুক্তোর মত দাঁত | ঝলমলে হাসি আর চাঁপা ফুলের মত গায়ের রঙ | এককথায় মুন্নির দিকে তাকালে চোখে ফেরানো কঠিন |বিয়ের দিন যখন তাঁকে সাজিয়ে-গুজিয়ে বসানো হয়েছিল তখন দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গ থেকে অপ্সরী নেমে এসেছে | অতিথিরা কনের ঘর ছেড়ে নড়তেই চাইছিল না | পিসিদের মুখে এসব গল্প মুন্নি অনেকবার শুনেছে |
এহেন মায়ের মেয়ে মুন্নি কিন্তু একেবারেই মায়ের মত দেখতে নয় | সে সুন্দরী না কুচ্ছিত বলা কঠিন | তবে মায়ের সঙ্গে তুলনা করলে তাকে কুচ্ছিতই মনে হবে | মুন্নির নিজেরও তাই মনে হয় | আর তার ধারণা মায়ের পাশে তাকে দেখলে অন্যদেরও তাই মনে হয় | এরকম ধারণা হওয়ার পিছনে অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে | কারণ ছোটবেলা থেকে মায়ের সঙ্গে এই তুলনাটা সে শুনে আসছে | কাকা-পিসি হোক কিংবা মামা-মাসি | বন্ধু-বান্ধব হোক কিংবা পাড়া-প্রতিবেশী | মুন্নি যে তার মায়ের মত সুন্দরী হয়নি এ দুঃখ প্রকাশ করতে কেউ দ্বিধা করেন না | অমন ফর্সা মায়ের মেয়ের গায়ের রঙ কী করে এমন ময়লা হল ভেবে আপশোষ করে থাকেন অনেকেই |
মুন্নির বয়স এখন চোদ্দ | জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এই কথাগুলো শুনে শুনে তার মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে ‚ তাকে দেখতে ভারি খারাপ | কিন্তু যদি খারাপ হয়ও‚ তাহলেও তো সেটা অন্যের মুখে বারবার শুনতে কারুর ভাল লাগে না | মুন্নি তাই আত্নীয়-স্বজনদের এড়িয়ে চলতে চায় | বন্ধু-বান্ধবদের বাড়ি যেতে চায় না | সত্যি বলতে কী মায়ের সঙ্গে কোথাও যাওয়াই তার ভারি অপছন্দ | সারাক্ষন তার মনে হয় ‚ রাস্তার সব লোকই যেন পাশাপাশি তাদের দুজনকে দেখছে আর ভাবছে এমন সুন্দরী মায়ের এমন একটা মেয়ে কী করে হল!
গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।