থিসলডাউনের প্রহরী–হাসান জাহিদঃচতুর্থ পর্ব

কনকনে ঠাণ্ডায় আর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে টহল সারছিল মহিব। পা চলছিল না। মনে হলো বাসায় গিয়ে ব্ল্যাঙ্কেটের উষ্ণতায় টানা ঘুম দেয়। একটুখানি উষ্ণতা যে ওর কাছে কোহিনূর হীরকখণ্ডের মতোই অধরা, সেটা মহিবের চাইতে বেশি আর কে জানে। একটা নয়া উৎপাত দেখা দিল। চত্বরে একটা গাড়ি থেমেছে। গাড়িটার গায়ে সিলছাপ্পর দেখে বুঝতে পারে তার কোম্পানির গাড়ি। তার মানে সুপারভাইজার এসেছে প্রহরার তদারকি করতে। মহিব দূর থেকে চান্দি আশফাককে নামতে দেখল। গায়ের রং ফর্সা, দশাসই শরীর। ব্যাটা আদতে পাকিস্তানি, এখানে এসে কানাডিয় বনে গেছে। কোম্পানির সিকিউরিটি ড্রেসটা স্বাস্থ্যের প্রাচূর্যের কারণে মানিয়ে গেছে তাকে। ওপরে গরম কাপড় লাগায়নি – গাড়ির হিটের ভেতরেই কাটে রাতদিন। আশফাক নাকিসুরে ‘হাই মহিব’ বলে এগিয়ে এল। মহিব যৎসামান্য হিন্দি আর উর্দু বলতে পারে। কিন্তু আশফাকের সাথে সে কখনো উর্দু বলে না। এরা আশা করে, সব বাঙালিই উর্দু জানবে এবং ওদের সাথে মোলাকাত হলে যেচে পড়ে উর্দু বলা শুরু করবে। মহিব যে কোনো পাকিস্তানির সাথে ইংরেজিতে কথা বলে। আশফাক মহিবের ড্রেসের দিকে তাকাল। দেখল মহিব কোম্পানির দেয়া প্যান্ট-শার্ট-টাই ঠিকমতো পরেছে কিনা। মহিবের পোশাকের কোনো ত্রুটি না পেয়ে আশফাক বলল, চলো অফিসে তোমার মেমোবুক আর ট্যুর অভ ডিউটি ফরম দেখি।

 

শালা মাওড়া। মহিব মনে মনে উচ্চারণ করল। টেবিলে ছড়ানো ছিটানো অকারেন্স ফরম আর টিওডি। মেমোবুক লেখাটা কিছু বাকি ছিল। আশফাক সেটাই আগে হাতে নিল। দেখেশুনে, চান্দিতে আলোর রশ্মি ছড়িয়ে আশফাক বলল, মেমোবুক সবসময় আপডেট করে রাখবে। আর লেখার মাঝখানে কোনো ফাঁকফোকর রাখবে না। ঠাসাঠাসি করে লিখবে।

পুরনো কথা। মহিব আবার উচ্চারণ করল মনে মনে।

আশফাক সুপারভাইজরি ফরমে বিবরণ লিখল। একটা কপি নিজ পকেটে রাখল আর অন্যটা বাইণ্ডিং নথির ক্লিপে আটকে বলল, গুডনাইট। সি ইয়্যূ লেটার।

তোমার কুমড়ার মতো মুখখানা আর তেলে-চান্দি সহসা আর দেখতে চাইনা। মহিব মনে মনে উচ্চারণ করল। আশফাক ফাঁকা চত্বরে গাড়ি এত দ্রুত টার্ণ করল যে চাকার ঘ্যাঁচ শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেল। চাকার শব্দে মহিবের মনে পড়ে গেল একটা দুর্ঘটনার কথা। এইদেশে আসবাব দিনকয়েকের মধ্যেই ওর বাসার কাছে ড্যানফোর্থে একটা গাড়ি ব্রেক কষেছিল। ব্রেক করার কারণ হলো পথচারি পারাপারের আগমুহূর্ত পর্যন্ত গাড়িটার প্রচণ্ড গতি ছিল। ব্রেক করলেও গাড়িটা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সামনের একটা গাড়িকে ধাক্কা মারল। ব্যস, শুরু হয়ে গেল তুলকালাম কাণ্ড। সামনের গাড়ির চালক বেরিয়ে এসে গগনবিদারী চিৎকার শুরু করল। আঘাতকারি তরুণী গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। তরুণীটি নার্ভাসভঙ্গিতে এগিয়ে এল সামনের গাড়ির দিকে। তেমন কিছু হয়নি, একটু টেপ খেয়ে গেছে। ইতোমধ্যে পুলিশ এসে গেছে। মেয়েটা বারবার ‘সরি’ করছিল পুলিশের কাছে, লোকটার কাছে। মেয়েটাকে ভারতীয় বা শ্রীলংকান মনে হয়েছিল মহিবের কাছে। চাপা রং, সুশ্রী মুখ। একটু আগের চাকা ঘষটানোর শব্দে বহুদিন আগের সেই দৃশ্যটা ফের জেগে উঠল মনে। তারপর কী হয়েছিল? কত ডলার জরিমানা হয়েছিল মেয়েটির?

 

 

মেইন রাস্তা থেকে গাড়ির চাকা ঘষটাবার শব্দে সচকিত হয় মহিব। আজ রাতটা বুঝি চাকা ঘষাঘষির রাত? মহিব ঘড়ি দেখে – তিনটা কুড়ি। ওর পোস্টের পাশেই ই। জেড লুব। গাড়ি সার্ভিসিং করা হয়। তার একপ্রান্তে একচিলতে স্থানে একটা কনভেনিয়েন্স স্টোর, মানে মুদির দোকান। অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে দোকানটা। বাইরে নিয়নের লালবাতিতে OPEN লেখাটা জ্বলজ্বল করে। দোকানটা চালায় জেইয়া। তামিল ভাষায় কথা বলে। কালো, শাদামাটা নিরীহগোছের চল্লিশোর্ধ ব্যক্তি। ডিউটির প্রথমদিন থেকেই জেইয়ার সাথে পরিচয়।

 

জেইয়াকে মাঝেমধ্যে বাইরে এসে সিগারেট খেতে দেখা যায়। কিন্তু সে রাতে তাকে একবারও দেখা গেল না। দোকানে যথারীতি OPEN লেখাটা জ্বলছিল। হয়তো জেইয়া ভেতরে বসে কম্পিউটারে কাজ করছে। মহিব দোকানের ভেতরে ঢুকল। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। সেই মেয়েটি না! মহিবকে ‘হাই’ বলল মেয়েটি। মহিবকে সে চেনেনি। একজন খদ্দের হিসেবে হাই করেছে। মহিব বলল, জেইয়া নেই?

না, তবে চলে আসবে। তুমি চেন তাকে?

হ্যাঁ, চিনি।

তুমি বুঝি এখানকার সিকিউরিটি অফিসার? মেয়েটা মহিবের ড্রেসের দিকে একনজর চোখ বুলিয়ে বলল।

হ্যাঁ।

হাই দেয়ার – বলে জেইয়া ঢুকল। বলল, সি ইজ মাই ওয়াইফ।

ইয়োর ওয়াইফ! মহিবের মুখনিঃসৃত বাক্যটি বিস্ময়সূচক। ওর এরকম বিস্ময় দেখে জেইয়া অবাক হয়ে তাকাল। মহিব বলল, তোমার ওয়াইফ কি একবার একটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল? মানে তার গাড়ি দিয়ে সামনের একটা গাড়িকে ধাক্কা মেরেছিল?

গল্পের ৫ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

দুঃখিত!