থিসলডাউনের প্রহরী–হাসান জাহিদঃ১ম পর্ব

বাস যেখানে থামে সেটা একটা কাচের ছোট ঘর। স্থানটার নাম থিসলডাউন বুলভার্ড। নামে বেশ ভারি হলেও স্থানটা তেমন ভারি নয়। এলাকাটায় বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মার্কেট সবই আছে। কিন্তু দূরে দূরে। তেমন জমজমাটও নয়। ফুটপাথের ওপর কাচের চারকোণা ঘরটিই বাসস্টপ। স্টপে নামলেই একটা বিশাল চত্বর এবং তারপর একটি প্লাজা। থিসলডাউন প্লাজা। প্লাজার পেছনে বিশাল এলাকা জুড়ে জংলা স্থান, পতিত ভূমির মতো। বিশাল প্লাজার সামনের চত্বরে হররোজ অসংখ্য গাড়ি থামে। সকাল ন’টা থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত প্লাজা-চত্বর কর্মচঞ্চল থাকে। সাতটার পর সব নীরব হতে থাকে। রাত দশটা নাগাদ এলাকাটা রীতিমতো ভুতুড়ে রূপ ধারণ করে। প্লাজার সামনের বিশাল সড়কের ওপারেও আছে সারিসারি দোকানপাট আর কটেজের মতো দেখতে বাড়িগুলো। রাতের একটা বিশেষ প্রহরে সব যখন নীরব হয়ে যায় তখন শুধু সামনের বিশাল সড়ক দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে যায় গাড়িগুলো। প্লাজার পেছনের বিশাল সাব গাছের মাথায় অপার্থিব শব্দ তুলে বয়ে যায় কনকনে হাওয়া।

কাচঘেরা স্টপে মহিব সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা বা পৌনে সাতটায় বাস থেকে নামে। সে আসে সেই ভিক্টোরিয়া সাবওয়ে থেকে। সাবওয়ের কাছেই একটি অ্যাপার্টমেন্টে ও থাকে। টরোন্টোর সাবওয়ে মূলত পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত। ভিক্টোরিয়া থেকে মহিব পশ্চিমগামী ট্রেন ধরে। পশ্চিমে এর শেষ গন্তব্য কিপলিং। তার এক স্টেশন আগের রয়ালইয়র্ক স্টেশনে নামে মহিব। টরোন্টো সাবওয়ের পুরোটাই প্রায় ভ্রমণ করে ফেলে মহিব কর্মস্থলে যেতে আসতে। ভিক্টোরিয়ার আগে পুবে মাত্র দু’টি স্টেশন-ওয়ার্ডেন ও ক্যানেডি। রয়ালইয়র্কে নেমে আবার বাস ধরতে হয়। ট্রেন-বাস মিলিয়ে সময় লাগে পৌনে দুই ঘন্টা। এই সময়টাতে সে প্রায় শত মাইল পাড়ি দিয়ে দেয়।

থিসলডাউন প্লাজাই ওর কর্মক্ষেত্র। বারোঘন্টার নাইট ডিউটি। টানা তিনচার দিন ডিউটি পড়লে মহিব ছটফট করে, ব্যাকুল হয়ে থাকে ডে-অফের জন্য। আসা যাওয়ার সাড়ে তিনঘন্টা আর বারোঘন্টা ডিউটি সময় বাদ দিয়ে যে সময়টার জন্য সে বাড়ি ফেরে, তাতে কোনো কাজেই মনোসংযোগ করা যায়না। ঠিকমতো ঘুমটাও হয়না। সুতরাং মহিব যে প্রকারের সময় পার করছে, তা নির্মম। কাজের ধরণটাও কষ্টদায়ক এবং মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। মহিব পাহারাদার। যদিও এরা বলে সিকিউরিটি অফিসার। ওরা অনেককিছুই বলে কিন্তু মহিব পাহারাদার ছাড়া অন্য কিছু বলে না। এই ‘পাহারাদার’ বলার মধ্যে যে একটা প্রহসন লুকিয়ে আছে, মহিব সেটা প্রকাশ করতে চায়। ওর পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর পাহারাদারের কাজ করার যে নেতিবাচক দিকগুলো আছে তা এককথায় প্রকাশ করার জন্য মহিব ‘পাহারাদার’ ছাড়াও অন্য কোনো যথাযথ শব্দ খুঁজছে যাতে কেউ ‘আপনি কী করছেন’ প্রশ্ন করলে জবাবে যেন একইসাথে নিজের পদ ও ভোগান্তি প্রশ্নকর্তার কাছে চটপট তুলে ধরতে পারে। এবং প্রশ্নকর্তাকে আর কোনো ধরনের প্রশ্ন থেকে যেন বিরত রাখতে পারে।

সেই রাতে মহিব ডিউটি করছিল। আসলে ভাবছিল। খানিকটা চোখের জলও ফেলেছিল। কিন্তু যেহেতু সে স্টেশনে পোস্টেড থেকেই ভেবেছিল বা অশ্রুজল ঝরিয়েছিল তাই অশ্রু ঝরানোর কাজটাও ডিউটির মধ্যেই পড়ে। সামনের খোলা চত্বরে আর কোনো গাড়ি থেমে নেই। শেষ গাড়িটা চলে গেছে রাত পৌনে দু’টোয়। চত্বর ছাড়িয়ে ফুটপাথের দিকে তাকিয়ে ছিল মহিব। ঝাপসা হয়ে আসছিল দুই চোখ। এসময় দৃশ্যটা চোখে পড়ল। কালো মতো কী একটা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে আসছিল। সচকিত হয় মহিব, চোখ রগড়ে ভালো করে তাকায়। কোনো জন্তু ছিল না সেটি। মানুষই। কালো প্যান্ট আর সুয়েটার পরা বেঁটে একটা লোক। ফুটপাথের ওপর সে একবার উবু হচ্ছিল, ফের দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। কিছুটা হেঁটে এগিয়ে গিয়ে আবার সে আগের দৃশ্যেরই অবতারণা করছিল লোকটা। মহিবের ঝাপসা চোখে মনে হচ্ছিল লোকটা যেন লাফাচ্ছিল। কিন্তু কী করছে সে! লোকটা তারপর চত্বরে নামল ফুটপাথ ছাড়িয়ে। মহিব চেয়ার ছেড়ে বাইরে এসে সারি সারি দোকানের সামনে দাঁড়াল। লোকটা কাছে এগিয়ে এল। মহিব জানতে চাইল সে কী করছে। ফর্সা, বেঁটে লোকটা মহিবের প্রশ্নে তাকাল ওর দিকে। জবাব দিল না। উবু হয়ে কী যেন খুঁজতে লাগল। মহিব এবার নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী খুঁজছ তুমি?

কয়েন। কয়েন খুঁজছি।

কয়েন খুঁজছ মানে?

আমি কয়েন খুঁজে বেড়াই। আমার নাম গিলবার্ট। সবাই চেনে আমাকে। তুমি চিনতে পারছ না। লোকটা হাতের তালুতে রাখা কয়েকটি কানাডিয় কয়েন দেখাল মহিবকে।

তুমি তবে রাস্তায় কয়েন টুকিয়ে বেড়াও, কত পাও ডেইলি?

গতরাতে কুড়ি ডলার পেয়েছি। আজ এখনো তেমন কিছু পাইনি।

গুড, মহিব বলল, এখন অনেকরাত। বাসায় যাও। তোমার বাসা কোথায়?

কাছেই।

তবে যাও। সামনে তুমি যেন আরো বেশি কয়েন কুড়িয়ে পাও, সে প্রার্থনা করছি।

 

গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

 

 

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!