ম্যাঁও—অথই নীলিমা

সবে নাস্তা খেয়ে সকালের খবরটা দেখতে টিভি ছেড়েছি, এমন সময় কোত্থেকে টুসিটা এসে টিভির দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় “ম্যাঁওওও…” বলে উঠলো।
একটু চমকে গেলাম। সত্যি বলতে কি, একটু ভয়ও পেলাম। কারণ আমাদের এই বেড়াল মহাশয়ের মেজাজ-মর্জি আজকাল ঠিক সুবিধের ঠেকছে না। কখনও কারো ওপর রেগে গেলে দাঁতের ধার পরখ করে নিতে সে ভুল করছে না। আর তাই তার লম্বা ম্যাঁওওও শুনে একটু ব্যতিব্যস্ত হলাম, গায়ে আদর করে হাতও বোলালাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরও জোরে ম্যাঁওওও করে উঠলেন। পিলে চমকে গেল। আত্মরক্ষার তাগিদে লাফিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলাম। কিন্তু উনিও ছাড়বার পাত্রটি নন। লম্বা একটা লাফ মারলেন আমাকে লক্ষ্য করে। টিভির সামনে থেকে টিভির পেছনে পারলে লুকিয়ে যাই আমি তখন এমন অবস্থা। চোখ বন্ধ করে ওপরওয়ালার নাম করতে করতে টুসির আঁচড় খাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত চোখে মুখে কোনও আঁচড় অনুভব না করায় ভয়ে ভয়ে চোখ খুলেই দেখি—ওমা এ কি! উনি দেখি থেকে থেকে টিভির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছেন! সর্বনাশ করেছে আমার, টিভিটা ভাঙবে না কি! তাড়াতাড়ি সুইচটা বন্ধ করে টুসিকে ধরতে গেলাম, ওমা, সে আরেক কাণ্ড। তার রুদ্রমূর্তি নিমিষেই উধাও, টিভি বন্ধ করে যেন রাজ্যজয় করে ফেলেছি, এমন ভাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আহ্লাদি গলায় ডেকে উঠল-“মিয়াও…”
এই আমাদের টুসি। কখন যে তার মাথায় কিসের ভূত চাপবে কেউ জানেনা। এই তো সেদিন, পাশের বাড়ির নতুন ভাড়াটিয়া বেড়াতে এলেন আমাদের বাসায়। তাঁদের দু’বছরের ছোট্ট ছেলেটাকে দেখে যেই না একটু গাল টিপেছি অমনি টুসি এসে হাজির। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে তার সে কি চিৎকার! ছেলেটা তো ভয়ে কেঁদে আকুল। তারপর ওরা চলে গেলে টুসিকে আচ্ছামত বকে দিলাম। সে বকা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে যেন আরেক কান দিয়ে বের করে দিলো, তারপর আদুরে গলায় বলল, ‘মিয়াঁও…”! যেন বলছে, ‘বারে, তুমি ঐ ছোট্ট ছেলেটাকে আদর করবে, আর আমার বুঝি হিংসে হবে না?”
তা আজও ঐ টিভিটাকে ওর হিংসে হল না কি? একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কারণ টিভিটা টুসি তার জন্মের পর থেকেই দেখে আসছে, কোনদিন তো এমন আচরণ করে নাই। টিভির পেছনের দেয়ালে অবশ্য মোটা মোটা দুটো টিকটিকি দেখা যাচ্ছে। টিকটিকির কারণেই টুসির এমন রুদ্রমূর্তি কি না কে জানে! কিন্তু এখন তো আর টুসি রিএক্ট করছে না তবে তখন কেন… ধুত্তোরি, গোল্লায় যাক সব। মাঝখান থেকে এতো ইন্টারেস্টিং নিউজটা মিস হয়ে গেল। কি আর করা, পাশের বাড়িতে আবার খবরের কাগজ রাখে (এই ডিজিটাল যুগে এখনও কিছু অ্যানালগ পাবলিক আছে বৈ কি), ঐ বাসাতে গিয়েই দেশের হাল হকিকত জানতে হল আজ। কাল ঘটে যাওয়া ব্যাঙ্ক ডাকাতির নিউজটা দেখি বড় বড় করে পেপারের হেডিংয়ে এসেছে। একেবারে দিনে দুপুরে ডাকাতি যাকে বলে। গোগ্রাসে গিললাম নিউজটা। কোত্থেকে পুলিশ আবার  এক ডাকাত বাবাজির ছবি পেয়েছে, পেপারে আবার সেটাও ছেপে দিয়েছে। কেন জানি বড্ড চেনা চেনা লাগলো চেহারাটাকে। লোকটাকে যেন কোথায় দেখেছি? ধুর, মনেই পড়ল না। তা না মনে পড়লেই ভালো। আমি বাবা নিরীহ গোবেচারা মানুষ (এভাবে তাকাচ্ছেন কেন, শুনি? পাজি বজ্জাত বেড়ালের মালিক কি নিরীহ গোবেচারা হতে পারে না?), ওসব পুলিশি ঝামেলায় গিয়ে লাভ কি? আমি বাবা যেমন আছি তেমনই ভালো। মাঝারি গোছের একটা রেস্টুরেন্টে চাকরি করছি বছরখানেক (আবারো ভ্রূ কুঁচকাচ্ছেন! দেখুন  রেস্টুরেন্টে ওয়েটার ছাড়া অন্য পদও থাকে, মাইন্ড ইট। আমি ঐ রেস্টুরেন্টের ম্যানেজমেন্ট সেকশনে আছি, বুঝেছেন?)। বাবা- মার ছোট ছেলে। বড় ভাই বিজনেস করে লালে লাল, দিব্বি ঘর-সংসার করছে। মেজ ভাই আবার বিদেশে সেটলড, কেবল আমিই কেমন করে যেন একটু অন্যরকম হয়ে গেলাম। বাবার মতে, আমাকে নিয়ে কোনও আশা নাই। আমার ফুটুরি মানে ফিউচার ঝরঝরে। বড় ভাই প্রায়ই বিজনেসে ঢোকাতে চান, একবার কাজে লেগেওছিলাম কিন্তু প্রথমদিনেই এমন গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেললাম যে… থাক সে কথা। বছর চারেক বেকার ছিলাম। অনেক ঘুরেও যখন কোনও গতি হল না, তখনই হঠাৎ পেপারে এ চাকরিটার বিজ্ঞাপন দেখি। ভাবি শেষ চেষ্টা একটা করে দেখাই যাক। তাতেই যে কেল্লাফতে হয়ে যাবে তা কে জানতো! অবশ্য এর পেছনে টুসির অবদান অত্যধিক। কেননা সেদিন আবার তার ইনজেকশনের ডেট ছিল। বাড়িতে অকর্মার ঢেঁকি বলে পরিচিত হওয়ায় এইসব কাজ আবার এই আমাকেই করতে হয়। কিন্তু আমার ইন্টার্ভিউ এর সময়ও যে পড়েছে একেবারে সেই একই দিনে, সকাল ১১টায়!  বাবাকে মিনমিন করে কথাটা পাড়তেই ধমকানি খেলাম, “ইন্টার্ভিউ মানে? এখন পর্যন্ত একটা ইন্টার্ভিউ দিয়েও তো কোনও চাকরি পেলেন না, ভাইয়ের বিজনেসেও গতি হল না, সুতরাং এখন আর ফটরফটর কইরেন না। আপনি আগে হাসপাতালে যাবেন এবং টুসিকে ইঞ্জেকশন দিয়ে আসবেন, ইন্টার্ভিউ এর কথা পরে ভাববেন। সময় পেলে যাবেন, নইলে চুলোয় যাক আপনার ইন্টার্ভিউ। হতভাগা কোথাকার! জীবনটা শেষ করে দিলো একেবারে!”
তাই কি আর করা। পিতার আদেশমত সকাল সকাল রওনা দিলাম পশু হাসপাতালের উদ্দেশে। ভাবলাম তাড়াতাড়ি ইনজেকশনের পাট চুকিয়ে টুসিকে বাড়ি রেখে ইন্টার্ভিউ দিতে যাব। কিন্তু হাসপাতালে ঢুকে তো আমার আক্কেল গুড়ুম! এই ব্যস্ত শহরেও যে এতো মানুষ বেড়াল পোষে তা তো আমার জানা ছিল না! সাদা বেড়াল, কালো বেড়াল, মোটা বেড়াল, পাতলা বেড়াল, বড় বেড়াল, ছোট বেড়াল, রকমভেদের কি আর শেষ আছে! অনেকক্ষণ বসে রইলাম, তারপর শেষমেষ লজ্জার মাথা খেয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলেই ফেললাম, “ভাই, আমার একটু তাড়া আছে, যদি তাড়াতাড়ি ইনজেকশনটা দিয়ে দিতেন?”
ডাক্তার ভ্রূ কুঁচকে একবার আমার দিকে আরেকবার টুসির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “কাকে?”
উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে ফেলল। কারণটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। ইন্টার্ভিউ আছে বলে বেশ ভালোভাবে ড্রেস আপ করেই তো এসেছি, ক্যাটস আই থেকে সদ্য কেনা শার্ট, হাতে (ভাইয়ার কাছ থেকে ধারে নেয়া) দামি ঘড়ি, পালিশ করা জুতা, আমাকে দেখে তো যে কোনও মেয়েরই হার্টবিট মিস করবার কথা! বোধহয় এ জন্যই ডাক্তারবাবুর আমাকে হিংসে হচ্ছে। তাই এমনটা বলছেন। একটু গর্বই হল নিজেকে নিয়ে। হাসি হাসি মুখ করে তাই সবার দিকে তাকালাম। কিন্তু তাতে সবার হাসির মাত্রা যেন আরও বেড়ে গেল। তারপর হঠাৎ রুমের বাঁ দিকের বেসিনের ওপর যে আয়নাটা আছে, তাতে চোখ পড়ে গেল, দেখতে পেলাম…কি দেখলাম আপনাদের কি ভাবে যে বলি, সকাল বেলায় তাড়াহুড়ো করে বেরোতে গিয়ে শার্ট থেকে “ক্যাটস আই” এর প্রাইস ট্যাগটা খুলতে ভুলে গিয়েছিলাম আর কি…
হাসছেন? হাসুন, প্রাণখুলে হাসুন। মানুষের কাজ তো সেটাই। নিরীহ নিষ্পাপ গোবেচারা মানুষদের হয়রানি দেখতে ভালো লাগে আপনাদের। এদিকে আমার তো তখন শনির দশা, হাতে আছে মাত্র ঘণ্টাখানেক। এরই মধ্যে ইঞ্জেকশন দিয়ে টুসিকে বাড়ি পৌঁছিয়ে অফিসে যাওয়া… সামথিং জাস্ট ইম্পসিবল! তাই কি আর করা, ডাক্তারের হাতে পায়ে ধরে ইনজেকশনের পাট চুকিয়ে টুসি বেচারাকে ভরে ফেললাম ব্যাগটার মধ্যে। হ্যাঁ, যা ভেবেছেন তাই, এ ছাড়া তো আর কোনও উপায় ছিলনা ভাই।ব্যাগের চেনটা আধেক খোলা রাখলাম, ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘বাবা আমার, নড়িস টরিস না আবার। ইলিশ মাছের মাথার দিব্যি, এই একটা ঘণ্টা চুপটি করে বসে থাক। চাকরিটা আমার হয়ে গেলে টুসি শুনছিস, তখন আর কেউ আটকাতে পারবে না, আস্ত একটা ইলিশ মাছ আনবো তোর জন্যে… ঠিক আছে, একটা না দুইটা… না না তিনটা… শব্দ করিস না সোনামণি আমার।” তা আমার টুসিটা বুদ্ধিমান আছে বটে, কি বুঝল কে জানে, গোটা পথে কোনও সাড়াশব্দ করল না। ঠিক সময়েই পৌঁছুলাম রেস্টুরেন্টে। ইন্টার্ভিউ বোর্ডে ঢোকবার ডাক এল। যথারীতি ভাইভা বোর্ডের একটা প্রশ্নের উত্তরও ঠিকঠাক দিতে পারছিলাম না। এমন সময় হঠাৎ পায়ের ওপর দিয়ে সুড়সুড় করে কি যেন একটা হেঁটে চলে গেল। ভড়কে গেলাম। ওরে বাবা, সাপ নয় তো আবার! সশঙ্কিত চিত্তে নিচে তাকিয়েই দেখি… এ যে একটা মস্ত ধেড়ে ইঁদুর! ভয়ে ভয়ে চোখ তুলেই দেখি… টেবিলেও একটা ইঁদুর হাসি হাসি মুখে বসে আছে! এবার আউ বলে লাফিয়ে উঠলাম আমি। এ কেমনতর রেস্টুরেন্ট রে বাপু! “মুরগির বদলে ইঁদুর খাওয়ান নাকি কাস্টমারদের আপনারা?” মুখ ফসকে বলেই ফেললাম আমি। ভাইভা বোর্ডের সভাপতি সাহেব কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “ আরে না না। কি আর বলব, মাসখানেক ধরে এখানে বড্ড ইঁদুরের উৎপাত। না আসছে কাস্টমার, না টিকছে কর্মচারী। ভ্যাকেন্সি কি আর সাধে আছে?”
এদিকে আমি পড়েছি উভয় সংকটে। কি করব বুঝতে পারছি না। ইঁদুরে আমার চরম ঘেন্না। কিন্তু চাকরিটাও যে বড্ড দরকার! আর ঠিক সেই সময়ে একটা হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়ের শব্দ পেলাম। আধা ভয় আধা বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি টুসি ব্যাগ ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। তারপর যে কি হল তা তো বুঝতেই পারছেন। হে হে, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘরের সব ইঁদুর খতম হয়ে গেল।
টুসির এই বীরত্ব দেখে হোটেলের মালিকপক্ষ আমার ওপর বড়ই প্রীত হলেন। আমাকে তাই তাঁরা চাকরিটা দিয়ে দিলেন। এমনকি টুসিকেও পার্মানেন্ট ইঁদুর নিধন কর্মচারীর পদে বহাল করতে রাজি হয়েছিলেন কিন্তু টুসির “ম্যাঁয়ায়াও” প্রতিবাদে তাঁরা আর অগ্রসর হন নি। তবে তারপর থেকে মাঝে মাঝে ইঁদুরের উৎপাত দেখা দিলে পার্ট টাইম সার্ভিস দিয়ে যায় বটে টুসি ইলিশ মাছের বিনিময়ে।
তো এই হল আমার চাকরি পাওয়ার কাহিনী। সেই দিনের পর থেকেই টুসি আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আফটার অল তার জন্যই বাড়িতে আমার অবস্থানটা একটু হলেও উঁচু হয়েছে। তাই সকালের ঐ টিভির ওপর ওর হামলে পড়ার অপরাধটা না হয় মাফই করে দিলাম। আমি আবার অনেক উঁচু মনের মানুষ। কিন্তু টুসি অমনটা করল কেন? টিভিতে ডাকাত বাবাজির ছবি দেখে ওরও চেনা মনে হয়েছিল নাকি? একটু নড়েচড়ে বসলাম। মাথাটা খেলছে মনে হচ্ছে। কোথায় দেখেছি ঐ লোকটাকে? আবার পেপারে মনোযোগ দিলাম। দেখি লেখা আছে, ডাকাতদের খোঁজ দিতে পারলে ব্যাঙ্ক বিশেষ পুরস্কার দেবে! এবার লাফিয়ে উঠলাম আমি। চোখের সামনে ভাসতে লাগলো লাখ লাখ টাকা। আহা! বড় বাড়ি, দামি গাড়ি, আমি, আর… আর… আমার শায়লা! হ্যাঁ, শায়লা। পাশের গলির মাথায় যে বড় ডুপ্লেক্স বাড়িটা আছে, সে বাড়ির একমাত্র মেয়ে। ভার্সিটিতে পড়ে। পড়াশোনাতে যেমন, দেখতেও তেমন। ঠিক যেন আকাশ থেকে নেমে আসা ডানাকাটা পরী। যাকে দেখলে আমার চারপাশে পিয়ানো বাজতে থাকে, হৃদস্পন্দন থেমে যায়, মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়! তাই তো একদিন তাকে সামনে পেয়ে বলেই ফেলেছিলাম, “শায়লা, তুমি আমার লায়লা হবে?” তার উত্তরে মেয়েটা কি বলেছিল জানেন? বলেছিল, “ ভাইয়া, আপনার পকেটতো সবসময় গড়ের মাঠ হয়ে থাকে। ঐ মাঠে গাছ জন্মান, তখন ভেবে দেখব। ততদিন না হয় আমি আপনার বোন হয়েই থাকি!”
কিন্তু এবার তোমাকে ভাবতেই হবে শায়লা! আমি ভাবিয়ে ছাড়বো! ঐ ডাকাত দলকে ধরিয়ে দিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে পুরষ্কার নিয়ে সোজা তোমার  বাড়ির সামনে হাজির হব শায়লা…
“কি ব্যাপার আনন্দ, আজ অফিস নেই?” পাশের বাসার ভাবির কথায় সম্বিত ফিরল। এতক্ষণ ধরে যে তাঁদের বাসাতেই পড়ে পড়ে পেপার পড়ছি খেয়াল ছিল না। ভাবি চা নিয়ে এসেছেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, “আজ আমার অফ ডে, ভাবি।”
“হুম। খুব বড় ডাকাতি হয়ে গেল, তাই না?” পেপারের দিকে তাকিয়ে বললেন ভাবি, “আমার ছোট বোন, নাজিয়া তো তখন ঐ ব্যাঙ্কেই ছিল!”
“কি?” তাকালাম ভাবির দিকে। “বলেন কি? তাই ?”
“হ্যাঁ।” ভাবি বললেন, “বেচারি। ভয়ে আমার বোনটা একেবারে শুকিয়ে গেছে।এত সুন্দর মেয়ে দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া ভার। কালকে সারাদিন পুলিশ, সাক্ষ্য দেয়া, এটা সেটা… বেচারার চেহারা একদম কালো হয়ে গেছে।তাই তো ওকে আজ বাসায় ডাকলাম।দুই বোনে খানিকটা সময় কাটালে হয়তো ভালো লাগবে ওর। দেখেছো তো ওকে তুমি আগেও। এই তো সেদিন, অয়নের বার্থডেতে তো এ বাড়ি এসেছিলো ও, তোমার মনে নেই?”
ভাবির মতিগতি ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছে না। আলাপটা কোনদিকে যাচ্ছে আঁচ করার চেষ্টা করলাম। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। ভাবি দরজা খুললে ভেতরে ঢুকল দীর্ঘাঙ্গি এক তরুণী। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, লম্বা চুল, কপালে নীল টিপ আর পরনে নীল সিল্কের শাড়ি। এই তাহলে নাজিয়া! কিন্তু দেখে তো একদম ফ্রেশ লাগছে। কালকের ঘটনা কোনও প্রভাবই ফেলেনি মনে হচ্ছে। যে সাজগোজ করেছে, বাব্বা। শ্রাগ করলাম আমি।
ভাবি বলল, “এই যে দেখ, নাজিয়া চলে এসেছে। হায় খোদা, এ কি হাল হয়েছে তোর চেহারার! দেখছ আনন্দ আমার এ বোন দেখতে একদম ঐশ্বরিয়ার মত ছিল, একদিনে সে যে একেবারে *** হয়ে গেছে! হায় হায়, এখন কি হবে!”
কি আর হবে! ঐশ্বরিয়াও নায়িকা, ***ও নায়িকা… পার্থক্যটা কোথায় হল সেটা তো বুঝলাম না… মনে মনে ভাবলাম আমি।
“আহ আপু, এ কি শুরু করলে? থামো তো!” নাজিয়া মেয়েটা মিষ্টি কণ্ঠের রিনিঝিনি তুলল ঘরে। “বুঝলেন আনন্দ, আপু আমাকে নিয়ে সবসময় একটু বেশিই চিন্তা করে। তাই তো এতো… আপনি কিছু মনে করেন না যেন… ”
“মনে করবার কি আছে?” ভাবি বললেন, “একটা মাত্র বোন আমার, চিন্তা হবে না বল? তার ওপর উনি গোঁ ধরে বসেছেন, বিয়ে করবেন না। এখন তুমিই ওকে একটু বুঝাও তো আনন্দ।”
শেষের “তুমি” কথাটা যেন একটু জোর দিয়েই বললেন ভাবি। এ কি মুসিবত! ভাবি কি তাহলে…
“কিন্তু আপনিই বলুন” নাজিয়া আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কি করব, যদি এখন পর্যন্ত এমন কাউকে না পাই যাকে বিয়ে করা যায়… আপনার কি মনে হয়, এমন কেউ কি আছে আপনার জানাশোনা? আপনার মত দেখতে শুনতে হলেই হবে, আছে কি কেউ?”
এই রে! বুঝতে পারলাম, অবস্থা বেগতিক। ভাবি তো দেখি আমার সাথে নাজিয়ার ইয়ে করানোর পাঁয়তারা কষছেন! সুতরাং হঠাৎ একটা কাজ মনে পড়ে গিয়েছে এমন ভাব করে উঠে দাঁড়ালাম।“ভাবি, হঠাৎ একটা কাজ মনে পড়ে গেল, আমি এখন যাই।”বলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। পেছনে মিষ্টি কণ্ঠের রিনিঝিনি বেজে উঠলো, “আবার আসবেন কিন্তু…”
এই কথা শুনে ভয় আরও বেড়ে গেল, নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকবো কি, এক দৌড়ে নীচে নেমে এলাম। এতক্ষণে দম ফেলবার সুযোগ পেলাম। বাব্বা! ঐ ভাবির কাছ থেকে আমার একশ হাত দূরে থাকতে হবে! আর ঐ মেয়ের কাছ থেকে তো ১০০০ হাত! কোথায় এখন আমার শায়লাকে নিয়ে ভাববার কথা, মাঝখান দিয়ে এই নাজিয়া এসে হাজির! ঝামেলার শেষ নেই। এমন সময় “ম্যাঁও” ডাক শুনে দেখি টুসি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমি হাঁটু গেঁড়ে বসে ওকে বললাম, “কি রে টুসি, টিভির ঐ ডাকাতটাকে কি তুই চিনিস? বল না, কোথায় দেখেছিস?” টুসি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যাঁও!” আমিও যা! টুসি কি আর আমাকে বলতে পারবে, ও কি বাংলা ভাষা জানে! তার চেয়ে বরং ঐ ডাকাতি হওয়া ব্যাঙ্কটাতে যাওয়া যাক। দেখি কোনও ক্লু মেলে কি না।
ব্যাঙ্কের সামনে গিয়ে দেখি পুলিশের ভিড়। একটু কাছে যেতেই এক কনস্টেবল চোখ পাকালেন, “কি চাই? কি কাজে এসেছেন?”
“আমি, মানে…”
‘আপনি কি টাকা তুলতে এসেছেন?”
“না, মানে…”
“তাহলে কি টাকা জমা দিতে এসেছেন?”
“না, মানে…”
“তাহলে কি নতুন একাউন্ট খুলতে এসেছেন?”
“না, মানে…”
“তাহলে কি ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে এসেছেন?” এবার খেঁকিয়ে উঠলো কনস্টেবলটা।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “হ্যাঁ, মানে ঐ ডাকাতির ব্যাপারে…”
সুতরাং সন্দেহজনক ঘোরাঘুরির অপরাধে আমি সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়ে গেলাম! কি করতে এসেছিলাম, আর কি হয়ে গেল! এখন কি তবে আমাকে জেলের ভাত খেতে হবে? শুনেছি পুলিশে ছুঁলে নাকি আঠারো ঘা। আমার কথা কে বিশ্বাস করবে যে আমি এখানে ক্লু খুঁজতে এসেছিলাম? বাবা ঠিকই বলেন, আমি একটা অকর্মার ঢেঁকি, গাধার মাথা, তেলাপোকার ডিম। আমার দ্বারা গোয়েন্দাগিরি? ভুলে যাও, আনন্দ, ভুলে যাও।সারাজীবন জেলের ঘানি টানার জন্য তৈরি হও।  এখন তোমার না হবে গাড়ি, না হবে বাড়ি, না হবে শায়লা, না হবে নাজিয়া…
“হ্যাঁ, নাজিয়াই নাম মেয়েটার।” একজন মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, “ঐ নাজিয়া মেয়েটার জন্যই তো এতো গ্যাঞ্জাম হল।”
তাকালাম মহিলার দিকে। পুলিশ আমাকে জিপে বসিয়ে রেখেছে। মহিলাও আমার পাশে দাঁড়িয়েই পুলিশের সাথে কথা বলছেন। কনস্টেবলটা বলে উঠলো, “দাঁড়ান, স্যারকে ডেকে আনি…” বলে ব্যাঙ্কের দিকে ছুট লাগাল। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে মহিলাকে দেখতে লাগলাম। দেখবার মতই মহিলা বটে। যেন আস্ত এক হাতি। জীবনে কোনদিন সামনাসামনি হাতি দেখিনি, আজ সে ইচ্ছে পূর্ণ হল। বুঝতে পারি না, মানুষ কি করে এতো মোটা হতে পারে? আদনান সামিও তো দেখি এর কাছে হার মানবেন! এনার দৈনিক খাদ্য তালিকা কি হতে পারে মনে মনে হিসাব করতে লাগলাম। এমন সময় চীফ ইনস্পেকটর (হাবে ভাবে তাই মনে হল) এসে হাজির হলেন। ভুরু কুঁচকে মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি বলবেন বলুন…”
“সে তো বলবই” মহিলা বললেন, “কিন্তু কতক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে আছি, একটু বসতে টসতে দিন!”
একটু বিরক্তই হলেন চীফ। তারপর কনস্টেবলকে একটা চেয়ার আনার নির্দেশ দিলেন। মহিলা যখন চেয়ারের ওপর বসলেন তখন চেয়ারটার দুরবস্থার কথা ভেবে এই হ্যান্ডকাপ পরা অবস্থায়ও ভীষণ হাসি পেল আমার।
মহিলা বলতে থাকলেন, “আর বলবেন না ইন্সপেক্টর। ঐ নাজিয়া মেয়েটা যে কি সাংঘাতিক, কি বলব! ভাবতেই গায়ে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে। কাল সারাদিন ভেবেছি, তারপর বুঝেছি, সবকিছুর জন্য আসলে ঐ মেয়েটাই দায়ী।” বলে এমন জোরে পুলিশের জিপের ওপর থাবা মারলেন যে ঠনঠন করে শব্দ উঠলো।
একবার শঙ্কিত চিত্তে জিপটার দিকে তাকিয়ে চীফ বললেন, “কেন, ঐ মেয়ে কি করেছিল?”
“কি করেনি তাই বলুন?” মহিলা বলতে থাকলেন, “আরে, আমরাও তো ঐ বয়স পার করে এসেছি, কিন্তু তখন আমরা এমন করবার সাহস পেতাম বলুন?আজকালকার ছেলেমেয়েরা সব গোল্লায় গেছে ইন্সপেক্টর সাহেব। নইলে কি…”
চীফ এবার বিরক্ত হয়ে বললেন, “সোজাসুজি বলবেন? এতো ঘুরপাক খাচ্ছেন কেন?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মহিলা। “ সোজাসুজিই বলছি। আমি বাবা পেঁচিয়ে কোনও কথা বলতে পারি না। কখনও বলেছি বলুন? বলিনি। তা আপনিই বা জানবেন কি করে। আপনি তো আর আমাকে আগে দেখেননি। দেখলে বুঝতেন, আমি কত কম কথার মানুষ। আমি মুখ খুব কমই খুলি। কথা বলার জন্যই হোক বা খাওয়ার জন্যই হোক। মেয়েদের মুখ বন্ধ থাকাই ভালো। কিন্তু সবাই কি আর আমার মতন হয়! কাল তো দেখলামই… ঐ নাজিয়াকে… আমি কাল আমার ওনাকে নিয়ে ব্যাঙ্কে এসেছিলাম, টাকা তুলতে। তা ভিড় খানিকটা কমই ছিল। আমার উনি গেলেন টাকা তুলতে। আর আমি বসলাম চেয়ারে…”
আমি মনে মনে ভাবলাম, ‘একটাতেই বসলেন নাকি দুটো চেয়ার লেগেছিল বসতে?”
এদিকে মহিলা বলেই চলেছেন, “এমন সময় ব্যাঙ্কের দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল। তাকিয়ে দেখি ঐ হতচ্ছাড়া পাজি মেয়েটা- মানে নাজিয়া মেয়েটা ঢুকল ঘরে। লম্বা, ছিপছিপে, লেয়ার কাট চুল, স্লিভলেস ব্লাউজ আর পাতলা ফিনফিনে শাড়ি, কানে ময়ূরকণ্ঠী দুল, কপালে সবুজ টিপ… আর কি বলব, নিজেকে যেন বলিউডের নায়িকা মনে করে ঐ মেয়ে! হুহ, ঢং দেখে বাঁচি না!  আর ঢং দেখাবি ভালো কথা, ব্যাঙ্কে আসবি সেটাও ভালো কথা, তাই বলে ঠিক আমার উনার পাশেই দাঁড়াবার কি দরকার ছিল? না, ঐ মেয়ে কি না আমার উনার পাশেই দাঁড়ালো, আর ন্যাকা ন্যাকা কণ্ঠে ক্যাশিয়ারকে বলল, “আমার নাম নাজিয়া আহমেদ, একাউন্ট নাম্বার অমুক, একটু দেখুন না কত ব্যালেন্স আছে…” হুহ, ন্যাকা! শুধু কি তাই! চেক লিখবার জন্য একটা কলমও নাকি ওর কাছে ছিল না! আমার বরের কাছ থেকেই কলম চেয়ে বসল ঐ ছুঁড়ি… যতবার ভাবছি, ততবারই রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে! একবার যদি পাই মেয়েটাকে, তাহলে আমি…” ঠাশ করে একটা মশা মারলেন মহিলাটা। “বুঝলেন?”
চীফ এবার কড়া চোখে মহিলার দিকে তাকালেন, “যা বলবার তাড়াতাড়ি বলুন। এসব মেয়েলি কাসুন্দি শোনার টাইম নাই। নাজিয়া মেয়েটার সাথে ডাকাতির কি সম্পর্ক সেইটা বলুন। আপনার অঢেল সময় কিন্তু আমাদের নয়।”
এবার মহিলা হাসলেন, “কি যে বলেন ইন্সপেক্টর সাহেব, তা কি আর জানিনা? তাড়াতাড়িই বলছি, আর একটুখানি আছে, আমি আবার খুব কম কথা বলি কি না…”
আমি একটা হাই তুললাম। মহিলার কথা শুনতে শুনতে এই সকাল ১১টার সময়ও আমার ঘুম পেয়ে গেছে। অনেক কষ্টে ঘুম চেপে মহিলার কথা শুনতে লাগলাম, “ তারপর কি হল তো বুঝতেই পারছেন! না জানি, মেয়েটার গলায় কি জাদু ছিল, ব্যাঙ্কের সবক’টা অফিসারের চোখ থেকে থেকে ঐ নাজিয়ার দিকে। সবাই খানিক কাজ করে তো খানিক মেয়েটার দিকে তাকায়। আর মেয়েটাও যা বলিহারি! আরে, তুই এসেছিস টাকা তুলতে, তো এতো রঙ ঢং করবার কি দরকার শুনি? এই যে দেখছেন…” হাতের দুটো পাথরের আংটি দেখালেন মহিলা, “এ দুটো আংটি পরেছিলাম জ্যোতিষীর পরামর্শে। স্বামী বশে রাখতে সাহায্য করবে বলে। বিয়ের তো আর কম বছর হল না, বেশি বয়সে আবার ছেলেমানুষের বাহাত্তুরে রোগ ধরে কি না… তাই একটু সাবধানতা আর কি… ভালোই চলছিল সব, কিন্তু কালকের পর থেকে সব কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। থেকে থেকে সে শুধু ঐ মেয়েটার কথাই বলছে, ‘আহারে মেয়েটা কত ভয় পেয়ে গিয়েছিল! আহারে মেয়েটা!’ এমনকি ডাকাতি চলাকালীন সময়ও ও আমার পাশে দাঁড়াবে কি, মেয়েটাকে সান্তনা দিচ্ছিল, বলছিল, “ভয় পাবেন না…”” ফুপিয়ে উঠলেন মহিলা।
চীফ এবার অস্থির হয়ে উঠলেন, “কিন্তু তার সাথে ডাকাতির কি সম্পর্ক?”
“ওমা। এটাও বুঝলেন না!” মহিলা ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বলতে থাকলেন, “ঐ মেয়ে যে জাদু করেছিল সবাইকে। তাইতো এতো বড় ডাকাতি হয়ে গেল কেউ বাধা দিতে পারল না…”
“ডিসগাসটিং!” চেঁচিয়ে উঠলেন চীফ। কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই তোমার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী? মাই ফুট! আর… এটা কে?” এতক্ষণে আমার দিকে চোখ পড়েছে চিফের।
“সন্দেহজনকভাবে ঘুরাফেরা করছিল স্যার।” কনস্টেবল উত্তর দিলো।
“তাই নাকি?” আমার কাছে এসে চোখ নাচালেন চীফ, “তা চান্দুর নামটা কি জানতে পারি?”
ঢোক গিলে বললাম, “আ… আনন্দ।”
“তা আনন্দ সাহেব, আপনি এই নিরানন্দের মধ্যে কি করিতে আসিয়াছেন?”
একটু সাহস করে বলেই ফেললাম, “ক্লু খুঁজতে।”
কে জানে, আমার কথার মধ্যে কি ছিল, চীফ সঙ্গে সঙ্গে আমার হ্যান্ডকাপ খুলে দিলেন, বললেন, “ছি ছি কি কাণ্ড দেখুন তো। আগে বলবেন না যে আপনি সি আই ডির আনন্দ চৌধুরী! দেখুন তো, খামোকা আপনাকে হ্যারাস করল ওরা… আসুন আসুন, ব্যাঙ্কের ভেতরে আসুন। কিন্তু আপনার তো বিকেলে আসার কথা ছিল, এখন আপনি…”
আমার মাথা বোঁ বোঁ করছে। এনাকে কি করে বলি, আমি আনন্দ চৌধুরী নই, বরং এহসানুল কিবরিয়া আনন্দ। একে তো আমার ভালো নামটা অনেকটা দাদা-নানাদের নামের মত, কাউকে বললেই চোখ বড় বড় করে তাকায়, আর এখানে নামটা বললে নির্ঘাত কেস খেতে হবে! পুলিসে ছুঁলে আঠারো ঘা- ভালভাবেই জানি আমি। মিথ্যাভাষণের অপরাধে আবার কেস টেস হয়ে যায় কি না কে জানে! ভয়ে ভয়ে মিথ্যে কথাটা তাই বলেই ফেললাম, “না মানে,সকালেই চলে এলাম।” ক্লু খুঁজতে এসেছিলাম, সুযোগও পেয়েছি, দেখিই না, যদি পুরষ্কারটা আমিই পেয়ে যাই?
ইন্সপেক্টর ততক্ষণে ব্যাঙ্কের ভেতরে নিয়ে গেছেন। হাবেভাবে বোঝা গেল এটাই ব্যাঙ্কটার মেইন ব্রাঞ্চ। ঢুকতেই বেশ বড় বসবার জায়গা, সামনে কাউন্টার, দূরে ম্যানেজারের অফিস দেখা যাচ্ছে, কাঁচ দিয়ে ঘেরা। ঘোরানো একটা সিঁড়ি চলে গেছে ওপর তলায়। কর্মব্যস্ত থাকার বদলে খুব থমথম করছে জায়গাটা। তেমনটাই স্বাভাবিক। ক্লায়েন্ট নেই কোনও। অফিসাররা সন্ত্রস্ত মুখে বসে আছে যার যার সিটে। চিফের দিকে তাকালাম আমি। “সব ঘটনা সংক্ষেপে আরেকটিবার বলুন তো।”
“কাল বেলা বারোটার ঘটনা। এই ধরুন জনা দশেক ক্লায়েন্ট ছিলেন এইখানে। হঠাৎ ব্যাঙ্কের সামনে একটা হলুদ ট্যাক্সিক্যাব এসে থামে। দুজন লোক নামে। ক্যাজুয়াল পোশাক পড়া, একজন মধ্যবয়স্ক, আরেকজন অপেক্ষাকৃত তরুণ। ওরা এসে বলে নাকি ভারি এমাউন্ট উইথড্র করতে চায়। ব্যাঙ্কের নিয়ম তো জানেনই, বড় ট্রানজেকশনের জন্য  আগে ম্যানেজারের সাথে আলাপ করতে হয়। লোক দুটো ম্যানেজারের ঘরে ঢোকে আর অভিয়াসলি, রিভলবারের মুখে জিম্মি করে ম্যানেজার সাহেবকে। তারপর তো বুঝতেই পারছেন। কাকে যেন মোবাইল করতেই ব্যাঙ্কের সামনে আরেকটা গাড়ি এসে থামে। নামে ওদেরই মুখোশধারী আরও কয়েকটা লোক। তারপর যা হয় আর কি… ওরা এল, দেখল আর লুট করল।কেউ বাধা দেয়ার চেষ্টা করেনি। জানের মায়া কার নেই বলুন?”
আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম, “কিন্তু বাইরে থেকে কেউ সাহায্যের জন্য আসেনি?”
“কে আসবে শুনি?” চীফ হাত নাড়লেন। “সবকিছু ওয়েল প্ল্যানড ছিল। এতো আচমকা লোকগুলো ঢুকেছে যে বাইরে থেকে কেউ বুঝতেই পারেনি কি চলছে ভেতরে। আর বুঝলেও হয়তো কেউ রা কাড়েনি। আরে ভাই এটা কলিযুগ। কেউ কারো নয় এই দুনিয়াতে। নিজের প্রাণ বাঁচানো বাদ দিয়ে কে ব্যাঙ্ক বাঁচাতে আসবে বলুন?”
“আপনাদের এখানে সিকিউরিটির লোক নেই?” ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলাম।
“আলবাত আছে।” পাশে দাঁড়ানো ম্যানেজার বললেন।“এন্ট্রান্সে সিকিউরিটি গার্ড আছে দুজন। চেক না করে কাউকে ঢুকতে না দেয়ার কঠোর নির্দেশ আছে। মেটাল ডিটেক্টর এড়িয়ে কারো ঢোকার সাধ্যিটি নেই।”
“তাহলে? ওরা লোক দুটোর কাছে রিভলবার পায়নি?”
“ঢোকবার সময় সার্চ তো করেছিল। কিন্তু পায়নি নাকি কিছু!” ম্যানেজার আমতা আমতা করে বললেন।
“হোয়াট রাবিশ! কিছু পায়নি বললেই হল! ওদেরকে থানায় নেয়া হয়েছে আনন্দ। পিঠে কয়েক ঘা পড়লেই গড়গড় করে সব বলে ফেলবে।” চীফ বললেন। “যাই হোক, কিছু খাবেন নাকি? আমার তো আবার সকাল থেকে কিছু পেটে পড়েনি। এই যে ম্যানেজার সাহেব, আপনার পিয়নকে বলে গরম গরম সিঙ্গারা আনান তো কয়েকটা। একটু উদর পূর্তি করি!”
ডিউটিতে থাকলে পুলিশের খাওয়াদাওয়া বারণ জানতাম। ভুল জানতাম বুঝি। যাই হোক আমার আর কি। আমি তো আর সত্যিকারের সি আই ডি নই। আমার খেলেই কি আর না খেলেই কি। এদিকে চীফ বলে চলেছেন, “ক্লুয়ের খোঁজে এসেছেন তো। আসলে এখানে ক্লুয়ের কিছু নাই। জিজ্ঞাসাবাদ কিছু কাল করা হয়েছে, এখনও চলছে। তবে তেমন কোনও উপকারে আসেনি। উপকার বলতে একজনই উপকার করেছে-ম্যানেজার সাহেব। একজন ডাকাতের ছবি তুলে নিয়েছিলেন মোবাইলে, সবার অলক্ষ্যে। ছবিটা সব থানায় পাঠিয়ে দিয়েছি, ক’দিনের মধ্যেই ধরা পড়ে যাবে ব্যাটা।”
“ওরা না মুখোশ পড়ে এসেছিলো বললেন?”
“না মানে পরের ডাকাতগুলো ব্যাঙ্কে ঢুকেই এক ঝটকায় মুখোশ পরে ফেলেছিল, কিন্তু প্রথম যে দুজন ঢুকেছিল, মানে ঐ যে যারা ম্যানেজারকে জিম্মি করেছিল, তাদের মুখে মুখোশ ছিল না।”
“কিন্তু…” টিভিতে দেখা গোয়েন্দা সিরিয়ালগুলোর কথা মনে পড়ে গেল আমার, “ মোবাইলে ছবি তোলার কি দরকার ছিল? সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই তো হয়!”
একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন ম্যানেজার। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বললেন,গত পরশু একটা টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো সব অকেজো হয়ে গেছে। মানে… কাজ চলছে… ক’দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।”
“এই জন্যই বলছি গার্ডগুলোর হাত আছে আনন্দ। নইলে ক্যামেরা নষ্টের পরের দিনেই কেন ডাকাতিটা হবে বলুন?” আমার দিকে তাকালেন চীফ।
“ক্লায়েন্টদের কেউ জড়িত না তো? পরিচয় তো নিয়েছেন সবার, না?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“আরে, এতো তাড়াহুড়ো করছেন কেন? সবে তো এলেন।” চীফ বললেন, “আস্তে আস্তে সব জানা যাবে খন। এই তো, সিঙ্গারা এসে গেছে। খান তো।”
হায়, চীফ কি করে জানবেন যে আমি আস্তে আস্তে কাজ করতে পারব না। একে তো মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ব্যাঙ্কে ঢুকেছি, তার ওপর এখন পর্যন্ত জীবনে যা কিছু করেছি তাতেই কোনও না কোনও গুবলেট পাকিয়েছি। এতক্ষণ যেসব প্রশ্ন আউড়ে গেলাম, তাও রহস্য গল্প –উপন্যাস-সিনেমা থেকে মারিং কাটিং করা প্রশ্ন। কিন্তু এখানে তো কোনও ক্লুই পাচ্ছি না। খুবই সাদামাটাভাবে আর সতর্কতার সাথে ডাকাতিটা করা হয়েছে। আমার মত অকর্মার পক্ষে এর নিস্তার করা সম্ভব না। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটা খুঁতখুঁতানি লাগছে। পেপারের ছবিটাকে কোথায় যেন দেখেছি আমি। তার ওপর নাজিয়া সম্পর্কে ঐ মহিলা যা বললেন… কোথায় যেন একটা গ্যাঞ্জাম আছে। বুঝতে পারছি, কিন্তু ধরতে পারছি না। সাধে কি আমাকে সবাই অকর্মার ঢেঁকি বলে!
সিঙ্গারায় একটা কামড় দিলাম। হুম, ভালোই খেতে। ইন্সপেক্টর হাতে একটা কাগজ দিলেন। সেখানে লেখা কালকে কারা কারা উপস্থিত ছিলেন। ক্লায়েন্ট বলতে দুটো দম্পতি, নাজিয়া,একজন বৃদ্ধা, আর চারজন ভদ্রলোক। আর ব্যাঙ্কের অফিসাররা তো ছিলেনই। নাহ, তেমন একটা কাজের কোনও ক্লু পেলাম না এখানে। উঠে দাঁড়ালাম আমি। “আসি তাহলে চীফ। পরে দেখা হবে।” বলে বেরিয়ে এলাম। ধুর। এখানে এসে কিছু লাভই হল না। এমনকি আমার লাভ আই মিন শায়লার জন্য রাজপ্রাসাদ তৈরির সুখস্বপ্নটাও জলে গেল।
ব্যথিত চিত্তে বাড়িতে ফিরে এলাম। কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দিলো মা। “কি রে, আজ না তোর ডে অফ? কোথায় গিয়েছিলি?”
“এইতো, একটা কাজ ছিল।”
“কাজ ছিল, নাকি অকাজ ছিল? কাজের কাজ কি কোনদিন করেছিস তুই?” পাশের ঘর থেকে বাবার খ্যাঁকখ্যাঁক শোনা গেল।
সত্যিই তো। ঠিকই বলেছে বাবা। কাজ কি কোনদিন করেছি আমি? জীবনে তো সবকিছুতেই ভজঘট পাকিয়েছি। আজকেও যেমন ডাকাত ধরার প্ল্যানটা একেবারে জলে চলে গেল। খামোকাই গিয়েছিলাম ওখানে, মাতব্বরি ফলাতে। সিঙ্গারাটা ছাড়া লাভের লাভ কিছুই হলনা। কিন্তু এমনটা যদি না হত! যদি সত্যি আমি কোনও ক্লু পেয়ে ডাকাতটাকে ধরিয়ে দিতে পারতাম! “আহা! তাহলে শায়লাকে নিয়ে প্রতিদিন সিঙ্গারা… না না না, চটপটি খাওয়াতাম। শায়লা চটপটি খেতে খুব ভালবাসে। তাই না টুসি?” টুসির লোমশ গায়ে হাত বুলালাম আমি।
তখনই ও বলে উঠলো, “ম্যাঁ আ আ আ ও…”
কি রে বাবা, টুসি হঠাৎ তারস্বরে ম্যাও করছে কেন? ওরও কি চটপটি খেতে ইচ্ছে করছে নাকি? দাঁড়ান দাঁড়ান… চটপটি… চটপটি… রাইট! চটপটি! চটপটিই তো! এবার মনে পড়ে গেছে আমার, ঠিক ঠিক মনে পড়ে গেছে! কাগজের ছবিটা তো আমাদের গলির পুরনো চটপটিওয়ালার! হ্যাঁ, ঐ চটপটিওয়ালাই, কোনও সন্দেহ নাই। ওর সামনে দাঁড়িয়েই তো কতবার শায়লাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থেকেছি! চটপটিওয়ালাটা অবশ্য দেখতে শুনতে তেমন সুবিধার ছিল না। কেমন যেন গুন্ডা গুন্ডা ভাব ছিল চেহারায়। একদম “শোলে” সিনেমার আমজাদ খানের মত। টুসি তো তাকে দু চোখে দেখতে পারত না। দেখতে পেলেই “ম্যাঁ আ আ ও” বলে তেড়ে যেতো। এবার বুঝেছি, টিভিতে ওকে দেখতে পেয়েই টুসি সকালে অমন তেরিয়া হয়ে উঠেছিল। ডাকাতিতে তাহলে ঐ চটপটিওয়ালারই হাত আছে! আর দাঁড়ালাম না। এক দৌড়ে পাশের বাসার কলিংবেল টিপলাম। দরজা খুলল নাজিয়া। লাজুক হেসে বলল, “আমি জানতাম, আপনি আবারো আসবেন। সকালে তো ঠিক মত কথাই হল না। আসুন না, ভেতরে আসুন… ” আমার কি আর এসব আদিখ্যেতার সময় আছে? ড্রইংরুমে গিয়ে এক ঝটকায় পেপারটা তুলে নিলাম। হ্যাঁ, কোনও সন্দেহ নেই, এটা সেই চটপটিওয়ালারই ছবি। ‘পেপারটা একটু ধার নিলাম, বুঝছেন?” বলে এক ছুটে বেরিয়ে এলাম বাসা থেকে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে শুনতে পেলাম নাজিয়ার রিনিঝিনি গলা, “ওমা, কোথায় চললেন, একটু শুনে যান…”
আমার তখন কিছু শুনবার অবস্থা নেই। শায়লাদের বাড়ির সামনে, চটপটিওয়ালা যেখানে নিয়মিত দাঁড়ায়, সেইখানে গিয়ে হাজির হলাম। যা ভেবেছিলাম তাই, আজ সে নেই। কিন্তু এখন তাকে কোথায় খুঁজে পাই? পাশের চায়ের দোকানে বিড়ি ফুঁকছিল এক স্থানীয় রিকশাওলা। আমাকে ইতিউতি তাকাতে দেখে বলে উঠলো, ‘যাবেন নাকি?”
আমি বিড়বিড় করে বললাম, “কোথায় আর যাবো। আমি তো খুঁজছি চটপটিওয়ালাকে। তার ঠিকানা তো জানা নেই।”
“সুলতান ভাই তো আর এখানে বসে না সা’ব” চায়ের দোকানি দোকান থেকে মাথা বের করে বলল।
অ্যাঁ, বলে কি! আমি দোকানির দিকে তাকালাম। “আপনি চেনেন ওকে?”
“চিনব না মানে! একসাথে একই জায়গায় রুজি আমগো… ও তো এখন বসে… ”
আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লাম আমি, “নিশ্চয়ই একটা ব্যাঙ্কের সামনে বসে। তাই না?”
“হ। ক্যামনে জানলেন?”
এবার সব পরিস্কার হয়ে আসছে। চটপটিওয়ালা ব্যাঙ্কের সামনে চটপটি বেচতে বেচতেই ডাকাতির প্ল্যানটা করেছে। বোধহয় আগে থেকেই গুণ্ডাপাণ্ডাদের সাথে ওর ওঠাবসা ছিল। কিন্তু সবকিছু আবার গুবলেট পাকিয়ে গেল দোকানির কোথায়, “আল্লায় যেন তারে বেহেশত নসিব করে”
“বেহেশত?” আমি প্রশ্ন করলাম, “এমন করে বলছেন যেন মারা গেছে ও!”
“মারাই তো গ্যাছে!” দোকানি বলল। “গত পরশু ভোর সাতটাতে মারা গ্যাছে। জ্বর হইছিল। চিকিৎসা করার ক্ষেমতা ছিল না, বোঝেনই তো। লোক বহুত ভালা আছিল। আমগো বস্তিতেই থাকত। নিজের হাতে কবর দিছি ঐ দিন। মনটা খুব খারাপ হইছিল, জানেন ভাই? আল্লায় যেন তারে বেহেশতে নেয়।”
এ আবার কি বলছে দোকানি! চটপটিওয়ালা যদি গত পরশু মারা গিয়ে থাকে, তাহলে কালকে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করল কে? ঝটপট দোকানিকে পেপারটা দেখিয়ে বললাম, “দেখুন তো, এটাই সেই চটপটিওয়ালার ছবি না?”
“হ, এইটাই তো!” উত্তেজিত কণ্ঠে বলল দোকানি। “কি লেখা আছে ভাই কাগজে? সুলতান ভায়ের মারা যাওয়ার খবর? এ সব নিশ্চয়ই ঐ সাহেবের কাজ। যে সাহেব সুলতান ভাইয়ের ফটো তুলছিলেন।”
“ফটো?” ভ্রূ কুঁচকে গেল আমার, “কিসের ফটো?”
“হ, ফটো। ভাইয়ের মুখে শুনছি। ব্যাঙ্কের একটা সাব, উনার কাছে নিয়ম করে চটপটি খাইতেন। তো একদিন সখ করে সুলতান ভাইয়ের ছবি তুলছিলেন। উনার আবার নাকি খুব ছবি তোলার সখ। সব্বার ছবি তুলে বেড়ান। তা সুলতান ভাইয়েরও তুলছিলেন। খুব ভালা মানুষ। নইলে অত বড়লোক মানুষ কি আর আমগো মত রাস্তার মানুষের ছবি তোলে?”
মাথায় সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে আমার। দোকানি কি তাহলে ম্যানেজার সাহেবের কথা বলছে? সত্যি কথা বলছে বলেই তো মনে হল। তারমানে ম্যানেজার সাহেব পুলিশকে ডাকাতের ছবির বদলে চটপটিওয়ালার ছবি দিয়েছে কিন্তু কেন? মনে হয় ভুল করে দিয়ে দিয়েছে। এখনই তো তাহলে পুলিশকে জানানো দরকার। ভুলটা ভাঙ্গাতে হবে তো! চটজলদি বিড়ি খাওয়া রিকশাওলার রিক্সায় উঠে বসলাম। বললাম, “ঐ ব্যাঙ্কে চল তাড়াতাড়ি। সামনের মোড় ঘুরে ডানদিকে।”
হঠাৎ পায়ে একটা লোমশ স্পর্শ পেলাম। দেখি টুসিও কোন ফাঁকে রিকশাতে উঠে বসেছে। থাক। কি আর করা। ওকে দুহাতে চেপে কোলে তুললাম। রাস্তায় অনেকেই অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতে থাকল। অনেকটা টুসিকে ইঞ্জেকশন দেয়া সেই ডাক্তারটার মত।
ব্যাঙ্কে পৌঁছে লাফিয়ে নামলাম রিকশা থেকে। ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকতেই চীফ এসে হ্যান্ডসেক করলেন, “আসুন আনন্দ, গরম খবর। এখনই খবর পেলাম, ছবিটা একজন চটপটিওয়ালার। আমরা তাকে এখনই খুঁজতে যাচ্ছি। আপনিও আসবেন কি?”
“তাহলে তো আপনাকে কবরখানায় যেতে হবে।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি বললাম, “ওই লোক এখন কবরে। গত পরশু সকালবেলায় দেহত্যাগ করেছে। পাক্কা খবর নিয়ে আসছি।”
“এ কি বলছেন আপনি?” ম্যানেজার এগিয়ে এলেন, ‘তা কি করে হয়? আমি নিজের চোখে কাল ওকে ডাকাতি করতে দেখলাম!”
“আপনি দেখেছেন। কিন্তু অন্যরা?” আমি আর সবার দিকে তাকালাম।“ইন্সপেক্টর সাহেব, আপনি ছবিটা সত্যিই ওই ডাকাতটার কিনা তা আর সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখেননি?”
“ওইটাই তো সমস্যা, আনন্দ।” চীফ হাত নাড়লেন। “কাল ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই শকড। কেউ ঠিকমত চেহারাটা মনেই করতে পারছে না আমাদের ম্যানেজার সাহেব ছাড়া।”
“আসলে তা না।” কোত্থেকে আবার সকালের সেই হস্তিনী… মানে ওই মহিলাটা ফিরে এসেছেন, “ওই নাজিয়া মেয়েটাই সবাইকে জাদু করেছে। তাই সবাই ডাকাতের চেহারাই ভুলে গেছে। বলছি তো, ওই নাজিয়া মেয়েটাকে গ্রেপ্তার করুন, ওই সবকিছুর মূলে।”
“হোয়াট রাবিশ! আপনি আবার এখানে ঢুকেছেন কি করতে? যান, এক্ষুনি চলে যান!” চীফ ক্ষেপে উঠলেন। “আনন্দ, এই ছবির রহস্য তো ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে! এখন আপনিই কিছু একটা করুন।”
আমি আর কি করব, আমার কাছে তো সহজ সমাধান, ম্যানেজার ছবি দিতে ভুল করেছেন। ম্যানেজারকে এই কথা বলতেই উনি নিজের কথায় অটল রইলেন, “কখনই না। আমি কখনও ভুল করতে পারি না।” বলে কপালের ঘাম মুছলেন তিনি।
এদিকে ওই মহিলা আমার হাতের পেপারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, “না না, আনন্দ সাহেবই ঠিক বলেছেন, এটা ডাকাতটার ছবি হতেই পারে না। আমাকে নাজিয়া জাদু করতে পারেনি, আমি ঠিকই ওই ডাকাতের পাণ্ডাটাকে দেখেছিলাম।”
“তো আপনি এ কথা আগে বলেননি কেন?” চীফ খেঁকিয়ে উঠলেন।
এদিকে ম্যানেজারের মুখ কেমন যেন কালো হতে শুরু করেছে। আমি ওনাকে বললাম, “দেখুন, আপনি ভুল করে চটপটিওয়ালার ছবিটা ডাকাতের ছবির বদলে পুলিশকে দিয়ে দিয়েছিলেন। মনে নেই? আপনি চটপটিওয়ালার রেগুলার কাস্টমার… একদিন মোবাইল দিয়ে তার ছবি তুলেছিলেন…”
কেন জানিনা, আমার কথা শুনে হঠাৎ চারিদিকে পিনপতন নীরবতা নেমে এল। চীফ একবার আমার দিকে তাকান, আরেকবার ম্যানেজারের দিকে। আমার মাথায় তখন অবশ্য কিছু ঢুকছে না, আমার এই সাধারণ সমাধানটা কি কারো কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হল না?
হঠাৎ টুসির তারস্বরে “ম্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ ও” চিৎকারে সবাই চমকে উঠলো। আমার পায়ের কাছ থেকে সরে গিয়ে ম্যানেজারের কাছে গিয়ে রাগত স্বরে ম্যাও ম্যাঁও করতে লাগলো। এবার চিফের মুখ ফুটল, “কি ব্যাপার ম্যানেজার সাহেব, আপনি পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইচ্ছে করেই ভুল ছবি দেননি তো?”
একদিকে টুসির চেঁচানি আর আরেকদিকে চিফের এই কথা এই দুইয়ে মিলে এবার আমার মাথা শারলক হোমসের মতন কাজ করতে লাগলো। এইবার বুঝেছি, এই ম্যানেজারই তাহলে আসল নাটের গুরু! সমস্ত প্ল্যান তারই ছিল। আগের দিন সিসিটিভি নেটওয়ার্ক নষ্ট করা ওনারই কারসাজি। তারপর প্ল্যান অনুসারে ডাকাত দুজন ক্লায়েন্টের ছদ্মবেশে ব্যাঙ্কে ঢুকে ম্যানেজারের অফিসে যায়। তাদের কাছে রিভলবার ছিল না, তাই মেটাল ডিটেক্টরে ধরা পড়েনি। রিভলবার ছিল ম্যানেজারের অফিসে, ম্যানেজার আগেই লুকিয়ে রেখেছিলেন। ম্যানেজার মানুষ, গার্ড দুটো তাকে প্রতিদিন দেখে, একদিন হয়তো চেক করেনি, গার্ডদের চোখ এড়িয়ে  নিজের চেম্বারে রিভলবার আনা- নট সো ইম্পসিবল! তো তারপর ক্লায়েন্ট সাজা ডাকাত দুটো তার অফিসে ঢুকলে তিনি রিভলবার তাদের হস্তগত করে নিজে জিম্মি হবার নাটক সাজান। তারপর ডাকাতদের নির্দেশে গার্ডগুলো অস্ত্রসমেত বাকি লোকগুলোকে ভেতরে ঢুকতে দিতে বাধ্য হয়।পুলিশকে ভুল পথে ঠেলে দেবার জন্যই ম্যানেজার সাহেব চটপটিওয়ালার ছবিটা একটু আধটু ফটোশপ মেরে ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যাঙ্কের ইন্টেরিয়র দিয়ে ডাকাতের ছবি বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। এমনিতেই আমাদের চটপটিওয়ালা দেখতে গুণ্ডার মতন আর  চটপটি খেতে গিয়ে সেটা খেয়াল করে ম্যানেজার সাহেব সেটার ফায়দা ওঠাবার প্ল্যান সাজান। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, গতকাল মঙ্গলবার ছিল, মঙ্গলবার চটপটিওয়ালা এখানটায় বসে না সেটাও জানতেন ম্যানেজার, সব কিছু প্ল্যান মাফিক হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কিসমতের খেল, চটপটিওয়ালা যে এভাবে অকালে মারা যাবে সেটা কে জানতো?
এইবার সমাধানটা জম্পেশ হয়েছে! এক নিঃশ্বাসে চীফকে বলে ম্যানেজারের দিকে তাকালাম আমি। মাথা নিচু করলেন তিনি। তার এই নীরবতাকেই স্বীকারোক্তি ধরে নিলেন চীফ। দুজন কনস্টেবল লোকটাকে ধরে জিপে ওঠাল, হ্যাঁ, অবশ্যই, হ্যান্ডকাপ পড়িয়ে।
এবার চীফ এসে পারলে আমাকে জড়িয়ে ধরেন, “মানতেই হবে আনন্দ, আপনি সি আই ডির রত্নবিশেষ! তা কতদিন আছেন ওখানে?”
এবার আর সত্যটা চেপে রাখা উচিত বলে মনে হল না। বলেই ফেললাম নিজের আসল পরিচয়টা। “আসলে… আমি সি আই ডির আনন্দ চৌধুরী নই, আমার নাম এহসানুল কিবরিয়া আনন্দ। আর এটা আমার বেড়াল টুসি। পেপারে ছবি দেখে ডাকাতটাকে চেনা মনে হয়েছিল তাই পুরস্কারের লোভে… ডিটেকটিভ সাজতে হল…”
“হোয়াট রাবিশ!” ও মা, কোথায় গেল চিফের সেই বিনয়ী ভাব, দেঁতো হাসি? ভ্রূ কুঁচকে তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন, “গোয়েন্দাগিরি করবার জন্য  কি এই একটাই জায়গা ছিল পৃথিবীতে? যান, এখন ফুটেন। সি আই ডি অফিসার! আমার সাথে ফাইজলামি!”
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “কিন্তু… আমার পুরস্কারটা?”
“কিসের পুরস্কার?” চীফ চেঁচিয়ে উঠলেন, “ডাকাত ধরেছি আমি! বুঝলেন, এই আমি! আপনি কিসস্যু করেননি। বুঝছেন? সুতরাং পুরস্কারও পাবো আমি। হয়েছে? এবার এইখান থেকে ফুটেন। নইলে জানেন মিথ্যে পরিচয় দিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করবার অপরাধে আপনাকে আমি শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে পারি?” দাঁত কেলিয়ে হাসলেন চীফ। “সেটা কি ভালো হবে?”
মেজাজটা আমার ততক্ষণে সপ্তমে উঠে গেছে। কিন্তু কিছু বলতে বা করতে পারলাম না। জানেনই তো, আমি বড্ড নিরীহ গোবেচারা মানুষ, কিই বা করতে পারি! তাই মানে মানে সেখান থেকে কেটে পড়লাম। রিকশার খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে টুসিকে বললাম, “কেন এর প্রতিবাদ করলাম না জানিস? কারণ এদেশে ডাকাতের চেয়েও পুলিশ বেশি ডেঞ্জারাস!”
টুসি  সমবেদনার সাথে বলে উঠলো, “ম্যাঁও!” অর্থাৎ “একদম ঠিক!”

গল্পটি পাঠিয়েছেনঃ অথই নীলিমা

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

দুঃখিত!