হরিণ জাতক

হরিণ জাতক

রাজা ব্রহ্মদত্তের আমলে বোধিসত্ত্ব একবার হরিণকুলে জন্ম নেন। সাধারন হরিণের সঙ্গে তাঁর চেহারার বিস্তর অমিল।

 

গায়ের রং কাঁচা সোনা। শিং দুটি রূপোর মত চকচকে। চোখের রং রক্ত কজ্জলের মতো। লেজটি ছিল চমরী গাভীর মত। আর শরীরটি দেখতে ছিল তেজী ঘোরার ছানার মত। বোধিসত্ত্ব ‘ন্যগ্রোধ মৃগরাজ’ নাম নেন। পাঁচশ হরিণ-হরিণীর দলপতি হয়ে বনে ঘুরে বেড়াতেন। একটু দূরে এরকমই আরেকটি হরিণ বিচরণ করত। তার নাম ‘শাখা মৃগ’। তার দলেও ছিল পাঁচশ হরিণ-হরিণী।

 

ব্রহ্মদত্ত হরিণের মাংস খেতে খুব ভালবাসতেন। হরিণের মাংস না থাকলে তাঁর খাওয়াই হয় না। রোজ বনে যেতেন শিকার করতে। রাজার সঙ্গে কর্মচারীদেরও ছুটতে হয় হরিণ শিকারে। ঘরদোর ফেলে, অন্য সব কাজ ফেলে রোজ শিকার করতে যাওয়ার ঝঞ্ঝাটা খুব কম নয়।

 

অনেক ভাবনা চিন্তা করে তারা একটা ফন্দি বের করল।রাজার বাগানের যদি অনেক হরিণ মজুত করে রাখা যায় তাহলে সমস্যা মেটে। এভাবে তারা দল বেঁধে বনে গেল। হরিণ তাড়িয়ে নিয়ে এল রাজার বাগানে। তাড়া খেয়ে হরিণের দল রাজার বনের মধ্যে ঢুকে পড়লে ফটক বন্ধ করে দিল। তারপর তারা রাজার কাছে গেল। বলল, ‘মহারাজ, রোজ হরিণ শিকারে গেলে আমাদের ঘর-গেরস্থের কাজে খুব অসুবিধা হবে। সে জন্য আমরা একটা ব্যবস্থা করেছি। আপনার বাগানে বনের হরিণ এনে আটক করে রেখেছি। ফলে আপনার খুশিমত রোজ একটা হরিণ জবাই করতে কোন অসুবিধা হবে না।’

 

 

রাজা ব্রহ্মদত্ত বাগানে এলেন। দেখে খুশি হলেন। এক সঙ্গে এত হরিণ। ‘ন্যগ্রোধ মৃগরাজ’ আর ‘শাখা-মৃগ’ কে দেখে তিনি মুগ্ধ। ওদের দুজনকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা নিশ্চিন্ত থাক। তোমাদের কোনদিন কোন ক্ষতি হবে না।’

 

এরপর থেকে রাজার লোকজন হরিণ মারতে বাগানে ঢুকত। রাজার লোক তীরধনুক নিয়ে ঢুকলে ভয়ে সমস্ত হরিণ ছুটাছুটি শুরু করে দিত, এর ফলে অনেকে তীর বিদ্ধ হয়ে মারা যেত।

 

‘ন্যাগোধ মৃগরাজ’ ও ‘শাখা-মুগ’ তখন সব হরিণদের ডেকে আলোচনা শুরু করল। কেননা এভাবে চলতে থাকলে হরিণকুল দুদিনে শেষ হয়ে যাবে। অনেক আলোচনার পর ঠিক হল, এবার থেকে পালা করে একেকজন নিজের ইচ্ছায় হাঁড়িকাঠে মাথা দেবে।

 

ব্যবস্থাটি দু দলের সকলরেই পছন্দ হল। পরে রাজাকে জানান হল। তারপর থেকে এই নিয়মেই কাজ হতে লাগল। কোন হরিণ কোন দিন আত্মবলিদান করবে সেটা দল ঠিক করে দিত।

একদিন শাখা-মৃগ দলের এক হরিণীর পালা এল। তখন ঐ হরিনীটি পূর্ণগর্ভা। সে শাখা-মৃগকে অনুরোধ করল, ‘হে দলপতি, আমি এই অবস্থায় মারা গেলে বাচ্চাটাও মারা যাবে। তাতে দলেরই ক্ষতি। আজ যদি অন্য কেউ প্রাণ দেয় তাহলে খুব ভাল হয়।

 

শাখামৃগ বলল, ‘তা হয় না। আজ তোমার পালা। আমি আর কাউকে তোমার বদলে প্রাণ দিতে বলতে পারি না।’

হরিণী তখন বোধিসত্ত্বের কাছে গেল। সব কিছু শোনার পর বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘ভয় পেয় না, কথা দিচ্ছি তোমাকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমার।’

হরিণী চলে গেলে বোধিসত্ত্ব নিজে হাঁড়িকাঠে মাথাটি গলিয়ে দিলেন।

রাজার লোকজন এস ন্যাগ্রোধ মৃগকে দেখে অবাক হল। সঙ্গে সঙ্গে রাজাকে খবর দিল। রাজা এসে ন্যগ্রোধ মৃগকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “মৃগরাজ, আমি তোমাকে কথা দিয়েছি তোমার কোন ক্ষতি হবে না। তাহলে তুমি কেন হাঁড়িকাঠে মাথা দিলে?”

 

বোধিসত্ত্ব বললেন,“মহারাজ, নিয়ম অনুসারে আজ এক হরিণর পালা। সে গর্ভবতী। তাছাড়া সে আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিল। আমি তার বদলে অন্য কাউকে মরতে বলতে পারি না। তাই নিজের প্রাণ দিয়ে তাকে বাঁচাব ঠিক করি।

‘ওঠ মৃগরাজ, তোমাকে আর সেই হরিণীকে অভয় দিচ্ছি।’

বাগানের আর সব হরিণের কি হবে মহারাজ?’

‘তাদেরও অভয় দিলাম।’

‘বনে যে সব হরিণ আছে তাদের কি হবে?’

‘তাদেরও অভয় দিলাম।’

‘বনের অন্য প্রাণীদের কি হবে মহারাজ?’

‘তাদেরও অভয় দিচ্ছি।’

মাছ বা জলচর প্রাণীদের কি হবে?’

তারাও নিরাপদে থাকবে।’

‘আকাশচারী পাখিদের কি হবে রাজা?’

‘তাদেরও অভয় দিচ্ছি।’

এভাবে সমগ্র প্রাণিজগৎ রক্ষা পাওয়ার পর বোধিসত্ত্ব হাঁড়িকাঠ থেকে মাথা বের করে নিলেন।

তখন রাজা বললেন, ‘মৃগরাজ, জীবজগতের প্রাণ বাঁচাতে আজ তুমি যা করলে তার তুলনা নেই। মানুষের মধ্যেও এমন নজির নেই। আমি আমার রাজ্যে আজ থেকে জীবহত্যা নিষিদ্ধ করে দিলাম।’

তারপর হরিণরা দল বেঁধে বনে ফিরে গেল। যাবার আগে বোধিসত্ত্ব রাজাকে ধর্মকথা শোনালেন, ‘মহারাজ, হিংসা ত্যাগ করুন। সকলকে ভালোবাসুন। মৃত্যুর পর আপনার স্বর্গ বাস হবে।’

 

বোধিসত্ত্বের দয়ায় জীবন ফিরে পাওয়ার কিছুদিন পর সেই গর্ভিণী হরিণী এক শাবক প্রসব করল। নবজাত সেই হরিণটি শাখা-মৃগকে খুব পছন্দ করত। তার সঙ্গে খেলে বেড়াত। তা দেখে হরিনীটি একদিন তাকে বলল, ‘বাছা, তুমি শাখা-মৃগের সঙ্গে মেশা ছেড়ে দাও। ন্যগ্রোধ মৃগের সঙ্গে থাক। এতে তোমার মঙ্গল হবে। তাতে যদি তখনও তোমার জীবন যায় তবু জানবে সেটাই ভালো। আর শাখা-মৃগের সঙ্গে থেকে যদি অমর হও তবে জানবে তাতেও তোমার কোন সুখ নেই।’

 

 

এদিকে রাজার কাছ থেকে অভয় পেয়ে হরিণরা দুরন্ত হয়ে উঠল। লোকালয়ে গিয়ে শস্য নষ্ট করতে শুরু করল। রাজার নিষেধ থাকায় কেউ তাদের মারতে পারছে না। সমস্ত প্রজা্রা একজোট হয়ে একদিন রাজার দরবারে গিয়ে বলল, ‘মহারাজ, হরিণের দাপটে আমরা মরতে বসেছি।’

 

রাজা ব্রহ্মদত্তক সব শুনে বললেন, ‘ন্যগ্রোধ মৃগকে আমি যে বর দিয়েছি তা ফিরিয়ে নিতে পারি না। রাজ্য রসাতলে গেলেও প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারি না।’

 

বোধিসত্ত্ব রাজার বিচার শুনে দলের হরিণদের ডাকলেন। বললেন,‘ আজ থেকে তোমরা লোকের ক্ষেতের শস্য নষ্ট আর করবে না।’ তারপর কৃষকের কাছে খবর পাঠালেন, ‘তোমরা ক্ষেতের চারপাশে বেড়া দিও না। ক্ষেতগুলো আলাদা করার জন্য পাতা দিয়ে ঘিরে রাখলেই হবে।’

 

লোকে বলে, পাতার মালা দিয়ে ক্ষেত ঘেরার প্রথা তখন থেকেই চালু হয়। হরিণেরা তারপর থেকে কখনও পাতার মালা ডিঙিয়ে ক্ষেতে ঢোকে নি।

 

এই আজকের মর্মকথা: অহিংসা

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!