ছিল না, পরে এল, তার পরে চলে গেল, এটা কোনও ধাঁধার লাইন নয়৷ উক্তিটি প্রযোজ্য দাঁত সম্পর্কে৷ দাঁত সাধারণত বহু বছর মানুষের সঙ্গী হিসেবে থাকে, ছ-সাত মাস বয়সে গুটি গুটি মাড়ি থেকে ফুটি ফুটি হয়ে বেরোয় আবার শেষের কিছু বছরে হয়ে যায় উধাও৷ দাঁত গজানোর সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব বর্তায় তাকে পরিষ্কার রাখা, রোজ সকালে টুথপেস্ট সহযোগে টুথব্রাশের সাহায্যে খচ খচ খ্যাচ খ্যাচ৷ তা না হলে মুখে দুর্গন্ধ, দাঁতে ক্যাভিটি, গাল ফোলা গোবিন্দর মা হয়ে চল ডেনটিস্টের কাছে, তারপর দন্ত উৎপাটন, মাইনাস ওয়ান ফ্রম থার্টি টু৷ সাধারণভাবে কার দাঁত কেমন দেখতে সেটা সহজে দেখা যায় না বা দেখলেও বিশেষ মনে থাকে না৷ কেন না, দন্ত বিকশিত আকর্ণ হাসি হাসলেই একমাত্র দাঁতকে দেখা যায়, তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে কয়েকজনের দাঁত অতি আগ্রহে বেরিয়ে থাকে, দুই ঠোঁটের বন্ধনে তাকে বাঁধা যায় না, এই ধরনের দাঁতের মালিককে ‘দাঁতাল’ সম্বোধন করা হয়৷ দাঁতালরা কথা বলার সময়েই দাঁতকে চেপে রাখতে পারে না, হাসলে তো সর্বনাশ!
হাসির সঙ্গে দাঁতের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক৷ হাসিকে দাঁত বিয়ের কনের মতো সাজিয়ে রাখে৷ কোনও কোনও মানুষের হাসি ভোলা যায় নাক্ট উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেনের মতো হাসি আর কেউ হাসতে পারেনি৷ হাসি বহু রকমের৷ মনভোলানো হাসি, বাঁকা হাসি, চাপা হাসি, তাচ্ছিল্যের হাসি, লোকদেখানো হাসি, অট্টহাস্য, সরল হাসি, ন্যাকা হাসিক্ট প্রতিটি হাসিতে দাঁতের প্রকাশ বিভিন্ন৷ কিন্তু যে হাসিতে মন মুগ্ধ হয়ে যায়, তার মূলে দাঁতেরই কৃতিত্ব৷ সুন্দর দাঁতই সুন্দর হাসির জন্ম দিতে পারে৷
‘এক চড়ে দাঁত খুলে দেব’ক্ট কথাটা বলা সহজ কিন্তু করা বেশ কঠিন৷ একমাত্র বাঘ বা সিংহের চড়ে সেটা হওয়া সম্ভব৷ আর এটাও বুঝি না, চড় গালে মেরেই কেউ ক্ষান্ত হয় না কেন? গালের অভ্যন্তরে দাঁতের প্রতি নজর কেন? অবশ্য দাঁতের প্রশংসাতেও অনেকে মুখর৷ ‘মুক্তোর মতো দাঁত’ক্ট আশা করি এ ক্ষেত্রে মুক্তোর রঙটুকুকেই বলা হয়, কেন না, মুক্তোর মতো গোল গোল দাঁত হলে তো কেলেঙ্কারি৷ কোনও এক গানে শুনেছিলাম, ‘শ্বেত দোপাটি হাসি’ক্ট তাতে দোপাটির সঙ্গে দাঁতকপাটির মিলটাও চোখে পড়ার মতো৷ হাসি মানুষের মনে আনন্দ আনে কিন্তু দাঁত এবং জিভের সমঝোতায় যখন ভেঙচি কাটা হয়, সেটা ততটাই বিরক্তিকর৷ ভয় দেখানোর জন্যেও দাঁতকে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়, ড্রাকুলা তো তার ছুঁচলো দাঁত দেখিয়ে সারা পৃথিবীর লোককে ভয়ে কাত করে ফেলেছে৷ তবে বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত হল ‘মুলোর মতো দাঁত’৷ এটা হলে তো দাঁত আর মুখের ভেতর থাকতে পারবে না, হাতির দাঁতের মতো বাইরে টেঙে থাকবে৷
ভোটের আগে সব নেতার দাঁত বাইরে বেরিয়ে থাকে৷ পরমাত্মীয়র মতো সব সময় তাঁদের মুখে ঝুলে থাকে মনভোলানো হাসি৷ ব্যালট বাক্সগোনা শেষ হলে তাঁদের দাঁত আর দেখা যায় না৷ বিয়ের আগে কনেপক্ষে আর বরপক্ষের যে অনাবিল হাসি দেখা যায়, বিয়ের পর দহেজের হিসেব মেলাতে মেলাতে সে হাসি যায় শুকিয়ে৷ অনেক ক্ষেত্রে মনের মতো দহেজ না পেয়ে বরপক্ষের অত্যাচারে নতুন কনের দাঁত ভাঙা পড়ে, কখনও প্রাণসংশয়ও হয়৷
প্রেমের প্রথম পর্যায়ে ভিক্টোরিয়া বা অন্য কোনও বাগানে বসে প্রেমিকেরা দাঁতে ঘাস কাটেন এবং বিয়ের পর সেই দাঁতেই তাঁরা স্বামীর মাথা চিবোন৷ বয়স বাড়লে দাঁত হারিয়ে নকল দাঁত লাগালেও মাথা চিবোনোতে কোনও ব্যাঘাত হয় না৷
ডাইনিং টেবিলে বসলে দাঁতের ব্যস্ততা ভীষণ বেড়ে যায়, কেননা, না চিবিয়ে তো কোনও খাদ্যই পেটে পাঠানো যায় না৷ তাই অগত্যা কচর কচর, দু পাটি দাঁতের মাঝখানে খাবার ফেলে তার শ্রাদ্ধ করা৷ শিশুকালে দাঁত ওঠার সুড়সুড়ি আর বিগত যৌবনে দাঁতে টুথপিকের কুড়কুড়ি৷
কৎবেল খেলে টোকো দাঁত, নিমপাতা চিবোলে তেতো দাঁত, বাদামে বালি থাকলে দাঁতে কিচ্কিচ্, রসগোল্লা খেলে দাঁতের ফাঁকে জিভের জলক্ট কোনও না কোনও কিছু খাবারের জন্য দাঁত তার পাটি মেলেই রেখেছে৷ দাঁত বিদায় নেওয়ার পর আসে নকল দাঁত৷ যতই হিসেবনিকেশ করে বানানো হোক না কেন, উনিশ-বিশ হবেই৷ এর পর রোজ রাতে তাকে জলে চুবিয়ে রেখে আয়নায় যখন দন্তহীন চেহারাটা দেখতে হয়ক্ট সেটা সত্যিই দুঃখের৷ কেউ একজন কোনও শোকসভায় শোকে মুহ্যমান হয়ে নিজের নকল দাঁতের পাটি হাতে নিয়ে শোকপ্রকাশ করছিলেন, সেই দৃশ্য দেখে একটি বাচ্চা ছেলে আঁ আঁ করে চেঁচিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়৷ মুহূর্তে সেই শোকসভার পরিবেশ যায় পাল্টে! পান-সুপুরির সঙ্গে দাঁতের সম্পর্ক অনবিচ্ছেদ্য৷ ‘ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা পান খাইয়া যাও, আল্লার দোহাই’ক্ট পান চিবোনোর প্রথম পর্যায়টা বেশ রোমান্টিক, ‘পান খায় সঁইয়া হমারো’– তারপর ক্রমশ পান, চুন, দোক্তা ও জর্দার অত্যাচারে দাঁতে হয় পার্মানেন্ট লাল ছোপ, হাজার বার টুথ ব্রাশ করলেও তা মেটে না, এমতাবস্হায় ওই দাঁতের হাসি সত্যিই বেদনাদায়ক৷ সুন্দরীর রাঙা ঠোঁটে পান কিংবা সুন্দর ছাঁটা গোঁফের আড়ালে পুরু ঠোঁটের নিচে পান সত্যিই আকর্ষক দৃশ্য, কিন্তু পানকে সঙ্গী করলে বার্ধক্যে দাঁতের অবস্হা হয় অসহনীয়৷
লজ্জা ঢাকতে জিভ কাটতেও সেই দাঁত৷ মা কালী যে সেই কবে দাঁত দিয়ে জিভ কেটে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন শিবের বুকে, সেই থেকে দাঁত আর জিভ থেকে সরেনি৷ কত ভক্ত মা-মা বলে কেঁদে মরল, কিন্তু মা ন যযৌ ন তস্হৌ৷
‘এসেছিলে তবু আসো নাইক্ট জানায়ে গেলে’ক্ট এ তো আমাদের দাঁতেরই গান৷ এক এক করে তারা আসে, কিছুদিন সঙ্গ দেয়, আবার এক এক করে বিদায় নেয়৷ আগমনীর সময় শিশুর মুখ থাকে ফুলের মতো সুন্দর, বার্ধক্যে বিদায়লগ্নে গাল তুবড়ে দিয়ে চলে যায়ক্ট হায় রে দাঁত, যত্ন করি তোমার দিন রাত, তবু যাও দু হাতে ঠেলে, করে যাও মোরে কুপোকাত৷
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।