পুঁই মাচা-৭ম অংশ–বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্প

 

 

বাড়ির বাহির হইয়া আমলকীতলায় বেহারার সুবিধা করিয়া লইবার জন্য বরের পালকি একবার নামাইল। অন্নপূর্ণ চাহিয়া দেখিলেন, বেড়ার ধারের নীল রঙের মেদিফুলের গুচ্ছগুলি যেখানে নত হইয়া আছে, ক্ষেত্তির কম দামের বালুচরের রাঙা চেলির আঁচলখানা পালকির বাহির হইয়া সেখানে লুটাইতেছে।..তাহার এই অত্যন্ত অগোছালো, নিতান্ত নিরীহ, একটু অধিকমাত্রায় ভোজনপটু মেয়েটিকে পরের ঘরে অপরিচিত মহলে পাইয়াছে তার বুক উদ্বেল হইয়া উঠিতেছিল। ক্ষেত্তিকে কি অপরের ঠিক বুঝিবে?…
যাইবার সময় ক্ষেত্তি চোখের জলে ভাসিতে ভাসিতে, সান্তুনার সুরে বলিয়াছিল-মা, আষাঢ় মাসেই আমাকে এনো…বাবাকে পাঠিয়ে দিও…দুটো মাস তো…
ও-পাড়ার ঠানদিদি বলিলেন—তোমার বাবা তোর বাড়ি যাবে কেন রে, আগে নাতি হোক—তবে তো…

ক্ষেত্তির মুখ লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিল। জলভরা ডাগর চোখের উপর একটুখানি লাজুক হাসির আভা মাখাইয়া সে একগুঁয়েমির সুরে বলিল-না, যাবে না বৈকি?…দেখো তো, কেমন না যান।
ফাগুন-চৈত্রমাসের বৈকালবেলা উঠানের মাচায় রৌদ্রে-দেওয়া আমস তুলিতে তুলিতে অন্নপূর্ণার মন হু-হু করিত…তাহার অনাচারী লোভ মেয়েটি আজ বাড়িতে নাই যে কোথা হইতে বেড়াইয়া আসিয়া লজ্জাহীনার মতোন হাতখানি পাতিয়া মিনতির সুরে অমনি বলিবে—মা, বলব একটা কথা, এই কোণটা ছিরে আক টূ খাণী
এক বছরের উপর হইয়া গিয়াছে। পুনরায় আষাঢ় মাস। বর্ষা বেশ নামিয়াছে। ঘরের দাওয়ায় বসিয়া সহায়হরি প্রতিবেশী বিষ্ণু সরকারের সহিত কথা বলিতেছে। সহায়হরি তামাক সাজিতে সাজিতে বলিলেন–ও তুমি ধরে রাখো, ওরকম হবেই দাদা। আমাদের অবস্থার লোকেও ওর চেয়ে ভালো কী আর জুটবে?
বিষ্ণু সরকার তালপাতার চাটাইয়ের উপর উৰু হইয়া বসিয়াছিলেন, দূর হইতে দেখিলে মনে হইবার কথা, তিনি রুচি করিবার জন্য ময়দা চটকাইতেছেন। গলা পরিষ্কার করিয়া বলিরৈন-নাহ, সব তো আর.তাছাড়া আমি যা দেব নগদই দেব …তোমার মেয়েটির হয়েছিল কী?
সহায়হৰি হুকটায় পাঁচ-ছটি টান দিয়া কাশিতে কাশিতে বলিলেন—বসন্ত হয়েছিল শুনলাম। ব্যাপার কী দাঁড়াল বুঝলে? মেয়ে তো কিছুতে পাঠাতে চায় না। আড়াইশো আন্দাজ টাকা বাকি ছিল, বললে ও টাকা আগে দাও তবে মেয়ে নিয়ে যাও।
—তাপর বললাম, টাকাটা ভায়া ক্ৰমে-ক্রমে দিচ্ছি। পুজোর তত্ত্ব কম করেই ত্রিশটে টাকার কম হবে না ভেবে দেখলাম কিনা! মেয়ের নানা নিন্দে খাই..আরও কত কী পৌষমাসে দেখতে গেলাম—মেয়েটাকে ফেলে থাকতে পারতাম না, বুঝলে?
সহায়হরি হঠাৎ কথা বন্ধ করিয়া জোরে জোরে মিনিট-কতক ধরিয়া হুকায় টান দিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ দুজনের কোনো কথা শোনা গেল না।
অল্পকক্ষণ পরে বিষ্ণু সরকার বলিলেন-তারপর?
-আমার স্ত্রী অত্যন্ত কান্নাকাটি করাতে পৌষমাসে দেখতে গেলাম। মেয়েটার যে-অবস্থা করেছে। শাশুড়িটা শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল, না-জেনেশুনে ছোটলোকের সঙ্গে কুটুম্বিতে করলেই এরকম হয়, যেমনি মেয়ে তেমনি বাপ, পোষ মাসের দিন মেয়ে দেখতে এলেন শুধু-হাতে!..পরে বিষ্ণু সরকারের দিকে চাহিয়া বলিলেন-বলি আমরা ছোটলোক কি বড়লোক, তোমার তো সরকার খুড়ো জানতে বাকি নেই, বলি পরমেশ্বর চাটুয্যের নামে নীলকুঠির আমলে এ-অঞ্চলে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেয়েছে—আজই না হয় আমি.প্রাচীন আভিজাত্যের গৌরবে সহায়হরি শুষ্কসুরে হা-হা করিয়া খানিকটা শুষ্ক হাস্য করিলেন।

বিষ্ণু সরকার সমর্থনসুচক একটা অস্পষ্ট শব্দ করিয়া বারকতক ঘাড় নাড়িলেন।
–তারপর ফাগুন মাসেই তার বসন্তু হল। এমন চামার-বসন্ত গায়ে বেরুতেই টালায় আমার এক দূর-সম্পর্কের বোন আছে, একবার কালীঘাটে পুজো দিতে এসে তার খোজ পেয়েছিল—তারই ওখানে ফেরে রেখে গেল। আমায় না একটা সংবাদ, না কিছু। তারা আমায় সংবাদ দেয়। তা আমি গিয়ে…
–দেখতে পাওনি?
–নাহ এমনি চামার-গহনাগুলো অসুখ অবস্থাতেই গা থেকে খুলে নিয়ে তবে টালায় পাঠিয়ে দিয়েছে।..যাক, তা চলো, যাওয়া যাক, ৰেল গেল।…চার কি ঠিক করলে.পিপড়ের টোপে মুড়ির চার তো সুবিধে হবে না…
তারপর কয়েকমাস কাটিয়া গিয়াছে। আজ আবার পৌষ-পার্বণের দিন । এবার পৌষ মাসের শেষাশেষি এত শীত পড়িয়াছে যে অত্যন্ত বৃদ্ধ লোকেরাও বলাবলি করিতেছেন যে, এরূপ শীত তাহারা কখনো জ্ঞানে দেখেন নাই।
সন্ধ্যার সময় রান্নাঘরের মধ্যে বসিয়া অন্নপূর্ণ সরুচাকলি পিঠার জন্য চালের গুঁড়ার গোলা তৈয়ারি করিতেছেন। পুটি ও রাধা উনানের পাশে বসিয়া আগুন পোহাইতেছে।

রাধা বলিতেছে—আর একটু জল দিতে হবে মা, অত ঘর করে ফেললে কেন ।
পুঁটি বলিল—আচ্ছা মাওতে একটু নুন দিলে হয় না?
–ওমা দেখ মা, রাধার দোলাই কোথায় ঝুলছে, এখুনি ধরে উঠবে..
অন্নপূর্ণ বলিয়া উঠিলেন—সরে এসে বসে না, আগুনের ঘাড়ে গিয়ে না বসলে কি আগুন পোহানো হয় না? এদিকে আয় ।
গোলা তৈয়ারি হইয়া গেল,…খোলা আগুনে চড়াইয়া অন্নপূর্ণ গোলা ঢালিয়া মুচি দিয়া চাপিয়া ধরিলেন…দেখিতে দেখিতে মিঠে-আঁচে পিঠা । টোপরের মতোন ফুলিয়া উঠিল।

পুঁটি বলিল—মা দাও, প্রথম পিছনে ষাঁড়া-গাছের ঝোপের মাথায় তেলাকুচো লতার থোলো থেলো শাদা ফুলের মধ্যে জোছনা আটকিয়া রহিয়াছে।…
পুঁটি ও রাধা খিড়কি-দোর খুলিতেই একটা শিয়াল শুকনো পাতায় খসখস শব্দ করিতে করিতে ঘন ঝোপের মধ্যে ছুটিয়া পলাইল । পুঁটি পিঠাখানা জোর করিয়া ছুড়িয়া ঝোপের মাথায় ফেলিয়া দিল। তাহার পর চারিধারের নির্জন বাশবনের নিস্তব্ধতায় হয় পাইয়া ছেলেমানুষ পিছু হটিয়া আসিয়া খিড়কিদরজার মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়া তাড়াতাড়ি দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।
পুটি ও রাধা ফিরিয়া আসিলে অন্নপূর্ণ জিজ্ঞাসা করিলেন-দিল্লি?
পুঁটি বলিল—হ্যা মা তুমি আর-বছর যেখানে থেকে নেবুর চারা তুলে এনেছিলে সেখানে ফেলে দিলাম
তারপর সে-রাত্রে অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। পিঠে গড়া প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে…রাতও তখন খুব বেশি।…জোছনার আলোয় বাড়ির ফিচনের বনে অনেকক্ষণ ধরিয়া একটা কাঠঠোকরা পাখি ঠক-র-র-ল্ শব্দ করিতেছিল, তাহার স্বরটাও যেন ক্রমে তন্দ্ৰালু হইয়া পড়িতেছে…দুই বোনের খাইবার জন্য কলার পাতা চিরিতে চিরিতে পুটি অন্যমনস্কভাবে হঠাৎ বলিয়া উঠিল-দিদি বড় ভালোবাসত…
তিনজনেই খালিনক্ষণ নির্বাক হইয়া বসিয়া রহিল, তাহার পর তাহদের তিনজনেরই দৃষ্টি কেমন করিয়া আপনাআপনি উঠানের এককোণে আবদ্ধ হইয়া পড়িল.যেখানে বাড়ির সেই লোভী মেয়েটির লোভের স্মৃতি পাতায়পাতায় শিরায়-শিরায় জড়াইয়া তাহার কত সাধের নিজের-হাত-পোতা পুঁইগাছটি মাচা জুড়িয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে। বর্ষার জল ও কার্তিক মাসের শিশির লইয়া, কচি-কচি সবুজ ডগাগুলি মাচাতে সব ধরে নাই, মাছা হইতে বাহির হইয়া দুলিতেছে…সুপুষ্ট, নধর, প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর!..

 

পুঁইমাচা ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!